জীবন যেভাবে আনন্দময়

১.
অফিসের কাজে চট্টগ্রামে অবস্থান করছি প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে। বস ফোন দিয়ে কিছু একটা বললেন। এমনিতেই ইংরেজিতে দুর্বল, উপরন্তু আবার মধ্যপ্রাচ্যের উচ্চারণ। ওরা একটা শব্দের অর্ধেক বলে আর অর্ধেক গিলে ফেলে। আমি ইয়েস–নো দিয়ে কোনোমতে চালিয়ে নিই। সেভাবেই ইয়েস বলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বসের চিৎকারে বুঝলাম ভুল প্রসঙ্গে ইয়েস বলে ফেলছি।

অস্ট্রেলিয়াতে বাসা বদল শেষে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অফিসে গিয়েছি চাবি হস্তান্তর করতে। আমার ইংরেজি কথা শুনে রিয়েল এস্টেট এজেন্সির প্রতিনিধি পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘আপনার মনে হয় ইংরেজি বলতে কষ্ট হচ্ছে। আপনি বাংলায় বলেন, আমি বাংলা বুঝি।’


বর্তমান অফিসে নতুন একটা প্রজেক্ট এসেছে। বস বললেন, আলী তুমি এখন কোন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছ? আমি বললাম দ্য রিবন (The Ribbon)।উনি বুঝতে পারলেন না। আমি আরও দুবার বলার পর বললেন, ওহ দ্য রিবিন।

২.
অফিস থেকে বাৎসরিক নদীভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে। আসলে নদী হবে না হবে সমুদ্রভ্রমণ। তো ভ্রমণে গিয়ে বিভিন্ন রকমের মজা করা হচ্ছে পাশাপাশি চলছে খানাপিনা। এমনই একসময় আমাদের কোম্পানির দুজন ডিরেক্টরের একজন বললেন, ‘আলী তোমাকে যদি এখন পানিতে ফেলে দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু হাঙর তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’ সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তর দিলাম, তা ঠিক আছে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমি না হাসছি ততক্ষণ পর্যন্ত হাঙর আমাকে খুঁজে পাবে না। শুনে উনি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন। আমি তখন যোগ করলাম, কারণ অন্ধকারে শুধু আমার দাঁতগুলোই দেখা যায়। এরপর সবাই একসঙ্গে হাসির রোল তুলল। উনি এরপর এই গল্প কতজনকে যে বলেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

৩.
দুপুরের খাবারের বিরতিতে একটা পার্কে গিয়ে বসি মোটামুটি নিয়মতই। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বসে আছি হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন আমার পেছনে গায়ের ওপর প্রস্রাব করছেন। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি পার্কের ঘাসে পানি দেওয়ার জন্য একধরনের ঘোরানো ঝরনা চালু করা রয়েছে। সেগুলোই ঘুরতে ঘুরতে এসে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। পাশেই পার্কের পরিচর্যায় নিয়োজিত দুজন মানুষ কাজ করছিলেন। আমার অবস্থা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসা শুরু করেছেন। আমিও হাসতে হাসতে তাঁদের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমরা তোমাদের বাচ্চা সামলাও যেন আর আমার গায়ে প্রস্রাব করে না দেয়। সেটা শুনে তাঁদের হাসি আরও বিস্তৃত হলো। আমিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলাম। এরপর থেকে তাঁদের সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে তাঁরা কুশল বিনিময় করেছেন।

৪.
অফিসে মাঝেমধ্যে কাজ করতে করতে অনেক রাত হয়ে যায়। একেবারে শেষে যে বের হয় তাকে অ্যালার্ম অন করে বের হতে হয়। একদিন আমি আর আমার সেই ডিরেক্টর অফিসে ছিলাম। আমার বসার জায়গাটা তিনতলার একেবারে শেষ প্রান্তে। ভালোমতো খেয়াল না করলে বোঝা যায় না আমি অফিসে আছি কি নাই। রাত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি অফিস থেকে বের হয়ে অ্যালার্ম অন করে চলে গিয়েছেন। আমি দেখি হঠাৎ সবকিছু অন্ধকার। ডেস্ক থেকে উঠে আসতে আসতে উনি চলে গিয়েছেন। আমার নড়াচড়াতে অ্যালার্ম বেজে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনটাও বেজে উঠেছে। টেলিফোন ধরার পর নারী নিরাপত্তাকর্মী বললেন তোমার নাম কী। নাম বললাম। উনি তখন জিজ্ঞেস করলেন এটা কীভাবে হলো। আমি বললাম, আমার গাত্র ঘোর কৃষ্ণবর্ণের, তাই রাতের বেলা খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। তাই হয়তো বস আমাকে দেখতে পাননি। শুনে ওই নারী হাসতে হাসতে খুন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বের হয়ে আবার অ্যালার্মটা অন করে দিয়ো।

৫.
অফিসে আমাদের টিমে আমরা মাত্র তিনজন। আমি আমাদের বস আর একজন চাইনিজ বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ান। উনি আবার শুক্রবার ছুটিতে থাকেন। তখন শুধু আমি আর আমাদের বস। অথবা বেশির ভাগ শুক্রবারে আমি একাই অফিস করি। তখন ডিরেক্টররা এসে আমার বসকে খুঁজলে আমি বলি আজ আমিই বস। তখন তাঁরা বলেন তোমার বস এমন কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করল কবে থেকে। আমি বললাম একদিন অফিসের ফটোকপির মেশিনটা ঠিকঠাক কাজ করছিল না তাই আমার বস সেটা ঠিক করতে গিয়ে ভুল করে কপিয়ারে চাপ পড়ে গিয়েছিল। তখন ফটোকপিয়ারের অন্য পাশ দিয়ে আমি বের হয়ে এসেছি।

৬.
আমাদের অফিসের প্রায় সব স্টাফই বংশসূত্রে আইরিশ। এর বাইরে একজন লেবানিজ, দুজন চাইনিজ আর আমিই একমাত্র সাউথ এশিয়ান আর বয়সেও সবার ছোট তাই সবাই ভীষণ স্নেহ করেন। এখানে পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে হাগ দিয়ে কিস দেওয়ার চল আছে। অফিসে ক্রিসমাসের তিন সপ্তাহের ছুটি শুরু হচ্ছে। সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। আমি আমাদের একজন মেয়ে কলিগের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে উনি একইভাবে আমাকে হাগ দিয়ে একটা কিস দিলেন। সেটা দেখে অন্য একজন মজা করে বলে উঠলেন আলীকে কিস দিলেন আমাকে তো দিলেন না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম আমি সবার ছোট তাই সবাই আদর করে আমাকে কিস দেয় ঠিক যেমন ছোট বাচ্চাদের সবাই আদর করে। শুনে উনি বললেন, তোমার বয়স কত? আমি বললাম, লোকে বলে বায়ো কি তেয়ো মায়ে বলে আরও কম।

জীবনটা আসলে এমনই সহজ। আমরাই এটাকে জটিল করে ফেলি। আপনি একটু খোলা মন নিয়ে এখানকার মানুষের সঙ্গে মিশলে তারা দ্রুতই আপনাকে আপন করে নেবে কিন্তু আমরা সেটা না করে বিভিন্ন নিয়ম এবং বিধিনিষেধের জালে নিজেদের বন্দী করে ফেলি আর তখনই বিভিন্ন প্রকারের জটিলতা তৈরি হয়। আর নিজেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন হাসি–ঠাট্টার মাধ্যমে। তাহলে দেখবেন জীবন আপনাকে ঠিক সেই নারী সহকর্মীর মতো হাগ এবং কিস দিচ্ছে।