আমার বাবা আমার প্রশিক্ষক

১.

ছোটবেলায় দেখতাম, আমার বয়সী ছেলেরা বাইসাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের বাইসাইকেল চালানো দেখে আমার খুব মন খারাপ হতো। আমাদের বাইসাইকেল ছিল না। বাবাকে বাইসাইকেল কেনার কথা বলার সাহস পেতাম না। ছেলেরা মনের আনন্দে বাইসাইকেল চালাত। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বাইসাইকেল চালিয়ে যেত। মাঝেমধ্যে ওদের কাছে গিয়ে বাইসাইকেল ছুঁয়ে দেখতাম। সাইকেল থেকে ওদের ওঠা–নামা দেখতাম। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় যখন আসত, তখন দূর থেকে ওদের গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঘর থেকে দৌড়ে রাস্তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। আমার চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ওদের সাইকেল চালানোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখতাম ওদের সাইকেল চালানো। চোখের আড়াল হলে মন খারাপ করে ফিরে আসতাম বাড়িতে।

আমার বয়সী ছেলেদের সাইকেল চালানো দেখে মনে হতো সাইকেল চালানো খুব সহজ। আমাদের যদি একটা সাইকেল থাকত, আমিও ওদের মতো চালিয়ে বেড়াতাম। ছেলেদের কাছে গিয়ে সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে দেখতাম। চালানো শেখার জন্য ওদের কাছে সাইকেল চাইতাম, কিন্তু কেউ আমাকে সাইকেল দিতে চাইত না। মন খারাপ করে ফিরে আসতাম। বাড়ি ফিরে মাকে বলতাম, ‘আমি সাইকেল চালানো শিখব। তুমি বাবাকে বলো আমাদের একটা সাইকেল কিনতে।’ মা বলত, ‘সাইকেল চালালে হাত-পা কেটে যায়। সাইকেল চালানো ভালো না। কোথায় কিসের সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট করবি, তা–ই নিয়ে আবার ডাক্তারখানায় দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। আর একটু বড় হ, তখন কিনে দেব।’ মায়ের কথা শুনে কান্নাকাটি করতাম। বলতাম, ‘ওরা তো সবাই আমার বয়সী?’ ‘তোর বয়সী তাতে কী হয়েছে? সব বয়সে সবকিছু করতে হয় না। ওরা সাইকেল চালালে তোরও সাইকেল চালাতে হবে, এমন কোন কথা নেই। তোর এই ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না, হাতে অনেক কাজ আছে। তোর বাবা বাড়ি ফিরে এলে বলিস সাইকেল কিনে দিতে।’

বাবার কথা বললে আমার বায়না কমে যেত। মা জানত বাবাকে আমি কখনো বলতে পারব না। সংসারের কাজে মা ব্যস্ত হয়ে পড়ত।

আমার বায়না কিছুতেই কমতে চাইত না। যতক্ষণ না বাবা বাড়িতে আসতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বায়না আর কান্নাকাটি করতাম। বাবা বাড়িতে এলে একেবারে চুপচাপ–শান্ত। বাবাকে কখনো বলার সাহস হতো না। যত বায়না করেছি সব মায়ের কাছে।

বাবাকে ভয় পেলেও খাওয়ার সময় যখন একসঙ্গে খেতে বসতাম, বাবা তাঁর থালা থেকে মাছ ভেঙে আমার থালায় দিতেন। আমার থালায় মাছ থাকত, তারপরও দিতেন। আমার থালার মাছ খেয়ে বাবার দেওয়া মাছ খেতাম। তখন বুঝতাম না কেন বাবার থালার মাছ বাবা আমাকে দিতেন! এখন ঠিকই বুঝি, বাবা নিজের থালার মাছ কেন আমায় দিতেন। বাবা নেই, তাই হয়তো বেশি বুঝি। আদর-স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন—এসবের মূল সময়ভিত্তিক রূপ পরিবর্তন হয়। যতটা শাসন করতে পারে, তার অধিক সে আদর-স্নেহ করে। গাছ একই, শাখা–প্রশাখা ভিন্ন। বাবা ছিলেন আমাদের শীতল ছায়া দেওয়া বৃক্ষ। শাখা–প্রশাখা মেলে ধরা ভালোবাসা বিলিয়ে দেওয়া বৃক্ষ।

২.
সাইকেল কেনার জন্য মা একদিন বাবাকে বললেন। প্রথমে বাবা কয়েকবার না না বলে পরে আবার রাজি হয়ে গেলেন। আমি তখন খুব খুশি। আমার বয়েসী সবাইকে বললাম আমাদের সাইকেল কিনবে। সে কি আনন্দ। আমার বয়সী যারা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেত তাদের বলতাম, ‘দেখিস সাইকেল কিনলে আমিও তোদের মতো সাইকেল চালাব।’ মাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছি কবে বাবা আমাদের সাইকেল কিনবেন। মা বলতেন, ‘আর কটা দিন দেরি কর।’ আমার দেরি আর সইত না। আমাদের সাইকেল কিনবে, সেই আনন্দে দিন কাটত।

সেই দিন দুপুরবেলা আমার সহপাঠীর সাইকেলের পেছনে বসতে গিয়ে সাইকেলে পা আটকে যায়। একজন পথচারী দেখে পা বের করে দেন। বিকেলবেলার দিকে পা ফুলে ব্যথা বাড়তে থাকে। ব্যথা সইতে না পেরে মাকে বললাম। মা আমার পায়ের অবস্থা দেখে ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে ওষুধ এনে দেয়। তিন সপ্তাহের মতো আমার খেলাধুলা বন্ধ থাকে। বাবা বাড়িতে আসার পর মা বাবাকে বললেন সাইকেলে আমার পা আটকে গিয়েছিল। বাবা মায়ের কথা শোনার পর রেগে আগুন! কেন আমি সাইকেলে উঠলাম। আমার কোনো উত্তর নেই। ভয়ে দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বাবা বললেন, ‘এখন এই অবস্থা আর সাইকেল কিনে দিলে সারা শরীর কেটে–ছিঁড়ে বাড়ি আসবি, না হয় কোনো গাড়ির নিচেই চাপা পড়ে মরে থাকবি। দরকার নেই আর সাইকেল কেনার।’ বাবার কথা শুনে সাইকেল চালানো শেখার সব শখ হারিয়ে গেলে। মনে মনে খুবই কষ্ট পেলাম। সাইকেল কিনে দেওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই। প্রায় তিন সপ্তাহ বিছানায় পড়ে রইলাম।

৩.
আমার পায়ের ব্যথা কমে গিয়েছে প্রায় এক মাস হলো। মনের মধ্যে সাইকেল চালানোর ইচ্ছাটা আগের মতো রইল। সাইকেল কিনবে কিনবে করে প্রায় কেটে গেল দুই মাস। দিন আর ফুরায় না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাইকেলের চিন্তায় সময় কাটত আমার। আমার বয়েসী ছেলেরা বিকেল হলেই আমাদের বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে আগের মতো সাইকেল চালিয়ে যেত। মন আমার মানত না। ওদের কথা শুনে আমি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতাম। ওরা আমাকে দেখে বলত, ‘তোর বাবা আর সাইকেল কিনবে না! আমরা সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের দেখবি।’ এই কথা বলে ওরা সবাই হাসত। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওদের দিকে চেয়ে থাকতাম। হাতের ওপরের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বাসায় ফিরতাম।

তখন ছিল শীতকাল। বিকেলবেলা খেলাধুলা শেষে বাসায় ফিরে দেখি উঠানের মাঝখানে সাইকেল রাখা। সাইকেল দেখে আমার চোখেমুখে সে কি আনন্দ। পৃথিবীর সব আনন্দ তখন আমাকে ঘিরে ছিল। প্রতিদিন বাবা আমাকে সাইকেল চালানো শেখাতেন। বাবার কাছে ধীরেধীরে সাইকেল চালানো শিখলাম আমি। আজ বাবা আমার বেঁচে নেই। পৃথিবীতে কোনো বাবা বেঁচে থাকে না দীর্ঘদিন। কিন্তু বাবার শিক্ষা বেঁচে থাকে। সেই শিক্ষা আদর্শ শিক্ষা। সেই শিক্ষা কোনো দিন ভোলা যায় না। বাবা কখনো প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেন না। বাবা হচ্ছেন সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার প্রশিক্ষক।

বাবা থাকলে জীবনে চলার পথে ছায়া থাকে শীতল। বাবা না থাকলে মাথার ওপর নেমে আসে প্রখর রোদের তাপ। সেই তাপদহ রোদে হাঁটা অনেক যন্ত্রণাদায়ক।