বাবার পরে

পরিবারের সঙ্গে হাবিব ভাই
পরিবারের সঙ্গে হাবিব ভাই

মানুষ জীবনে বেড়ে উঠার পথে বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসে। তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়। কখনও কখনও তাদেরকে অনুসরণ করে আবার কিছু মানুষের কর্মকান্ড জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলে যে আমরা নিজের অজান্তেই তাদের অনুকরণ করতে থাকি।

জন্মের পর থেকে এতদূর আসা পর্যন্ত আমার জীবনে মানুষদের অবদান অসীম। আমি বলি, আমি আসলে আলাদা কোন ব্যক্তি সত্ত্বা না। আমি আসলে আমার চারপাশের মানুষগুলোর সমষ্টি। আমার আশেপাশের প্ৰত্যেকটা মানুষ আমার জীবনে বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। তাই আমি বলি জীবনের সমস্ত অর্জনের কৃতিত্ত্ব এই মানুষগুলোর। আর আমার জীবনের যত খারাপ দিক, অন্ধকার দিক সেগুলো আমার নিজের ব্যক্তিগত অর্জন এবং সেগুলোর দায়ভার একান্তই আমার।

ছোটবেলা থেকেই আমার আশেপাশের মানুষ বিভিন্নভাবে আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে। একেবারে ছোটবেলার সেই খেলার সাথী বাসার কাজের ছেলে আজাদ থেকে শুরু করে এখনকার অফিসের মাইকেল মিকেলপ সবাইকেই আমি মনে রেখেছি। আমি যখন অবসর পাই তখন এই মানুষগুলো আমার হৃদয় থেকে উঠে এসে মগজে ভীড় করে। আর আমি ক্ষণিকের জন্য হলেও হারিয়ে যায় সেই সময়ে।


বাবা মায়েরা সন্তান জন্ম দেন আর তাদের প্রকৃত মানুষরূপে বড় করে তোলেন শিক্ষকেরা। এর পাশাপাশি কিছু মানুষ থাকেন যারা ছায়ার মতো আমাদের জীবনের উপর প্রভাব রাখেন। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় তার জীবনের আদর্শ কে? তাহলে তিনি বলবেন বাবা বা মায়ের কথা। আমিও তাদের ব্যাতিক্রম না তবে আমাকে যদি বলা হয় এরপর আপনি কোন মানুষটাকে আপনার জীবনের আদর্শ মানেন তাহলে আমি অবশ্যই আমাদের বাতিঘর হাবিব ভাইয়ের কথা বলবো। বাতিঘর বলতে মানুষ লেখক, বুদ্ধিজীবী বা বড় কোন মানুষকে বুঝায় যাদেরকে তারা অনুসরণ করে কিন্তু তাদের সংস্পর্শে আসতে পারে না। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা বাস্তব জীবনেই আমাদের বাতিঘরের দেখা পেয়েছিলাম এবং এখনও তাঁর ছায়াতেই আছি।

হাবিব ভাইকে নিয়ে যতই বলা হোক না কেন কম বলা হবে। উনার মাহাত্মকে বর্ণনা করতে যাওয়া মানেই আমার কাছে ধৃষ্টতা মনে হয় কারণ আমি উনার ঠিক কোনগুনের কথা বলবো। আর উনি যেসব কাজ করেছেন সেগুলো তো উনি কোন প্রকার প্রতিদানের আশা করে করেননি। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে উনাকে নিয়ে কয়েকটা গল্প বলা যাক।

আমার জীবনের প্রত্যেকটা মাইলস্টোনে উনার ছায়া আছে এবং কোন না কোনভাবে উনার স্পর্শও আছে। সেই একেবারে মাধ্যমিকের স্কুলপাঠ থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক, তারপর বুয়েট জীবন প্ৰত্যেকটাতেই উনার অবদান আছে।

হাবিব ভাইয়ের সাথে ঠিক কিভাবে পরিচয় সেটা আজ আর মনে নেই। অবশ্য কিছু মানুষের প্রভাব আমাদের জীবনে এতটাই সুদূরপ্রসারী হয় যে প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতি সেখানে নিতান্তই নগণ্য মনে হয়। মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি। স্কুলে আমি কোন প্রকার বেতন এবং ফিস না দিয়েই পড়াশোনা শেষ করেছিলাম। স্যারেরা আশায় থাকতেন হয়তোবা বছর শেষে আমি কোন টাকা পয়সা দিবো। এমনও হয়েছে বেতন এবং ফিস বাকি পড়ার কারণে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল আটকে গেছে কিন্তু তবুও আমি কোন প্রকার টাকা পয়সা দেয়নি। অবশেষে স্যারেরা আমাকে বিশেষ বিবেচনায় পরবর্তি শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে নিতেন। আর শরীফ স্যারের কল্যাণে আমি বিনামূল্যে বইও পেয়ে যেতাম। শরীফ স্যারও আমার জীবনের অন্যতম বড় বাতিঘর যিনি আমাকে পুনর্জীবন দিয়েছিলেন। কলেজে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে, বেতন, বই কেনা বাবদ বেশ টাকা পয়সা লাগবে কিন্তু আমাদের তো সেই সামর্থ্য ছিলো না। তখনই আমাদের জীবনে হাবিব ভাইয়ের আবির্ভাব।

হাবিব ভাই আমাকে একটা টিউশনি ঠিক করে দিলেন মাসিক আড়াই শ টাকা বেতনের। আমি এর আগে সর্বোচ্চ একশ টাকা বেতনের টিউশনি করিয়েছিলাম। ছাত্রী উনারই বন্ধু আবু সাঈদ টিপু ভাইয়ের ছোট বোন তান্নি। তান্নি তখন কেবল তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তো। বয়সে ছোট হলেও বুদ্ধিতে ছিলো পাকা। আমি ওর কাছ থেকে কতকিছু যে শিখেছি সেই গল্প অন্য কোন দিন। তান্নিকে পড়াতে যেয়ে একইসাথে দুটো উপকার হলো, এক আমার আর্থিকভাবে সচ্ছলতা চলে আসলো আর দুই আমি আরও একটা পরিবার পেয়ে গেলাম যারা এখন পর্যন্ত আমাদের পরিবারের অংশ। হাবিব ভাইয়ের সংস্পর্শেই উনাদের পুরো ব্যাচটার সাথে পরিচয় হলো। টিপু ভাই, হোসেন ভাই, কল্লোল ভাই, সাব্বির ভাই উনারা সবাই আমার জীবনের স্বপ্নের মানুষ। উনারা সবাই ছিলেন তখনকার দিনে কুষ্টিয়ার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র। লোকজন যেমন সিনেমার নায়ক নায়িকাকে দেখলে বিগলিত হয়ে যায় আমি এই মানুষগুলোকে দেখলে তারচেয়ে শতগুণে মুগধ হয়ে যায়। আমি আমার জীবনে কখনওই নিজেকে এই মানুষগুলোর সমতুল্য মনে করিনি। এখনও উনাদের কাছে গেলে মনে হয় আমি যেন বটবৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠা দূর্বাঘাস। উনাদের পুরো ব্যাচটার অবদান আমার জীবনে কতখানি সেই গল্পে আসছি একটু পরে।

এরপর একসময় কলেজের ক্লাস শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ তাই উচ্চমাধ্যমিক নিয়ে উনাদের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই আর মাথাব্যথা থাকলেও বেশি কিছু করার নেই কারণ সারাক্ষণই কোন না কোন গন্ডগোল লেগেই থাকে তাই স্যারদের বাসায় ব্যাচে পড়ে আমাদের সিলেবাস শেষ করতে হতো। আমি বন্ধু নাহিদের সাহায্যে পুরোনো একসেট বই কিনে ফেললাম কিন্তু প্রাইভেট পড়ার টাকা তো আমার নেই। বাসা থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক হেটে কলেজে যাই। সেইভাবেই একদিন ঘন্টাখানেক হেটে আতিয়ার স্যারের কাছে রসায়ন পড়ার জন্য হাজির হয়ে গেলাম। পড়া শেষ করে স্যারের কক্ষে যেয়ে বললামঃ স্যার আমি কিন্তু বেতন দিতে পারবো না। স্যার চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে অন্য কাজে মনোযোগ দিয়ে বললেনঃ কেন? উত্তরে আমি বললামঃ বাবার সামর্থ্য নেই। উনি বললেনঃ তুই যে সত্যি কথা বলছিস সেটা কিভাবে যাচাই করবো? আমি বললামঃ হাবিব ভাইকে জিজ্ঞেস করেন। হাবিব ভাই তখন আতিয়ার স্যারের মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতেন। জানি না এরপর স্যার হাবিব ভাইকে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন কি না। কিন্তু হাবিব ভাই ছিলেন আমাদের খুঁটি। একইভাবে অন্য স্যারদের কাছেও একই কথা বলতাম। সব স্যারই হাবিব ভাইকে চিনতেন।

উচ্চমাধ্যমিকের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে সব বন্ধুরা ঢাকায় চলে গেলো কোচিং করতে। আমি যুক্তিসংগত কারণেই যেতে পারলাম না। হাবিব ভাই বললেন, ব্যাপার না। আমি তোমাকে একটা টিউশনি ঠিক করে দিচ্ছি। ছাত্রী তোমার চেয়ে এক বছরের ছোট। এতে করে তোমার যে উপকার হবে সেটা হলো ওকে পড়াতে যেয়েই উচ্চ মাধ্যমিকের পুরো সিলেবাসটা আবার তোমার রিভিশন দেওয়া হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ঠিক এটাই দরকার। কোচিংয়ে অনেক বাড়তি জিনিস শেখায় সেগুলো আসলে ভর্তি পরীক্ষাতে তেমন একটা কাজে আসে না। তারচেয়ে পাঠ্যবই রিভিশন দেওয়া অনেক বেশি উপকারি। পাশাপাশি আমি তোমাকে সবগুলো ভর্তি পরীক্ষার জন্য আগের বছরগুলোর ভর্তি গাইডও জোগাড় করে দিবো। উনি নিজেই বেশ কয়েকটা গাইড বই দিলেন। এছাড়াও উনার বন্ধুদের কাছ থেকে পেলাম আরো বেশকিছু গাইড বই। কোচিং করতে না যেয়েও সবমিলিয়ে আমার কাছে তখন ডজনখানেক গাইড বই ছিলো।
হাবিব ভাই এবং উনার বন্ধুরা টিপু ভাই, কল্লোল ভাই, হোসেন ভাই, সাব্বির ভাই সবাই আমার স্বপ্নের মানুষ। উনাদের সাথে পরিচয় হয়েছিলো হাবিব ভাইয়ের মাধ্যমে। হাবিব ভাই ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানে, টিপু ভাই ভর্তি হলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিক্স এবং কমিউনিকেশন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, কল্লোল ভাই আর সাব্বির ভাই বুয়েটের মেকানিক্যাল আর ওয়াটার রিসোর্স ইন্জিয়ারিংয়ে। যতদূর মনে পড়ে হোসেন ভাই ভর্তি হয়েছিলেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে। অসম্ভব রকমের মেধাবী একটা প্রজন্ম ছিলেন উনারা। আর সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে উনাদের মধ্যে বিদ্যমান অকৃত্রিম আন্তরিকতা। এই একটা ব্যাপার আমাকে ভাবায়। আপনি যতবেশি পুরোনো মানুষের সাথে পরিচিত হবেন দেখবেন তাঁদের মধ্যে তখনও অনেক ভালো যোগাযোগ ছিলো এমনকি এখনও আছে। হয়তোবা তখনও উনাদের সম্পর্কগুলোর মধ্যে প্রযুক্তি ভাগ বসাতে পারেনি তাই উনাদের সম্পর্কের মাত্রা অনেক গভীর ছিলো। এমনকি আমাদের বন্ধুদের মধ্যেও বা আমাদের ছোট ভাইদের বন্ধুদর মধ্যেও এই বন্ধনটা দেখেছি কিন্তু তৎপরবর্তি প্রজন্মের মধ্যে এতটা দৃঢ় বন্ধন দেখিনি। আসলেই বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ।

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসছে। ঢাকায় যাওয়া, থাকা, ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া আমার জন্য ছিলো এক নতুন অভিজ্ঞতা। তার আগে ঢাকা শহর সেইভাবে দেখা হয়নি। এর আগে এসেছিলাম বন্ধুদের জন্য মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা দিতে। সেবারও আমার একমাত্র ভরসার নাম হাবিব ভাই। একদিন ব্যাগ নিয়ে হাবিব ভাইয়ের ফজলুল হক হলের ৪০০৭ নম্বর রুমে হাজির। উনি আমাকে নিজের বেড ছেড়ে দিয়ে পাশের রুমে রায়হান ভাইয়ের সাথে ডাবলিং করতে চলে গেলেন। রায়হান ভাইদের রুমে হিটার দিয়ে উনারা রান্না করে খেতেন। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার দিন সকালে উঠে উনাদের রুমে যেয়ে গরম গরম খিচুড়ি আর ডিমভাজি দিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। তারপর একটা রিকশা নিয়ে বুয়েটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কুষ্টিয়া ফিরে এসে দৈনন্দিন জীবনে আবারও ব্যস্ত হয়ে গেলাম। ততদিনে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে দিয়েছে। মেডিকেলের পরীক্ষাটা আমার জন্য শাঁখের করাত হয়ে দেখা দিলো। সবাই বিভিন্নভাবে ডাক্তারি পড়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করলো। এরই মধ্যে একদিন স্বাতীকে পড়াতে গেছি। তখন শিরীন ম্যাডাম বললেন, ইয়াকুব, হাবিব ফোন দিয়েছিলো। তুমি তো গতকাল আসোনি তাই বলা হয়নি। তোমার বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। তোমার মেধাক্রম ৩১৮। আমাদের ব্যাচে মোট ৭৮১ টা আসন ছিলো। এখনও যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে তোমার জীবনের স্মরণীয় দিন কোনটা। আমি অবলীলায় বলে দিই বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পাবার দিনটা।

গ্রামের খোলা মাঠে দৌড়াদৌড়ি, পুকুরে লাফালাফি, বৃষ্টিতে ভিজে, অন্যের গাছের নারিকেল জাম্বুরা চুরি করার পাশাপাশি পড়াশোনা করে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম। তাই পড়াশোনাটাকে আমাদের কাছে কখনওই বোঝা মনে হতো না। তবে পড়াশোনায় ভালো ফলাফলের করার জন্য পরিবেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলের সবচেয়ে ভালো ফলাফল নিয়েও কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ভর্তি মেধা তালিকায় আমার ক্রমিক নম্বর ছিলো ২৭০। সেই আমিই আবার যখন উচ্চমাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় মেধাতালিকায় নবম হয়েছিলাম তখন বুঝেছিলাম ভালো স্কুলের গুরুত্ব কি? আমি আমার সমগ্র জীবনে দুটো বছর ঠিকঠাক পড়াশোনা করেছিলাম সেই দুটো বছর হচ্ছে কলেজের। পড়াশোনার সমগ্র সময়টাতে আমরা যে মানুষটাকে অনুসরণ করতাম তিনি ছিলেন হাবিব ভাই। আমি যতদূর জানি হাবিব ভাই আমাদের গ্রামের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। উনার দেখানো পথেই আমরাও ঢাকাতে পড়তে যাওয়ার সাহস করেছিলাম তাই হাবিব ভাই ছিলেন আমাদের জন্য পাঞ্জেরী স্বরূপ।

বুয়েটে ভর্তির পর শুরু হলো আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়। তখন আমার মাথার উপর আবারও ছায়া হয়ে দাঁড়ালেন হাবিব ভাই। ঢাকা শহরের প্রথম টিউশনি খুঁজে দিয়েছিলেন হাবিব ভাই। আমার গা থেকে তখনও সোঁদা মাটির গন্ধ যায়নি। ভাষাটাতেও তখন পর্যন্ত কুষ্টিয়ার আঞ্চলিকতার টান। আর ততদিনে উচ্চমাধ্যমিকের বইয়ে এসেছে পরিবর্তন তাই সেই টিউশনিটা টেকেনি বেশিদিন। এরপর হাবিব ভাইয়ের বন্ধু কল্লোল ভাই একটা টিউশনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। এভাবেই ঢাকা শহরের যুদ্ধটা আমার জন্য অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিলো। আর কোনসময় কোন কিছুর দরকার হলেই উনাদের দরজায় যেয়ে কড়া নাড়তাম, জানতাম উনারা আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। আমি সবসময়ই একটা কথা বলি সেটা হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা আমার আশেপাশে সবসময়ই কিছু মানুষরুপি ফেরেস্তা পাঠিয়ে দেন যারা আমার জীবনপ্রণালীকে সহজ করে দিয়েছে সময়ে সময়ে।

হাবিব ভাই বরাবরই আমাদের গর্ব ছিলেন এখনও আছেন। হাবিব ভাই এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। উনার গিন্নী সুমিকে আমি বলি আমার ছোট বোন। উনাদের সংসার আলো করে এসেছে দুজন ফেরেশতা। হাবিব ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম কিভাবে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হয়। এই মানুষটার সাথে আমাদের আন্তরিকতা দেখে কে বলবে যে উনার সাথে আমাদের রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হবার পর দেশ থেকে অনেকেই খবর নিয়েছেন। হাবিব ভাইও ফোন দিয়েছিলেন কিন্তু সময়ের পার্থ্যকের কারণে উনার সাথে আলাপ হয়নি। আশাকরি খুব শিগগিরই আমাদের আড্ডা হবে। মানুষের স্নেহ ভালোবাসা পাওয়াটাকেই আমি জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মানি। সেইদিক দিয়ে আমি আসলেই অনেক বেশি ভাগ্যবান। নিজে পরিবারের বড় সন্তান হবার জন্য একজন বড় ভাইয়ের স্নেহ বা শাসনের অভাববোধ করতাম। হাবিব ভাই ঠিক সেই অভাবটাই পূরণ করে দিয়েছিলেন। আমি জানতাম পৃথিবীতে একজন মানুষ আছেন যার কাছে যেয়ে আমি অবলীলায় সাহায্য চাইতে পারি এবং সেই মানুষটা আমাকে কখনওই ফেরাবে না।

আমাদের জীবনে আমাদের বাবার পরে তাই হাবিব ভাইয়ের অবস্থান। যিনি বড় ভাইয়ের আদরে আমাদের আগলে রেখেছিলেন সারাজীবন। আমার পড়াশোনাটা চালিয়ে নেয়ার সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি ছিলেন হাবিব ভাই। এরপর আমার দেখানো পথে আমাদের ছোট দুভাইও যথাক্রমে কুয়েট এবং বুয়েট থেকে পাশ করে স্ব স্ব জীবিকায় প্রতিষ্ঠিত। সবাই যখন আমাদের তিনভাইয়ের অভাবনীয় সাফল্য শুনে আশ্চর্য হয় তখন আবারও আমার নতুন করে হাবিব ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায়। একজন মানুষ কিভাবে একটা পুরো পরিবারকে আলোকিত করতে পারেন হাবিব ভাই তাঁর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। হাবিব ভাইয়ের অবস্থান আমাদের পরিবারে আমাদের বাবার পরেই। বাবা হচ্ছেন আমাদের জন্মদাতা আর হাবিব হচ্ছেন আমাদের জীবনের আলোকবর্তিকা।

গত ১৯ জুন ছিলো হাবিব ভাইয়ের জন্মদিন। সবকিছু ঠিক থাকলে সামনের ডিসেম্বর মাসে দেশে ফিরে উনার সাথে দেখা হবে। আবার উনাকে আগের মতো জ্বালাতে পারব। বড় ভাইদের না জ্বালালে আবার আমার পেটের ভাত ঠিকমতো হজম হয় না। একজীবনে আমি বহু মানুষের কাছে বহুভাবে ঋণী কিন্তু কিছু কিছু ঋণ আমি শোধ করতে চাই না বরং দেনা বাড়িয়ে যেতে চাই দিনকে দিন।