কোথায় মানবতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কী বলে যে কাঁদতে হয়, সেটাও ভুলে গেছেন করিমন বেওয়া। এটা সেটা কত কী বলে সারা জীবন কেঁদেছেন, কোনো লাভ হয়নি। স্বামী মারা যাওয়ার পর যখন ছেলেদের গলগ্রহ হয়ে জীবন কাটানো শুরু হলো কান্নাই তখন তাঁর জীবনের একমাত্র সঙ্গী হলো। স্বামী যে জায়গাজমি রেখে গেছেন, তার আয় থেকে করিমনের জীবন ভালোভাবেই চলার কথা। কিন্তু এ অশীতিপর বয়সে তাঁর পক্ষে সেটা দেখভাল করা সম্ভব নয়। জায়গাজমি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। করিমন বেওয়ার ভাগের জমিসহ তাঁর ঠাঁই হয়েছে ছোট ছেলে নাসিরের সঙ্গে।

বিয়ে করার আগে নাসির ভালোভাবেই মায়ের দেখভাল করত। সে সময় করিমন রান্না করতে পারতেন। রান্নাবান্না ছাড়াও কৃষিকাজেও ছেলেকে সাহায্য করতে পারতেন। বড় দুই ছেলে এবং ছেলের বউদের সঙ্গে বনিবনা না থাকলেও সম্পর্কের তেমন বেশি টানাপোড়েন ছিল না। কিন্তু নাসিরের বিয়ের পরই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। করিমনের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলাফেরার শক্তিও কমতে থাকে। যতই তাঁর চলাফেরার শক্তি কমতে থাকে, সংসারে তাঁর গুরুত্বও ততই কমতে শুরু করল।

সংসারে আসার পর কয়েক মাস চুপচাপ ছিল নাসিরের স্ত্রী লাইজু। এরপর স্বামীকে উসকে দেয়, আরও তো দুই ছেলে আছে, শাশুড়ি কেন শুধু তাদের সঙ্গেই থাকবে?
যুক্তি দেখায় নাসির, বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রাম্য সালিশে মায়ের ভাগের জমিসহ মাকে তার সঙ্গে থাকার ব্যবস্থা করা হয় এবং সেই থেকেই মা তার সঙ্গে আছেন।
কিন্তু নাসিরের যুক্তি লাইজুর কাছে টেকে না। তার পাল্টা যুক্তি সালিসের রায় তো পরিবর্তনও করা যায়। শাশুড়ির প্রতি তার যতটা না রাগ, তার চেয়ে বেশি রাগ অন্য দুই জায়ের প্রতি। অন্য জায়েরা শাশুড়ির কোনো খবর নেয় না। তাকে একা সব করতে হবে কেন? পিতার জমির ভাগ তো সবাই সমান নিয়েছে।

সংসার থেকে শাশুড়িকে হটানোর কোনো কৌশলই যখন কাজে আসছে না, লাইজু তখন নতুন ফন্দি আঁটে। এখন ফন্দিটা কাজে এলেই হয়।
শাশুড়িকে সে এখন একেবারেই সহ্য করতে পারে না। বয়স বাড়ার কারণে শাশুড়ি এখন প্রায় অচল হয়ে পড়েছেন। মাঝেমধ্যে করিমন কাপড় নোংরা করে ফেলেন। লাইজুকেই সেসব পরিষ্কার করতে হয়। অসহ্য! বুড়িটাকে যদি ঘর থেকে তাড়ানো যেত!

জমিতে চাষ করে গরু দুটিকে পুকুরের কাছে রেখে বাড়িতে পানি খেতে এল নাসির। জমি চাষে আজ খুব খাটুনি গেছে। বেশ ক্লান্ত লাগছে তার। তবে ক্লান্তিকে পাত্তা দিলে চলবে না। রবিশস্য বোনার এটাই যে উপযুক্ত সময়। বারান্দায় চৌকির ওপর বসল নাসির। গরু দুটিকে গোসল করিয়ে, নিজে গোসল করে আসবে। এরপর দুপুরের খাবার খাবে।

রান্নাবান্না শেষ করে লাইজু বারান্দায় এল। স্বামীর চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করছে সে। হ্যাঁ, স্বামীকে এখন খুব ক্লান্ত লাগছে। কথাটা বলার এটাই মোক্ষম সময়। এখন কথাটা বললে রাজি হতে পারে। বুড়িকে একবার ঘর থেকে বের করতে পারলে হয়!

স্বামীর গা ঘেঁষে দাঁড়াল লাইজু। উপচে পড়া কৃত্রিম সোহাগ যাকে বলে। নাসিরের কোনো ভাবান্তর নেই। তার গায়ে ঘামের গন্ধ।
‘কিছু কইবা?’ লাইজুর দিকে মুখ তুলে প্রশ্ন করল নাসির।
‘কত কিছুই তো কইতে চাই। আমার কতা হুনলেই তো আপনে ফোঁস কইরা ওঠেন। কেমনে আর কইমু?’
‘কও দেহি হুনি। কী কতা আবার বানাইলা।’
‘কইছিলাম, আমি একটা সমাধান পাইছি।’

নাসির বুঝে গেছে। স্ত্রী তার মায়ের সম্পর্কেই কিছু বলবে। বেশ কিছুদিন ধরে লাইজু মায়ের সম্পর্কে তাকে কিছু বলছে না। আজ নিশ্চয়ই নতুন কোনো ফন্দি এঁটেছে।
‘কও তোমার সমাধানটা কী? আমি তো কোনো সমস্যাই দেহি না, তুমি সমাধান দেখলা কেমনে?’
‘কইছিলাম আম্মা তো বছরে চাইর মাস কইরা তিন পোলার লগে থাকতে পারে। তাইলে আমাগোও কষ্ট হয় না, কোন পোলার লগে কেমন লাগে, কে কেমন আদর–যত্নœকরে, হেইডাও জানতে পারল।’

গা জ্বালা শুরু করেছে নাসিরের। ইনিয়ে–বিনিয়ে সেই একই কথা, মাকে সংসার থেকে তাড়াতে হবে। নাসিরের ইচ্ছে করছেÑমাকে নয়, স্ত্রীকেই পারলে সে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু চাইলেই তো সব করতে পারে না। সন্তান-সংসার সব এর সঙ্গে জড়িত।

‘তোমার যদি কোনো আক্কেলজ্ঞান থাকত, মা অন্য কারও সঙ্গে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জমিটাও যে তার সঙ্গে যাইব, হেই ভাবনা তোমার আছে? দশ হাত শাড়ি তো একখান পর...। মায়ের জমি থেইক্কা যে আয় অয়, তা কি মার লাগে? আমরাই তো ভোগ করি। তোমার মা অইলে কি এমন কথা কইতে পারতা?’

গামছাটা কোমরে বেঁধে হনহন করে চলে গেল নাসির। গরু দুটিকে গোসল করাতে হবে, খাবার দিতে হবে, নিজে গোসল করবে।
শাশুড়ি অন্য ছেলেদের সঙ্গে গেলে তাঁর ভাগের জমিও যে তাদের কাছে যাবে, এ নিয়ে লাইজুর কোনো ভাবনা নেই। তার ভাবনা অন্য জাদের নিয়ে, শাশুড়ি তো তার একার না। তবে তাকে দেখভাল একা কেন করতে হবে?

বসন্তকাল চলে গেছে। গ্রীষ্মের শুরুতে গরম তেমন বেশি না পড়লেও করিমন বেওয়ার কাশিটা বেশ বেড়ে গেছে। ইদানীং শরীর একেবারেই ভালো থাকে না। ওষুধ চলছে ঠিকমতোই কিন্তু কাজ তেমন হচ্ছে না। রাতে মায়ের কাশিতে নাসিরেরও ঘুম ভেঙে যায়, ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর অভিযোগ তো আছেই। গরুর দুধ গরম করে তাতে তালমিছরি দিয়েও মাকে খাইয়েছে। কিন্তু কাশি আর কমছে না।

বিশ্বকে কাঁপিয়ে করোনাভাইরাস বাংলাদেশেও ঢুকেছে। প্রথম দিকে প্রকোপ কম থাকলেও দিন দিন বেড়েই চলেছে। বয়স্করাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয় এবং আক্রান্ত হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যু—এ রকম খবর কয়েক দিন ধরে টেলিভিশনে দেখছে লাইজু। এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাশি, জর-এমন কথাও সে জানে। শাশুড়ির কাশি রয়েছে, জ্বরও আছে; সুতরাং এসব করোনা রোগের লক্ষণ ছাড়া আর কী হতে পারে? এ রোগ অত্যন্ত ছোঁয়াচে, একজনের হলে বাড়ির সবার হতে পারে, এমন কথাও সে জানে। করোনা কি শাশুড়িকে ঘর থেকে বিদায় করে দেওয়ার নতুন সম্ভাবনা এনে দিল লাইজুকে?

মনে মনে কঠোর হলো লাইজু। এটাই একটা সুযোগ। যে করেই হোক বুড়িকে এবার ঘরছাড়া করতেই হবে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পরিষ্কার করার মতো তেমন ময়লা উঠানে নেই, তবু লাইজু ঝাঁট দিচ্ছে আর একা একা চেঁচাচ্ছে। যাতে তার বাকি দুই জা-ও শুনতে পায় ‘বাড়িতে একজন করোনা রোগী আছে, তা কি এই বাড়ির লোকেরা কেউ জানে? একজনের লাইগা যে বাড়ির সবাই মরবে, হেইডা কি কেউ জানে?’
দুই ঘরে দুই জা কান খাড়া করল। তিন জা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। আনুষ্ঠানিক ঝগড়াঝাঁটি না হলেও এটা একটা ফ্যাশনও হতে পারে।
দুই জা ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। তারা লাইজুর ঝাঁট দেওয়া দেখছে। অপূর্ব। ময়লাবিহীন উঠান ঝাঁট দেওয়ার দৃশ্য অতি মনোহর।
বড় জা একা একা শব্দ করে বলল, ‘একজনের লাইগা বাড়ির সবাই মরব কেন?’
ঝাঁট দেওয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল লাইজু। নিরঙ্কুশ সমর্থন। এমন বক্তব্যই সে আশা করেছিল। কিছু একটা ঘটাতে পারলে সমর্থন পাওয়া যাবে।
আজ রাতে করিমন বেওয়ার কাশিটা প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল। কিছুতেই কমছে না। শাশুড়ির কাশি বাড়লেই লাইজুর ভালো লাগে। স্বামীকে প্ররোচিত করার দারুণ সুযোগ পায় সে।
সন্ধ্যার পর বারান্দায় একা বসে আছে নাসির। করোনাভাইরাসের কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুল ছুটি। পড়ালেখায়ও তেমন মনোযোগ নেই কারও। নাসিরও উচ্চবাচ্য করছে না। এমন দিন আগে কেউ কখনো দেখেনি। সন্ধ্যার পর হাটে থাকা যাবে না। করোনা ধরতে পারে। তাই আগেভাগেই চলে এসেছে নাসির। হাটে বিক্রি করার জন্য নারকেল নিয়ে গিয়েছিল। বিক্রি করে মাছ নিয়ে চলে এসেছে।

বারান্দার অন্য চৌকিতে টিনের বেড়ার সঙ্গে হেলান দিয়ে জোরে জোরে কাশছে করিমন। নাসির মায়ের কাশি দেখছে, কিছু বলছে না। রান্নাঘর থেকে শাশুড়ির কাশির শব্দ শুনে বারান্দায় এল লাইজু। এসেই স্বামীকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেল।

‘আমি কইলেই তো আপনে লাফ দিয়া উঠবেন, আপনের মায়ের মনে হয় করোনা হইছে। এখন নিজে মরব, বাড়ির সবাইকে মারব।’

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল নাসিরের। করোনা!

‘তুমি জানলা কেমনে মার করোনা হইছে?’

‘করোনা রোগীরাই এমন কইরা কাশে, গায়ে জ্বর হয়। আমি আর আপনার মায়ের সেবা–যত্ন করতে পারমু না। নিজে মরমু, আমার আন্ডাবাচ্চারাও মরব। আপনার পছন্দ না হইলে আমি পোলাপান লইয়া বাপের বাড়ি চইলা যামু।’

আবছা অন্ধকারে নাসির যেন সারি সারি কয়েকটা লাশ দেখতে পেল। স্ত্রী-সন্তানসহ অনেকের। নিজের লাশটিও সে যেন দেখতে পেল চোখের সামনে। লাশ, লাশ আর লাশ। দাফন করার জন্যও কেউ আসছে না। করোনা রোগে মারা গেলে কেউ দাফন করতেও আসে না, জানাজাও পড়ে না। কী করুণ মৃত্যু! এত লাশ কে দাফন করবে? ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে নাসির।

‘ঘরে চল। রান্না শেষ কর। মাকে খাইতে দাও। তারপর...।’

নাসিরের কাঁপুনি দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গেল লাইজু। কে জানে আবার কী করে বসে? তবে তাকে যে কিছু করবে না, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। নাসিরের মধ্যে একটি অস্থিরতা লক্ষ করেছে সে।
রান্নাবান্না শেষে করিমনকে খেতে দিল লাইজু। খাওয়াদাওয়া তাঁর অনেক আগে থেকেই কমে গেছে। তবুও যা পারলেন খেলেন।
খাওয়া শেষে মায়ের কাছে এল নাসির। উদভ্রান্তের মতো বলল, ‘চলেন, আপনারে ডাক্তারের কাছে নিয়া যামু।’
ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন করিমন। কোনো কথা বললেন না।
ক্ষিপ্ত হলো নাসির। চোখ তার লাল হয়ে গেছে।
‘কী হইল? হোনলেন না আমার কতা?’
কোনো রকম দম নিয়ে করিমন বললেন, ‘এই রাইতের বেলা যামু ডাক্তারের কাছে? কাইল দিনের বেলা গেলে অইব না?’
‘না অইব না। চলেন।’

একটি হারিকেন নিল নাসির। ছেলের পেছন পেছন লাঠিতে ভর দিয়ে কোনো রকম হাঁটতে শুরু করলেন করিমন। লাইজু সব দেখছে, মুখে কিছু বলছে না। করিমন জানেন না তিনি কোন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন। পরনে যে কাপড়টি ছিল, সেটি পরেই তিনি যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর একটি ঝোপের কাছে দাঁড়াল নাসির।
‘দাঁড়াইলি কেন বাবা?’
হাত দিয়ে হারিকেনটি নিভিয়ে ফেলল নাসির।
‘থাকেন এইখানে। আর কোনো দিন বাড়িতে যাইবেন না। আপনের লাইগা আমরা সকলে মরমু নাকি?’
‘না...না...ছি...র। আমি এইখানে কেমনে থাকমু? আমারে তো পশুপাখি খাইয়া ফালাইব রে বাবা। আমারে নিয়া চল।’
চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল নাসির। অন্ধকার হলেও বাড়ির পথটি তার চেনা আছে। বাড়ির পথেই হাঁটছেন তিনি।

ঈশ্বর কোথায় থাকেন, করিমন বেওয়া তা জানেন না। সত্তর বছরের জীবনে তিনি ঈশ্বরের দেখা পাননি। আর আজ এই অন্ধকারে তাঁর দেখা পাবেন? কীভাবে যেন কাঁদতে হয়? কোনো সমস্যায় পড়লে কী বলে কাঁদতে হয়, মনে করতে পারছেন না করিমন।
মাটিতে বসে পড়লেন করিমন। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না চোখে।
আস্তে আস্তে অন্ধকার সয়ে এল চোখে। আকাশে চাঁদ আছে কি না জানেন না। কাশিটা বেড়ে গেল। ছেলে তাঁকে এখানে ফেলে গেছে, এটা তিনি ভাবতেই পারছেন না। তিনি মনে করেছেন হয়তো তাঁকে এখানে রেখে গেছে। সকালে ঠিকই এসে নিয়ে যাবে। তাঁর নাসির এমন ছেলেই নয়। জীবনে অনেক কেঁদেছেন করিমন কিন্তু আজ কাঁদবেন না। কান্না আসছে না, থেকে থেকে কেবল কাশিই আসছে।

মাটিতে শুয়ে পড়লেন করিমন। ডান হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলেন। তিনি কোথায় আছেন জানেন না। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি কোথাও আছেন, এটা বুঝতে পারছেন। কারণ, তাঁকে বেশিক্ষণ হাঁটতে হয়নি।

বাড়িতে ফিরল নাসির। স্বামীকে একা ফিরতে দেখে অবাক হলো না লাইজু। অবাক না হওয়ারই কথা। বুড়িকে ঘর থেকে তাড়াতে পারলেই সে বাঁচে। নিজের মায়ের ব্যবস্থা যা করার তার ছেলেই করেছে, লাইজু নয়।

মায়ের শূন্য বিছানার দিকে তাকাল নাসির। নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। এখন তার চোখের সামনে কেবল একটি মাত্র লাশ যেন দেখতে পাচ্ছে।

সকাল হয়ে গেল। লোকজন বাইরে বের হয়েছে। জমিতে চাষ দিচ্ছে। একটু দূরে বাড়িতে লোকজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। উঠে বসলেন করিমন। ডান হাতটা ব্যথা করছে। ঈশ্বরকে স্বরণ করলেন তিনি। তাঁর ডাইরিতে এমনটাই লিখেছেন তিনি। তা না হলে এমন কেন হবে। কাশিটা প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেল।
চারদিকে ফরসা হয়ে গেছে। এখন সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। জঙ্গলের পাশ দিয়ে সরু রাস্তা ধরে কৃষক সিরাজুল মাঠে যাচ্ছে।
ঝোপের মধ্যে মানুষের কাশি শুনে এগিয়ে যায় সিরাজুল। একি! এ যে নাসিরের মা। গতকালও নাসির আর সিরাজুল পাশাপাশি জমিতে চাষ দিয়েছে।
‘আপনি এইখানে কেন চাচি? এই জঙ্গলে আইলেন কেমন?’

কোনো রকম দম নিয়ে করিমন বলেন, ‘কাইল রাতে নাসির আমারে এইখানে রাইখা গেছে।’ আর কিছু বলতে পারছেন না করিমন। কাশি এসে সব আটকে দিয়েছে।
ঘটনা কিছুই বুঝতে পারল না সিরাজুল। তবে এটুকু বুঝেছে, করিমনকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া দরকার।
‘চলেন, চলেন বাড়িতে চলেন।’ করিমনের হাত ধরে দাঁড় করাল সিরাজুল।
‘আমার মাইয়ারে একটু খবর দিতা পারবা বাবা? আমি তোমার বাড়ি যাই?’
‘চলেন, চলেন। আমাদের বাড়িই চলেন।’

সিরাজুলের কাঁধে ভর করে সিরাজুলের বাড়ি এলেন করিমন। খবর পেয়ে বাড়ির লোকজন বের হয়ে এল। সিরাজুলের কলেজ পড়ুয়া ছেলে করিমনের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করল। শিরোনাম ছিল, ‘মানবতা কোথায়?’

এক ঘণ্টার মধ্যে কয়েক শ লাইক পড়ল। টেলিভিশনের জেলা, থানা প্রতিনিধিরা এসে করিমনের ছবি তুলল, তাঁর বক্তব্য নিল। তবু মৃত্যুপথযাত্রী করিমন একবারও ছেলেকে দোষারোপ করলেন না। তিনি শুধু বারবার বলেছেন, ছেলে তাকে এখানে রাতে রেখে গেছে। তবে সবাই যা বোঝার বুঝে গিয়েছে।

এর মধ্যেই খবর পেয়ে পাশের গ্রাম থেকে স্বামীকে নিয়ে চলে এসেছে করিমনের বড় মেয়ে রওশন। সিরাজুলের বাড়িতে এসে সব বৃত্তান্ত শুনে মাকে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকে রওশন।
‘মাকে যে রাইতের বেলা জঙ্গলে ফালাইয়া দিতে পারে, সে কেমন পুত? তোরে আমি জেলের ভাত খাওয়ামু নাসিররা। চলেন মা, আপনার জামাই রিকশা নিয়া আইছে। আপনে যে এত অশান্তিতে ছিলেন, আমারে তো কোনো দিন বলেন নাই।’

‘আমি তো অশান্তিতে ছিলাম নারে মা।’

বৃদ্ধা করিমনের মুখে এ কথা শুনে সবার চোখ বড় হয়ে গেল। হোঁচট খাওয়ার মতো থমকে গেল সবাই। বুড়ি বলে কী!