বাবা তুমি কেন সন্ধ্যাতারা

ঘটনাটা ইন্দোনেশিয়ার একটা শহরে এ বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। সহকর্মীর বোনের আর ওর বাচ্চাদের কথা। এন্ডি আর লিয়ানা ৬ আর ৭ বছরের। ওদের বাবা ডাক্তার। হেসেখেলে ভালোই চলছিল ওদের দিনকাল। কিছুদিন থেকে ওদের স্কুল হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে। করোনা না কী যেন রোগ এসেছে।

মা ওদের বাইরে খেলতে যেতেও দিচ্ছে না। ওদের বাবা কাজে যায়, বাসায় আসে না। মাঝেমধ্যে ওরা বারান্দায় দাঁড়ায়। গেটের বাইরে থেকে বাবা হাত নেড়ে চলে যায়।

বাবা কেন বেড়াতে নিয়ে যায় না? ওদের ছোট্ট মনে অনেক প্রশ্ন। গতকাল বাবাকে দেখেছিল, দূর থেকেও মনে হচ্ছিল বাবা অনেক ক্লান্ত। আজকে ওরা মাকে সারা দিন কাঁদতে দেখেছে। বাবা অনেক অসুস্থ। ওরা কেন বাবাকে দেখতে যেতে পারবে না, মাকে অনেকবার প্রশ্ন করেও এর কোনো উত্তর পায়নি। পরদিন দুই ভাই-বোন ঘুম থেকে উঠে দেখল ওদের মা নিচে শুয়ে কাঁদছে। জানল ওদের বাবা আর কোনো দিন আসবে না। আকাশের তারা হয়ে গেছে। ওরা সারা দিনে বাসার আশপাশে কাউকে দেখল না, খিদায় পানি খেল বারবার। মা কেমন যেন হয়ে গেছেন। ওদের দেখলেও চেনেন না। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদল ‘বাবা তুমি তারা হয়ে গেলে কেন? কেন আমাদের কাছে থাকলে না? আমাদের খেতে দিতে এখন। ও বাবা, ফিরে এসো।’ অবুঝ শিশুদের কান্না কারও কানে যায়নি।

ডা. আবদুর রকিব খান। গরিবের ডাক্তার নামে পরিচিত ছিলেন। রাইসা ক্লিনিক আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ছিলেন। কোভিড-১৯-এর ভয়াবহ সময়ে খোলা রেখেছিলেন রোগীদের সেবা। মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে মহামারির সময় পাশে না থাকলে চলবে? তারপর সেই ভয়াল রাত এল। বাচ্চা হতে গিয়ে রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না প্রসূতির। তাড়াতাড়ি খুলনা মেডিকেলে পাঠানো হলো তাঁকে। প্রসূতির অবস্থা খারাপ হতে লাগল, তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। পথে মারা গেলেন তিনি। প্রসূতির লোকজন চলে গেলেন রাইসা ক্লিনিকে। এক সাগর ভরা ভালোবাসা নিয়ে কী এক বিশ্বাসে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার রকিব। খালি হাতে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো তাঁকে। তাঁর ছেলেমেয়ে শুনলেন কি মর্মান্তিক মৃত্যু তিনি বরণ করেছেন। তাঁদের প্রশ্ন তাঁরা তাঁদের ফেরেশতার মতো বাবাকে ছাড়া কীভাবে এত বড় জীবন পার করবেন? তাঁদের মাথার ওপর ছায়া সরিয়ে নেওয়ার মতো এত দুঃসাহস কার?

ফারহানা আহমেদ লিসা।
ফারহানা আহমেদ লিসা।

ঢাল-তলোয়ারহীন ডাক্তার সমাজ সাধ্যমতো চেষ্টা করছে এ মহামারি মোকাবিলার। ওঁদের বাঁচতে দিন। এত বড় অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করুন। একবুক ভালোবাসা, নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সেবা করার প্রত্যয়ী এঁরা সম্মুখসমরে এমনিতেই চলে যাচ্ছেন অকালে। মানসিক শক্তিটুকু এ বিপদে নিঃশেষ করে দেবেন না। আইনের আশ্রয় নিন প্রয়োজনে কিন্তু মেরে ফেলবেন না। এ বিপদে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে যে যে ভাবে পারি। এতজন প্রবাদতুল্য চিকিৎসক অকালে চলে গেলেন। আমরা শঙ্কিত। কারও মাথার ওপর ছায়া সরিয়ে নেবেন না। সত্য আর ন্যায়ের পথে পুরো পৃথিবী একাত্মতা ঘোষণা করেছে।

হাজার বছর বেঁচে থাকুন সৎ-পরোপকারী আলোর দিশারি পৃথিবীর সব বাবা। এত কষ্টের বাবা দিবস আর কখনো যেন না আসে।