নতুন অসাধারণ অধ্যায়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

পূর্ব অধ্যায়
এক.
‘আদর্শলিপি’র সঙ্গে পরিচয় সেই ছোটবেলায়। এখনো মনে আছে, মায়ের শিখিয়ে দেওয়া দুটি লাইন, ‘ছোট ছোট দোষ যদি করো হে খোকন, তাও তুমি কোনো দিন করো না গোপন।’ এই লাইন দুটি মুখস্থ করে শিশু শ্রেণিতে আমার প্রথম পদার্পণ। আদর্শলিপির সেই ছবিতে প্রথম দেখা খোকনের প্রতি আমার ছিল ভিন্ন রকমের অনুভূতি। শিশু মনের কল্পনা ‘সেই খোকন’কেই ধরে রেখেছিল, যে মায়ের সব কথা শুনে আর কোনো অন্যায় করে না। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকলাম আর ‘সেই খোকন’কেই খুঁজতে লাগলাম।

দুই.
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পণ্ডিতমশাই’–এর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আমি যখন মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ি। পণ্ডিতমশাইয়ের কথা আমাকে খুব আপ্লুত করেছিল। তিনি বলেছিলেন, তাঁর পাঠশালার সব ছেলেকে যে মানুষ হতে হবে তা নয়, যদি একজনও জ্ঞানের আলো পায়, সত্যের সন্ধানী হয়, তবেই তাঁর স্বপ্ন সফল হবে। সেই একজন আলোকিত মানুষই আরেকজনকে আলোর পথ দেখাবে, এভাবেই একজন একজন করে সবাই আলোকিত হবে। আর একসময় অন্ধকার বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু এই আলো জ্বালানোর কাজটা কোনো একজনকে শুরু করতে হবে। আমার কল্পনার ‘সেই খোকনকে’ আমি পাঠিয়ে দিলাম পণ্ডিতমশাইয়ের পাঠশালা থেকে দীক্ষা নিতে, দৃঢ় বিশ্বাস এই খোকনই পারবে আলোর পথ দেখাতে।

তিন.
বড় হতে থাকলাম, আর ক্রমে ক্রমে আমার সম্মুখে বিশাল পৃথিবী উন্মুক্ত হতে লাগল। ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের’ বই পড়ে আর ‘অধ্যয়নের’ সঙ্গে যুক্ত থেকে জানলাম ‘কথা’ বলার অর্থ কী; ভাষাকে কখন ‘কথায়’ রূপ দিতে হয়। অন্যায় সে যত ছোটই হোক, যে মানুষ হয় সে কথা বলবেই, তাঁর ভাষা তাকে কথা বলাবেই। আমি প্রতিনিয়ত কথার মালার সাজাতে থাকলাম। আমার শিক্ষক একদিন এসে বললেন, তোমাকে একটা লেখা দিতে হবে। তুমি যেকোনোভাবে লিখতে পারো, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশিদের জীবনের সংগ্রামের আর প্রতিবাদের কথা থাকতে হবে তোমার লেখনীতে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ— এই সব আমাদের অহংকার, জীবনের অনিবার্য প্রতিবাদ, যা জেনেছি ইতিহাসের পাতা থেকে। পরবর্তী সময়ে যে অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি আর স্বৈরাচারিতা প্রতিনিয়ত হতে দেখেছি, সে সময়কে তো আমি জানি সবচেয়ে ভালো করে! তাই আমার বর্ণমালা দিয়ে প্রথম প্রতিবাদের ভাষায় রচনা করি, ‘সেই ছেলেটি’, যে গণতন্ত্রের এক যোদ্ধা হয়ে আলোর মশাল হাতে নিয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই ছেলেটি আর কেউ নয়, কল্পনার আদর্শলিপির ‘সেই খোকন’, যে পণ্ডিতমশাইয়ের পাঠশালায় পড়ে নিজেকে জাগাতে চেষ্টা করেছিল।

এরপর বহুদিন চলে গেছে। সময়ের স্রোতে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি। জীবনের প্রয়োজনে নানা চড়াই–উতরাই পার করি। কখনো কাজের ফাঁকে বা অবচেতন মনে, জীবনে চলার পথে চারপাশের মানুষের মধ্যে সেই বেড়ে ওঠা খোকনকে খুঁজি। হঠাৎ একদিন ‘সেই ছেলেটি’র মতো একজনকে খুঁজে পেয়ে যাই, তিনি হলেন ‘বরুণ বিশ্বাস’। যিনি পণ্ডিতমশাইয়ের মতো আলো জ্বালানোর কাজটা শুরু করে ছিলেন, কিন্তু যার মূল্য তাঁকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য। নারীর মূল্য প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতিবাজ শাসক শ্রেণির নির্যাতন-নিপীড়নের দমনের জন্য লড়াই করে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। শুধু আদর্শলিপির বর্ণ, ভাষা আর কথা দিয়ে নয়, প্রাণের বিনিময়ে বলে গিয়েছিলেন তাঁর আলোর মশালটা যেন আরেক ‘বরুণ বিশ্বাস’ তুলে নেয়।

আলোর মশালটা কীভাবে বা কখন হাত বদল করে, আমার জানা নেই। কখনো মনে হয় এই তো দেখছি, আবার কখনো মনে হয় হারিয়ে ফেলেছি। সত্যিকার অর্থে আমি বা আমার চারপাশে যাদের সব সময় পেয়েছি, সেই আমি বা আমরা সবকিছুর সঙ্গে যেন কেমন আপস করে চলছি। আমাদের ভাষা কেন যেন ‘কথা’ হয়ে ওঠে না। নেতৃত্ব দিয়ে যোগ্য নেতা হয়ে উঠতে পারে না। এভাবেই যা গতানুগতিক, তাই রয়ে যায় নতুন গড়ার সাহসের অভাবে।

অন্য অধ্যায়...

মিথ্যা, অন্যায় আর অপকর্ম আমাদের জীবন থেকে সহজে চলে যায় না। তাই আমাদের কর্মের ধারাবাহিকতায় এখন আরেক অধ্যায়ের মুখোমুখি আমরা। অন্য রকম এক যুদ্ধ করছি। আমাদের এই যুদ্ধ, সৃষ্টিকর্তার এক অতি ক্ষুদ্র ভাইরাসের সঙ্গে, যে আমাদের জাগরণ ঘটাতে এসেছে। আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমরা আসলে সবাই একই লক্ষ্যে, এক হতে পারি। আমরা সবাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে কাজ করতে জানি মহামারি থেকে মুক্তির জন্য, ভাইরাসকে পরাজিত করার জন্য। আমরা অন্যায়, মিথ্যাচারিতা, আর জাগতিক বিলাসিতাকে আমাদের জীবন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। আমরা একই সঙ্গে সবাই উত্তরণের পথে চলতে জানি। যুদ্ধ শুধু ভাইরাসের সঙ্গে নয়, এ যুদ্ধ আত্মশুদ্ধির অভিপ্রায়ে।

আমি একজন গবেষক। একজন আশাবাদী মানুষ। একজন স্বপ্নচারী ও শুভাকাঙ্ক্ষী মা। তাই আমি আমার সন্তানকে আদর্শলিপির বাণী ‘ছোট ছোট দোষ যদি করো হে খোকন, তাও তুমি কোনো দিন করো না গোপন’, শুধু শেখাতে চাই না। দোষের কোনো ছোট আর বড় নেই। খোকনকে বুঝতে হবে অন্যায়, সে যেমনই এ হোক না কেন, তার সঙ্গে কোনো আপস নয়। আমি তাকে নতুনভাবে শেখাতে চাই ‘যেথায় যত দোষ দেখো হে খোকন, ভেঙেচুরে গড়ো তুমি নতুন ভুবন’। আমি পণ্ডিতমশাইয়ের মতো একজন একজন করে আলোকিত মানুষ হওয়ার কথা বলতে চাই না, আমি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে আলোকিত হওয়ার কথা বলতে চাই। আলোর পথে একসঙ্গে না চললে, ভাষা কখনো ‘কথা’ হতে পারে না, মানুষের হৃদয়কে ছুঁতে পারে না। নেতার কথা কেউ বুঝতে পারে না, তাকে যোগ্য নেতা হয়ে গড়ে ওঠার সুযোগ দেয় না। তাই আমি শুধু একজন ‘বরুণ বিশ্বাস’কে নয়, বরং অনেক ‘বরুণ বিশ্বাস’কে খুঁজে নিতে চাই। আমি কেবল ‘সেই ছেলেটির’ গল্প লিখতে চাই না, আমি আলোকিত অনেকের কথা একসঙ্গে বলতে চাই।

বর্ণবাদের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে আজও বিলীন হয়নি। আমরা লড়ছি একই সঙ্গে মরণঘাতী ভাইরাস আর বর্ণবাদ মহামারির সঙ্গে। যাঁরা এ লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ সৈনিক, তাঁদের সবারই হাতে আজ আলোর মশাল। আমি একই সঙ্গে সেই সব যোদ্ধাকে জয়ের মালা দিয়ে বরণ করতে চাই, যাঁরা ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের জন্য আমরণ কষ্ট করছেন, তৃণমূল থেকে সর্বস্তরে। আমি তাঁদের সবার সাফল্যের কথা বলতে চাই। আমি সামগ্রিকভাবে সর্বস্তরের মানুষের ‘নতুন সাধারণকে’ জয়ের কথা জানাতে চাই। আর এই জয়ে যে জাগরণ হবে, তা নিশ্চয়ই নিয়ে আসবে এক ‘নতুন অসাধারণ অধ্যায়’। আমি নতুন প্রজন্মের জন্য ‘নতুন অসাধারণ অধ্যায়’–এর সূচনার কথা গাঁথতে চাই।

* ড. ফারহানা রুনা, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]