থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-১৩

প্রকৃতি আমাদের রক্ষা করে। ছবি: লেখক
প্রকৃতি আমাদের রক্ষা করে। ছবি: লেখক

কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারি না। গান শুনব? কেন জানি মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। বই পড়ব ধৈর্য থাকে না। কোনো ভালো ছবি দেখব, তা–ও ভালো লাগে না। শুধু একটা জায়গায় এলেই মন একটু স্বস্তি পায়, তা হলো আমার লাগানো গাছগাছালি।

কী এক অদ্ভুত কারণে বাসার ভেতরে রাখা গাছপালাগুলোকে দেখলে মনটা ভালো হয়ে যাচ্ছে। ওদের চকচকে সবুজ পাতার স্নিগ্ধতা মনকে দ্রবীভূত করে। নতুন কিছু চারা বুনলাম। মাটি ছানতে গিয়ে টের পেলাম এ এক অদ্ভুত থেরাপি। ভেতরের চাপা অস্থিরতা আস্তে আস্তে কেমন করে আঙুলের ডগা দিয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। ভীষণ ভালো বোধ করছি। মন শান্ত হচ্ছে। এই কালো মাটি, নোংরা পানি আর নতুন প্রাণের আশা কী দারুণভাবেই না মনকে গভীর আনন্দময় চেতনায় নিয়ে যাচ্ছে। করোনাকাল না এলে বুঝতাম না কাদামাটির সেনসরি যে এত ভালো থেরাপি মনের প্রশান্তির জন্য।

আজ সারা দিন বাসায় বসে গাছগুলোর যত্ন করলাম। গোড়ার মাটি খুন্তি দিয়ে খুঁচিয়ে দিলাম। মরা পাতা কেটে দিয়ে ফেলে দিলাম। পানি দিলাম অনেক যত্ন করে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিলাম পাতাগুলোকে। কথা বললাম ওদের সঙ্গে।
কেমন আছ গো তোমরা?
ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? ফিসফিসিয়ে বলল ওরা।
ভীষণ অস্থির লাগে।
তাই বুঝি? আমাদের মন ভীষণ ভালো।
কেন বলো তো? একটু অবাকই হলাম।
তুমি ঘরে আছ যে, এ কারণে। কত যত্ন করছ আমাদের। কী সুন্দর করে হাসো আমাদের দিকে তাকিয়ে।
হাসি বুঝি? তোমাদের সবুজ দেখলে, ঝকঝকে দেখলে মন ভালো লাগে।
তাই বুঝি? তাহলে গান শোন।

ঘরে মধ্য গাছগাছালি। ছবি: লেখক
ঘরে মধ্য গাছগাছালি। ছবি: লেখক

এরপর ওরা গান গাইতে লাগল। ভীষণ মিষ্টি সে গান। আমি সোফার কোনায় বসে তাদের সেই গান অনুভব করতে লাগলাম। প্রকৃতিই তো সব। প্রকৃতিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। মন শান্ত করে, জীবনের সব প্রয়োজনীয়তাই পূরণ করে। কিন্তু আমরা স্বার্থপর মানুষেরা প্রকৃতিকে যা ইচ্ছে তাই করে ধ্বংস করে দিচ্ছি। আজ প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিল। কোনো এক বাদুড় প্যাংগালিনকে ভাইরাসটা দিল। আর সেই বন্য প্রাণী থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে মানুষের মধ্যে। কারণ বন্য প্রাণীকে খাঁচায় পুড়ে বিক্রি করে, তা দিয়ে রসনাকে তৃপ্তি করে মানুষ। আমরা যা পাব সব খেয়ে ফেলব। এই খাওয়াই যেন জীবনের সবকিছু। এখন করোনাভাইরাস যখন আমাদের খেয়ে ফেলছে, শুধু অসহায় হয়ে এখন আমাদের গৃহবন্দী, কোয়ারেন্টিন জীবন। এরপর কি মানুষ আবার সচেতন হবে? ভালোবাসবে প্রকৃতিকে? আগলে রাখবে যেমন করে ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখে?

এরপর আবার যদি সবাই কৃষক হয়ে যায়, গাছ লাগায়, সবজি বাগান করে। বনের পশু-পাখি না মেরে ভেজেটারিয়ান হয়ে যায়। বন, পাহাড় না কেটে ছোট্ট ঘরে বসত বানায়। আবার নতুন পৃথিবীতে সবাই অনেক মানবিক হবে? মানুষ শুধু ভালোবাসতে জানবে, ঘৃণা নয়।

কী অদ্ভুতভাবে বাতাসে দূষণ বন্ধ হওয়ার পর আকাশ আবার মায়ের নীল শাড়ির আঁচলের মতো মায়াময় নীলাকাশে রূপান্তরিত হয়েছে। সমুদ্রে ডলফিনেরা আনন্দে নৃত্য করছে। বনের পশু-পাখিরা অবারিত আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখিরা গানের সুরে সুরে আকাশে-বাতাসে আলোড়ন তুলছে।

যত্নে ঘরের গাছগুলোর জীবন্ত থাকে। ছবি: লেখক
যত্নে ঘরের গাছগুলোর জীবন্ত থাকে। ছবি: লেখক

পৃথিবী বলছে থামো মানুষ। এবার ভাবার বিষয়। আর কত ধ্বংস করবে আমাকে? আমরা ধ্বংস করছি পৃথিবী, অথচ আমরা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতি কত যত্ন করে টিকিয়ে রাখে আমাদের। অথচ স্বার্থপর মানুষেরা সেই বন-বাদাড় কেটে ধ্বংস করছি। থাকার জন্য আলো ঝলমল শহর বানাচ্ছি। দামি আসবাব বানাচ্ছি। মাটি খুঁড়ে বের করছি গ্যাস, খনিজ। রান্না করে, পুড়িয়ে খাচ্ছি প্রকৃতির প্রাণিকুলকে। শুধু প্রকৃতিকে ভোগ আর ভোগ। লুটেরাদের মতো লুটেপুটে সবকিছুই নিঃশেষ করে দিচ্ছি। বন–পাহাড় কাটার ফলে বরফ গলে গলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। পশু-পাখিরা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। শুধু নিজের কথাই ভাবে মানুষ, অন্য জীববৈচিত্র্যের কথা ভাবে না। শুধু নিজেদের আনন্দ, আরাম, আর স্বাচ্ছন্দ্যের কথাই ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলাতেও স্বার্থপর মানুষের কোনো বিকার নেই। অথচ পরমাণু বোমায় কত অর্থ খরচ হচ্ছে। পরমাণু বোমা বানিয়ে পৃথিবীর প্রাণ ধ্বংস করছে মানুষেরা, অথচ নতুন প্রাণের দ্বার উন্মোচন করতে তাদের কি প্রচণ্ড অনীহা। মানুষ ধ্বংসের মহাযজ্ঞে সৃষ্টির আনন্দকে তুচ্ছ করে কি এক আত্মঘাতী খেলায় মেতেছে। আর সে ধ্বংসের খেলায় চুপিসারে ঠুকে পড়েছে করোনা নামের মহামারি।

এই করোনা চরিত্র পরিবর্তন করে। কারণ সে টিকে থাকতে চায়, প্রতিশোধ নিতে চায়। যখন কষ্ট, অত্যাচার সহ্য করে প্রকৃতি অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে, তখন এমন নিষ্ঠুর আর হিংসাত্মক রূপই ধারণ করে বোধ হয়। তার ভয়ানক ছোবলে ঢলে পড়ে প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান জাতি।

নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি ধ্বংস করে ডেকে আনে বিপদ। ছবি: লেখক
নিজেদের প্রয়োজনে মানুষ প্রকৃতি ধ্বংস করে ডেকে আনে বিপদ। ছবি: লেখক

লখিন্দরের শোয়ার ঘরে যে সুচের মতো ক্ষুদ্র ছিদ্র গলে ঠুকে পড়েছিল বিষধর সাপ তেমনি সবার অলক্ষ্যে অদেখা ভয়ংকর জীবাণু ঠুকে যাচ্ছে আমাদের শরীরে। এই চরিত্র পরিবর্তনের খেলায় বারবার হার মানছে মানুষ। মানুষ এত কিছু আবিষ্কার করছে, কিন্তু এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছে। মানুষের যদি বোধোদয় না হয় তাহলে প্রকৃতি আরও নিষ্ঠুর হবে। ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাবে মানবজাতি। ইউরোপ, আমেরিকা কানাডার মতো উন্নত দেশগুলোরও প্রকৃতিকে রক্ষার কাজের চেয়ে যুদ্ধাস্ত্র বানানোর ফান্ড বেশি। তবে তরুণ প্রজন্ম এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা এই মহাবিশ্বের জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা বুঝতে পারছে এই পৃথিবীকে যত্ন না করলে তারা মহাদুর্যোগে পড়বে। তাদের মতো যদি শুভ বুদ্ধির উদয় হয় বিশ্বনেতাদেরও।

যে যাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে যতটুকু পারি নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখি। আসুন না প্লাস্টিকসামগ্রী ত্যাগ করি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জামাকাপড় না কিনি। অপ্রয়োজনে গাড়ি না চড়ি, হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে কাজগুলো সারি। বাড়ির আঙিনায় বারান্দায় কয়েকটা গাছ বুনি। এ রকম ছোটখাটো কিছু কাজই তো অনেক বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বজ্রপাত পড়ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি সবকিছু ধুয়েমুছে দিচ্ছে। আমার লাগানো চারা গাছগুলো ডুবছে পানিতে। স্নাত হচ্ছে। ঠিক যেন আবার নতুন স্নাত পৃথিবীর সবুজ মায়ামাখা সজীবতার উদ্ভাস ঘটবে। সুন্দর ভালোবাসা ময়, পরিচ্ছন্ন পৃথিবী। যেখানে মানবিক মানুষেরা প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসবে। উজাড় করে দেবে তাদের জ্ঞান, মেধা প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যের উন্নয়নে। চলবে...