থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে বিবেকানন্দ কটেজে একদিন

থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে স্বামী বিবেকানন্দ, জুলাই, ১৮৯৫। ছবি: সংগৃহীত
থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে স্বামী বিবেকানন্দ, জুলাই, ১৮৯৫। ছবি: সংগৃহীত

স্বামী বিবেকানন্দ (১২ জানুয়ারি ১৮৬৩-৪ জুলাই ১৯০২) ছিলেন একজন বাঙালি সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সাধক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রধান শিষ্য।

স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আর্ট ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত ‘পার্লামেন্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়ন’ সভায় বৈদান্তিক হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করেন ও বিভিন্ন শহর যেমন শিকাগো, বোস্টন, ডেট্রয়েট, সান ফ্রান্সিসকো, লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্কে তা প্রচার করেন। দীপ্তময় ৩০ বছর বয়সী এই তরুণ সভায় বক্তৃতা করে সবার নজর কাড়েন। পত্রিকার শিরোনাম হন।

বাঙালি এক নক্ষত্র জ্বলজ্বল করে ওঠে সত্যের আলো ছড়ায় পাশ্চাত্যের আকাশে। তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের ‘যত মত, তত পথ’ মন্ত্রকে মাথায় রেখে যুক্তিবাদী স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তী চার বছর পশ্চিমা বিশ্ব ভ্রমণ করে যুক্তির মাধ্যমে হিন্দুধর্ম তথা বিশ্বধর্মের কথা বলেন এবং সব ধর্মের সর্বজনীনতা সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করেন। সব নদী তাদের নিজস্ব পথ দিয়ে যায় আর মিশে একই সাগরে—তাঁর এই জীবনাদর্শ, পাণ্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব, সন্ন্যাস, পবিত্রতা, বাকসৌন্দর্য, সৌম্যকান্তি, গভীর দৃষ্টি, স্পষ্টবাদিতার কারণে শ্বেতাঙ্গদের মাঝে প্রিয় হয়ে ওঠেন। ‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি’—তাঁর বিশ্বধর্মের এই মর্মবাণী সবার কাছেই গ্রহণীয়তা পায়।

যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক দীর্ঘ বক্তৃতার অধিবেশন শেষে ক্লান্ত হয়ে পড়া স্বামী বিবেকানন্দের মন খুঁজেছিল একটি শান্ত পরিবেশ। থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্ক বা সহস্র দ্বীপোদ্যান। কিংস্টন শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে কানাডার সীমান্ত পেরিয়ে সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে (নিউইয়র্ক শহর থেকে প্রায় ৫৩০ কিলোমিটার দূরে) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলেসলি দ্বীপে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম। সেই গ্রামে স্বামীজির শিষ্য এলিজাবেথ ডাচারের একটি কটেজ ছিল। কোলাহল ও লোকালয় থেকে দূরে একান্তে থাকার, ধ্যান করার, মনকে কেন্দ্রীভূত করার একটি অতুলনীয় পরিবেশে একটি বাসস্থান। এলিজাবেথ তাঁর সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে বনের ধারে এক পাহাড়ের ওপর নির্মিত কটেজে স্বামীজিকে আমন্ত্রণ জানালেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৫ সালের ১৮ জুন সুনির্বাচিত দশজন শিষ্যকে নিয়ে কটেজে আসেন। ২০ জুলাই ভগিনী ক্রিস্টিন (Christina Greenstidel) এবং মিসেস এম সি ফাঙ্কি স্বামীজির খোঁজ করতে করতে ডেট্রয়েট থেকে অন্ধকারময় রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে কটেজে এসেছিলেন। এই ১২ শিষ্যকে নিয়ে ৭ আগস্ট পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। তিনি তাঁদের শেখান ধর্মসাধনার নিগুঢ় পদ্ধতি। সেখানে তিনি নিয়মিত লেকচার দিতেন ও সনাতন ধর্মের আদি গ্রন্থ যেমন শ্রীমদভগবদ গীতা, বেদ, উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র, নারদ ভক্তিসূত্র প্রভৃতির ব্যাখ্যা করেছিলেন। স্বামীজি প্রথম দিনের লেকচারটি শুরু করছিলেন যিশুর জীবন ও বানী দিয়ে। ‘ঈশ্বর এক’ এবং আমরা সবাই ‘অমৃতের সন্তান’—এ সত্যটি তিনি বৈদিক শাস্ত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্লেষণ করেন এবং তাঁদের মাঝে শৌর্য, ভক্তি, মুক্তি ও সাহস জাগিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন। স্বামীজি সাধারণত প্রতিদিন প্রায় দুই ঘণ্টা লেকচার দিতেন। তবে কখনো কখনো লেকচার দেওয়ার সময় তাঁর সময়ের হিসাব থাকত না। জোছনা ভরা এক অপূর্ব সুন্দর রাতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি সারা রাত কথা বলে চলেছিলেন। এত শান্ত, এত নিবিড় আর আধ্যাত্মিকতায় এত পূর্ণ ছিল, সে সময় কোনো শিষ্যই একবারের জন্যও স্বামীজিকে থামতে বলতে পারেনি। একজন শিষ্য লিখেছেন, ‘একজন পিতা যেমন করে তাঁর সন্তানদের লালনপালন করে ঠিক তেমনি স্বামীজি আমাদের লালনপালন করতেন, যদিও আমাদের অনেকেই তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিলাম।’ লেকচার শেষ হওয়ার পর বলতেন, ‘আমি এখন তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করতে যাব’ বলে চলে যেতেন রান্নাঘরে আর শিষ্যদের জন্য তৈরি করতেন ভারতীয় খাবার। তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলতে বলতে কখনো কখনো অশ্রুসিক্ত হতো স্বামীজির চোখ। তাঁর অন্য একজন শিষ্য স্বামীজিকে বলেছিলেন, ‘We have come to you just as we would go to Jesus if he were still on the earth and ask him to teach us।’


কটেজে থাকাকালীন স্বামীজির লেকচারগুলো তাঁর শিষ্য সারা এলেন ওয়াল্ডো (Sara Ellen Waldo যাঁকে তিনি হরিদাসী বলে ডাকতেন) একটি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেন। সেই অমূল্য লেকচারগুলো ১৯০৯ সালে স্বামীজির মৃত্যুর সাত বছর পর ‘Inspired Talks’ নামে বই আকারে রামকৃষ্ণ মিশন, মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) থেকে প্রকাশিত হয়। পরে বাংলা অনুবাদ ‘দেববাণী’ নামে প্রকাশ করে উদ্বোধন কার্যালয়, যা কিনা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা বইয়ের চতুর্থ খণ্ডে সংকলিত। সারা এলেন ওয়াল্ডো স্মৃতিচারণা করে লিখেছিলেন, ‘এই স্বর্গরাজ্যে আমরা আচার্যদেবের সহিত সাতটি সপ্তাহ দিব্যানন্দে তাঁহার অতীন্দ্রিয় রাজ্যের বার্তাসমন্বিত অপূর্ব রচনাবলি শ্রবণ করিতে করিতে অতিবাহিত করিয়াছিলাম।... প্রাতঃকাল হইতে রাত্রি পর্যন্ত সেই একই ভাব, আমরা এক ঘনীভূত ধর্মভাবের রাজ্যে বাস করিতাম।’

স্বামীজির বাণী ‘মানুষের অন্তরে যে দেবত্ব আছে, তাঁকে জাগিয়ে তোলাই মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠ ধর্ম’ অনুধাবন করে তাঁরা মানবকল্যাণে নিজেদের সমর্পিত করেন। বলা বাহুল্য, থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে থাকাকালীন অবস্থায় এই বারোজন শিষ্যের মধ্যে পাঁচজন পাশ্চাত্ত্য শিষ্যকে ব্রহ্মচর্য এবং দুজন পাশ্চাত্য শিষ্যকে সন্ন্যাস প্রদান করেছিলেন। জুলাই মাসের একদিন ত্যাগমাহাত্ম্য প্রসঙ্গে গৈরিকবসনধারী যতিগণের আনন্দ ও স্বাধীনতার বর্ণনা করতে করতে হঠাৎ তাঁর কক্ষে চলে যান আর কিছুক্ষণ পর ফিরে আসেন তেরো স্তবকের ‘The Song of Sannyasin’ বা ‘সন্ন্যাসীর গীতি’ নামের কবিতাটি সঙ্গে নিয়ে। এই কবিতায় তিনি সন্ন্যাস এবং সন্ন্যাসজীবনের আদর্শকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। কবিতাটির একটি স্তবক হলো,
‘There is but One – The Free, The Knower – Self!
Without a name, without a form or stain.
In him is Maya, dreaming all this dream.
The Witness, He appears as nature, soul.
Know thou art That, Sannyasin bold! Say –
'Om tat sat, Om!’
তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে চিকাগো বক্তৃতা, কর্মযোগ, রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে বেদান্ত, ভারতে বিবেকানন্দ, ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, বীরবাণী (কবিতা-সংকলন), মদীয় আচার্যদেব উল্লেখযোগ্য।


থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কের এই কটেজটি পরে ‘বিবেকানন্দ কটেজ’ নাম দেওয়া হয়। এখানে থাকাকালীন স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একজন বন্ধুর কাছে লিখেছিলেন: ‘I am free, my bonds are cut, what do I care whether this body goes or does not go? I have a truth to teach—I am a child of God. And He that gave me truth will send me fellow workers from the earth's bravest and best.’ (Vivekananda a Biography, 1953, P. 105-106)।


২০১৫ সালে আমরা পরিবারসহ কানাডার কিংস্টন শহর থেকে ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিবেকানন্দ কটেজটি দর্শনে গিয়েছিলাম। কানাডার সীমান্ত পেরিয়ে সেন্ট লরেন্স নদীর পাশ ঘেঁষে যাওয়া পথটি ধরে চলে গেলাম কটেজের ড্রাইভওয়েতে। বাড়িটির উত্তর দিকে সেন্ট লরেন্সের সুনীল জলরাশি আর দক্ষিণে শিলাময় সবুজ বনভূমি। বড় বড় গাছের ছায়াময় কটেজের মনোরম শান্ত পরিবেশ নিমেষেই আমাদের মুগ্ধ করল। ড্রাইভওয়ে থেকে কয়েক ফুট ওপরে চমৎকার একটি ফুলের বাগান যেখানে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল, ছোটাছুটি করে খেলা করছে কয়েকটি স্কুয়ারল আর চিপমাঙ্ক। কয়েকটি সিঁড়ি ধরে উঠে গেলাম বারান্দায়। বারান্দার সামনে একটি বিশালাকার পাথর যেখানে দর্শনার্থীরা এসে ধ্যানমগ্ন হন। ভিক্টোরিয়া ডিজাইনের তিনতলা এই কটেজের একতলায় একটি বসবার ঘর। দোতলায় আছে স্বামী বিবেকানন্দের একটি মূর্তি এবং এটিই প্রধান উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্বামীজির শোবার ঘরটি তিনতলায়, বারান্দা থেকে দেখা যায় সেন্ট লরেন্স নদীর শোভা। কটেজটির দক্ষিণ দিকের শিলাময় ট্রেইল ধরে হাঁটতে লাগলাম আর চারদিকে প্রকৃতির অনন্ত শোভা দেখে বিমুগ্ধচিত্তে মন গেয়ে উঠল, ‘আমার পথে পথে পাথর ছাড়ানো।’ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ‘বিবেকানন্দ রক’–এ, যেখানে জায়গাটির সৌন্দর্য আরও প্রস্ফুটিত হলো। শিলাময় এ জায়গাটির এক পাশে আছে একটি ওকগাছ। যেখান থেকে চোখ মেলে চাইলেই দেখা যায় সবুজ বনানী, সেন্ট লরেন্স নদীর জলরাশি আর শোনা যায় পাখির গান। এই জায়গাটিতে স্বামী বিবেকানন্দ বসে ধ্যান করতেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধর্মীয় আলোচনা করতেন।


১৮৯৫ সালের ৭ আগস্ট স্বামীজি এখানে বসে গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। ঝরো হওয়া আর মুষলধারে পরা বৃষ্টিতেও ভগ্ন হয়েনি সেই ধ্যান আর লাভ করেন নির্বিকল্প সমাধি। তারপর থেকে তাঁর অনুসারীরা এই স্থানটিকে তীর্থস্থান মনে করে এবং এটি ‘বিবেকানন্দ রক’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সেখানে রয়েছে বসার জন্য দুটো লম্বা পাথরের বেঞ্চ আর মাঝখানে রয়েছে একটি স্তম্ভাকার পাথর, যাতে লেখা আছে ‘বিবেকানন্দ রক’–এর ইতিহাস। আমরা স্বামীজির স্মৃতিবিজড়িত সেই শতবর্ষী ওকগাছের কাছে পাথরে কিছুটা সময় বসলাম, নিমগ্ন হয়ে শুনতে চাইলাম প্রকৃতির নিঃশব্দতা, আর অন্তরের গভীরতায় খুঁজলাম শান্তির অপরাজিতা।


কটেজটি তত্ত্বাবধায়ন করে ‘বেদান্ত সোসাইটি অব নিউইয়র্ক’। জুন মাসের ‘মেমোরিয়াল ডে’ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের ‘লেবার ডে’ পর্যন্ত কটেজটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। শত শত জ্ঞানপিপাসুরা আসেন এই পবিত্র স্থান দর্শন করতে। শ্রী রামকৃষ্ণ স্বামী বিবেকানন্দকে বলেছিলেন, ‘পারলে একটা বটগাছ হস! পথিক এসে ছায়া পাবে, শান্তি পাবে, যাবার সময় হয়তো একটা ডাল ভেঙে নিয়ে যাবে! কত পাখি বাসা বাঁধবে, মলমূত্র ত্যাগ করে নোংরা করবে! কত লতা পরজীবীর মতো গজাবে তোকে ঘিরে! কিন্তু কিছু যায় আসে না। বটগাছ তো বটগাছই, তাঁর মহিমা একটা ডাল ভাঙলে কিছু কমে না, পাখির মল মূত্রের নোংরা কিছু মনে আসে না। ধ্বংস হয়ে গেলেও শুধু ইতিহাসের বুকে লেখা থাকে, এখানে একটি বটবৃক্ষ ছিল।’


ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে উজ্জীবিত করে মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০২ সালের ৪ জুলাই শুক্রবার রাত ৯টা ১০ মিনিটে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে বেলুড় মঠে নিজের ঘরে মহাসমাধিতে বিলীন হন। তিনি চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর জীবনাদর্শ ‘বহু রূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিস ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ আর রেখে গেছেন কর্মময় জীবনের পুণ্যস্মৃতিবিজড়িত পবিত্র তীর্থস্থান বিবেকানন্দ কটেজ।