জাতের নামে বজ্জাতি সব

চারদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর। দু–চার খণ্ড মৃদু কালচে সাদা মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে দূর আকাশটার গায়ে গায়ে। খোলা নীল আকাশের নিচে কোথাও যেন হাওয়ার চলটা আটকে আছে আজ। মাঝেমধ্যে মেঘের আড়ালে সূর্যটা লুকালেও চরাচরে একটা ভ্যাপসা ভ্যাপসা গুমোট ভাব। প্রকৃতির এমন চনমনে ভাবসাব দেখে কেউ হয়তো ঠাওরই করবে না যে গত রাতে এমন একটা ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে।

এমন একটা দিনে সুলতান সাহেবকে বের হতে হলো। তা–ও আবার নিজেকেই ড্রাইভিং করতে হচ্ছে। ঘণ্টাখানেক পথ পাড়ি দিতেই যেন সুলতান সাহেব ঘেমে চিটচিটে হয়ে গেলেন। সপ্তাহ দুয়েক আগে বিনা নোটিশে আচমকাই নষ্ট হয়ে গেল গাড়ির এসিটা। তার ওপর সুলতান সাহেবের স্ত্রী ড্রাইভার ছোকরাটাকে ছাঁটাই করে দিলেন গেল মাসে। এসব ছোকরাকে নিয়ে নাকি কোনো বিশ্বাস নাই। কখন কোথা থেকে করোনা নিয়ে উঠবে, কে জানে। সুলতান সাহেব নিজেও সাহস করে ওয়ার্কশপে নিয়ে যাননি গাড়িটা। অগত্যা আজ এমন প্রয়োজন না হলে নিশ্চয় তিনি এমন খররোদ্দুর মাথায় নিয়ে বের হতেন না।

উঁচু পুলটা পার হওয়ার পর এদিকের পথটা কেমন যেন একটু সরু হয়ে গেল। পথের দুধারে থেকে থেকে তালগাছ। বেশ উঁচু উঁচু। তালগাছের পাতায় পাতায় অনেকগুলো বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে। পাখিরা তেমন একটা নেই আজ। দুপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ ফসল। ফসলের মাঠ যেন অদূরেই মিলে গেছে গ্রামীণ জনপদে। এক অদ্ভুত সবুজে মাখা গ্রাম্য প্রকৃতি লেপ্টে আছে দৃষ্টির সীমানায়।


সুলতান সাহেব হঠাৎ করেই যেন চা খাওয়ার টক উঠল। অনেকক্ষণ ধরে পথের ধারে মনে মনে একটা চায়ের টং খুঁজছিলেন তিনি। এমন মেঠো পথে চায়ের টং থাকবে না, তা হয় না। কিন্তু এখন অবধি চোখে পড়েনি তাঁর। মন–মেজাজটা ধীরে ধীরে কেমন যেন তপ্ত উনুন হয়ে উঠছে সুলতান সাহেব।


খানিকটা এগোতে হঠাৎ যেন নজরে পড়ল অদূরের উঁচু ডিবিটা। ডিবিটার গা ঘেঁষে উঠে গেছে প্রকাণ্ড এক বটবৃক্ষ। বটের মূল ঘেঁষে ছোট্ট চায়ের টং। এদিকটায় থেকে থেকে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে পাতলা হাওয়া। মাথার ওপরে বটের শুকনো পাতারা ঝনঝন করে নড়ে উঠছে।


পথের ধারে বটমূলের গা ঘেঁষে গাড়িটা রেখে নামলেন সুলতান সাহেব। লোকজন নেই। টং দোকানের সঙ্গে লাগানো তক্তপোশে ধপাস করে বসে পড়েন তিনি। বসেই যেন মনে হলো ভুল করে ফেললেন। দোকানিকে লক্ষ করে বললেন, ‘এই মিয়া একটু মুছে দাও।’ বয়সের ভারে খানিকটা নইয়ে পড়া হাসু মিয়া বলল, ‘অহন আর দরকার নাই। বইসা যন গেছেন তো পরিষ্কার হইয়া গেছে।’ সুলতান সাহেব কাঁচুমাচু করলেন কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না।
সুলতান সাহেব উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘নাম কি তোমার বুড়ো মিয়া, এক কাপ চা দাও দিহি।’ হাসু মিয়া যেন আগে থেকেই জানতেন সুলতান সাহেব এ কথাই বলবেন। ‘এই লওন আপনের চা।’ সুলতান সাহেব চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘আরে মিয়া রং চা আমি খাই না। দুধ চা দাও।’ খানিকটা দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসু মিয়া জবাব দিল, ‘পথ মাপেন।’ বড় অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললেন সুলতান সাহেব, ‘মানে কি?’ ‘মানে রং চা না খাইলে পথ দেখেন। দুধ চা বেচি না।’


হাসু মিয়ার দিকে তাকিয়ে থতমত খেলেন সুলতান সাহেব। কিছু একটা বলতে গিয়ে যেন থেমে গেলেন তিনি। একটা তিরিক্ষি মেজাজে চায়ের কাপে চুমুক দিলেও ঢোঁক গিলতেই যেন অবাক হলেন সুলতান সাহেব। অদ্ভুত এক স্বাদ। অনেক দিন বাদে যেন আসল চায়ের স্বাদ পেলেন তিনি।
নিঃশব্দে কাটে খানিকটা সময়। বটের আবডালে মর্মর শব্দ ওঠে ঝিরঝির বাতাসে। হিজলের বনে ঘুঘু ডাকে। হালকা হাওয়ায় দোল ওঠে ফসলের মাঠে।

বড় শান্ত সুরে নীরবতা কাটান টং দোকানি। ‘মুই হাসু মিয়া। কই যান সুলতান সাহেব, বাড়িত কি কেউ মরছেনি?’ একটু থতমত খেয়ে যান সুলতান সাহেব। তিনি ধন্দে পড়ে গেলেন, ‘আমার নাম ধরে ডাকছে এই বুড়ো।’
একটু সময় পর কাপ–পিরিচ ধুইতে ধুইতে হাসু মিয়া কইল, ‘তো শাশুড়িরে মাটি দেবেন কহন? বেলা পাইবেননি?’ সুলতান সাহেব মুখে চা নিয়ে গিলতে পারছেন না। এ খবরও জানে ও। কেমন করে?
সুলতান সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘কেন আমার মা–ও তো মরতে পারেন। এক্কেবারে শাশুড়ির কাছে চলে গেলে।’
‘হুম। উনি তো গেল বছরই চইলা গেলেন। তো সুলতান সাহেব আপনি তো তহন ব্যস্ততা দেখাইয়া গেলেন না।’

সুলতান সাহেবের মুখখান বাঁকা হয়ে গেল। তিনি হাসু মিয়াকে বলল, ‘তোমার বাড়ি কই? এতসব কেমনে জানো তুমি? আমারে চেনো নাকি?’
‘মোর বাড়ির ঠিকানা দিয়া কী করতেন, হামলা দিবেননি। নাকি পুলিশ পাঠাইবেন। পাঠাইলে পাঠান। মুই এসবে ভয় করি না। তো দেখ্যাইয়া দেই আপনেরে। ওই যে ছোট ছোট গাছে ঘেরা বনের মতো দেখতে ওইটার ভেতর দিয়া চিকন হাঁটার পথ আছে। ওইটা পার হইলে ছোট একটা খাল পাইবেন। খালটা পার হইলে দেখবেন একটা খোপরি মতো ঘর। ওইহানেই থাকি আমি। একা।’
সুলতান সাহেব হাসু মিয়ার কথার মধ্যে নেই। একটা ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি। এখনো দুই ঘণ্টার পথ বাকি। এত দূরে তবু হাসু মিয়া কেমন করে তার এত সব জানে। কী আজব কারবার।
একটা নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্যের নীরবতায় যেন অনেক কথাই হয়ে গেল। নীরবতার জের টানে হাসু মিয়া, ‘তয় সুলতান সাহেব বহুত তো মাল কামাইলেন। দুই কোটি টাকার ধান্দা করবার গিয়ে নিজের মাকে পর্যন্ত মাটি দেবার যাননি। আপনার বিভাগের বড় কর্তা তো মিডিয়াতে মেলা বেফাঁস কথাবার্তা কইয়া শেষে করোনার ছোবলে কেল্লা ফতে। মনে করছিলেন করোনা কি আর আপনেগো মতো বড় লোকদের ধরবেনি। অহন বুঝেন ঠেলার নাম যে বাবাজি। স্বাস্থ্য বিভাগের কিছুই তো রাখেন নাই। সব খাইয়া জোগা কইরা দিছেন। না হয় অন্তত নিজেরা হইলেও হসপিটালে গিয়া কিছু চিকিৎসা পাইতেন।’
হাসু মিয়া আর সুলতান সাহেবের কথার মধ্যে টুং করে একটা রিকশা এসে দাঁড়ায় বটের তলায়। শন শন শব্দে দক্ষিণের হাওয়া আছড়ে পড়ে চোখে-মুখে। হিজলের বন থেকে ভেসে আসে কুহু কুহু সুর। রিকশাওয়ালা মইজ উদ্দি গামছা দিয়া মুখ মুছতে মুছতে উল্টো পাশে পাতানো তক্তপোশে বসে।

হাসু মিয়ার শব্দবানে চিকন ঘামে তেলতেলে হয়ে উঠলেন সুলতান সাহেব। উপায়ান্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। হাসু মিয়া গরম কেটলি হাতে নিয়ে চা ঢালছে কাপে। সেদিকে তাকিয়ে আছে মইজ উদ্দি। হাসু মিয়া চায়ের কাপটা মইজ উদ্দির দিকে তুলে ধরতে ধরতে বললেন, ‘সুলতান সাহেব আইসিইউ রিজার্ভ কইরাও তো পার পাইবেন না।’ মানে কী, সুলতান সাহেব বললেন। খানিকটা ধীর দৃষ্টিতে হাসু মিয়া কইল, ‘এত মানে মানে কইরো না। দুদিন পরেই মানে বুঝবা। অহন যাও গাড়িত বউ রাইখা আইছ। শাশুড়িরে গিয়া মাটি দেও গিয়া।’

পকেট থেকে ওয়ালেটটা হাতে নিতে নিতে সুলতান সাহেব একটু সুর পাল্টাইয়া বলেন, ‘এই তোমার চায়ের ক টাকা।’ ‘পাঁচ টাকা।’ সুলতান সাহেব ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার নোটটা বের করে ধরলেন। হাসু মিয়া এবার বড় বড় চোখে তাকাল সুলতান সাহেবের দিকে। একটু সামনে ঝুঁকে বাঁ হাতে দিয়ে চটের ছালার নিচে থাকা হাত কুড়ালটা টেনে নেন। হাসু মিয়া রাগত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘ওই লুটের দল, তুই মুর লগেও ধান্দাবাজি করস। ভাবছত মুই কিচ্ছু বুঝি না, না?’ সুলতান সাহেব এবার সত্যি সত্যি ভড়কে গেলেন। হাসু মিয়া বাঁ হাতে কুড়ালটা নিয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠলেন, ‘বাগ এইহান থ্যাইক্কা। তোদের মত জালিম চোর-ডাকত একদুম দুচোখে দেখবার পারি না।’
সুলতান সাহেব প্রায় দৌড়ে গাড়িতে উঠে টান দিলেন। হাসু মিয়া থরথর করে কাঁপছেন। দুচোখে তাকিয়ে আছেন দূর প্রান্তে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে তার। খানিকটা সময় পর কিছুটা সংবিৎ ফিরে পান হাসু মিয়া। মইজ উদ্দির দিকে সিক্ত নয়নে তাকিয়ে বলেন, ‘মইজ উদ্দি এ জন্য তো যুদ্ধ করি নাই, গরিব মাইনষের ভান্ডার থ্যাইক্কা একটা কানাকড়িও ভাতা নেই নাই কখনো। শুধু চাইছি শেখ সাবেহের এ সোনার দেশটার একটু উন্নতি। কিছু হাসিমাখা মুখ। কিন্তু কী পাইলাম। কী দেখলাম। জাতের নামে বজ্জাতি সব।’

মইজ উদ্দি সুড়ুৎ সুড়ুৎ চা টানে। হাসু মিয়ার দৃষ্টি আড়ষ্ট হয়ে আসে। এমনি করেই হাসু মিয়াদের আজন্ম কষ্টগুলো জমতে থাকে একের পর এক।

*ডক্টরাল ফেলো, অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আলাবামা, আমেরিকা ও সহকারী অধ্যাপক, শাবিপ্রবি। [email protected]