কেন আমি আমেরিকায় এলাম

আমার জন্ম পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে। আমার নিজের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ—এটা আমাকে প্রভাবিত করেছে আমেরিকা আসার সিদ্ধান্ত নিতে। নবকুমার ও আরমানিটোলা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমি স্বাধীনতাসংগ্রামে ধাপে ধাপে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে স্বাধীনতার জন্য ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে যাই এবং এ কারণে মধুর ক্যানটিন ও বিভিন্ন ছাত্রহলে যাওয়া-আসা করতাম ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে। ৯ মাসের যুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থীদের গোপন তথ্য, চাঁদা উঠিয়ে সহযোগিতা ও খাদ্য সরবরাহ করাটা আমার কাজ ছিল।

আমার ছোট চাচা সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমাদের এলাকাটা পাকিস্তানপন্থীদের ঘাঁটি ছিল। আমি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম এবং আমার বয়স কম ছিল বলে আমার কাকা ও আমার পরিবার আমাকে সশস্ত্র যুদ্ধে যেতে দেয়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম। ৪টি বিষয়ে লেটার নম্বর নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হলাম। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে (অনার্স ১ম ব্যাচ) ভর্তি হলাম। প্রথম বর্ষে থাকা অবস্থায় আমি রাশিয়া যাওয়ার বৃত্তি পেলাম। কিন্তু রাশিয়া না গিয়ে আমি আমেরিকায় আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনকার সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রয়াত তৌহিদ স্যার, প্রয়াত নূরুজ্জামান স্যার, সাখাওয়াত আলী স্যার, ড. আরেফিন সিদ্দিক (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর) স্যারের সঙ্গে পরামর্শ করে আমেরিকা আসার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ আমেরিকা সরকার আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল কিন্তু আমেরিকার জনগণ ও মিডিয়া আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে সমর্থন করেছিল। আরেকটা কারণ, তখনকার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি’। এ অপমানজনক মন্তব্যটা আমার বাঙালি সত্তায় বড় আঘাত করেছিল।

পঁচাত্তরের বিয়োগান্ত ঘটনা বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে ও ৩ নভেম্বরে জাতীয় চার নেতার হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে পাকিস্তান ধারার রাজনীতি শুরু হলো এবং মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন পদদলিত করে পোশাক, জিয়া ও এরশাদের রাজনীতি পাকিস্তানিদের সপক্ষে বাংলাদেশকে ২য় পাকিস্তান বানানো শুরু হলো।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু ও নভেম্বরে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল দেশি- বিদেশি চক্রান্তের ফসল। তখনকার ঢাকা শহর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের সৈয়দ নূরু। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় থেকে নূরু ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি আর ছাত্র রাজনীতিতে ছিলাম না। কিন্তু নূরু ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি। তিনি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং কলেজের হোস্টেলে থাকতেন । মাঝেমধ্যে আমাদের নাজিমুদ্দিন রোডের বাসায় আসতেন এবং আমার আম্মার হাতের রান্না করা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিরিয়ানি খেয়ে প্রশংসা করতেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর একদিন রাতের অন্ধকারে নূরু ভাই আমাদের বাসায় এসে বললেন, ‘বাবুল চলো, আমরা ভারতে যাই, সেখানে গিয়ে কাদের সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করব এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব।’

আমার সুপ্ত বাসনা ছিল আমেরিকা এসে বাংলাদেশের জন্য কিছু একটা সৃজনশীল কাজ করব, যা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপকার হবে ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমৃদ্ধিশালী করবে এবং বিশ্ববাজারে আমাদের ঐতিহ্যবাহী হাতে বানানো কাপড়, বাঁশ, কাঠ ও বেতের পণ্য আনতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলবে। আমেরিকায় আসার পর থেকেই আমি বাংলাদেশের কুটিরশিল্প নিয়ে গবেষণা শুরু করি, যা সাধারণ সৃজনশীল মানুষের শিল্প এবং কীভাবে এই কুটিরশিল্পকে ইউরোপ ও আমেরিকাতে বাজারজাত করা যায়, তাই নিয়ে ভাবতে থাকি।

আমি ১৯৮১ সালে প্রথম হলিউডে এসে পড়াশোনা ও গিফট শপে কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাংলাদেশকে পরিচিত করার কাজে নিয়োজিত হই। এ জন্য আমি হলিউড বুলুবার্ডে কাজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটক হলিউডের চাইনিজ থিয়েটারে আসে মুভি স্টারদের হাতের ও পায়ের ছাপ দেখার জন্য। এখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে বাংলাদেশকে পরিচিত করার মোক্ষম সুযোগ আছে, গিফট শপে কাজ করলে এবং স্যুভিনিয়ার, গিফট সামগ্রীর একটা ধারণা নেওয়ার জন্য, যা বাংলাদেশের কুটিরশিল্পের জন্য ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে আসবে। হলিউডে টি-শার্ট ও গিফট শপে কাজে আমার সৃজনশীল ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য মালিক মিসরীয় মো. রায়ান আমাকে তাঁর ৮টি গিফটশপের জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্ব দেন। কিন্তু আমার মাথায় চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল ট্যুর কোম্পানিতে কাজ করলে সরাসরি ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে বাংলাদেশকে আরও ভালোভাবে পরিচয় করা সহজ হবে। এখন আমি হলিউডে ‘মোহাম্মদ বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। আমার নিজের ডিজাইন করা বামপার স্টিকার বানিয়ে বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও সুন্দরবনকে ট্যুরিস্টদের কাছে পরিচিত করাচ্ছি।

১৯৮৫ সালে আমি হলিউডের স্টার লাইন ট্যুর কোম্পানিতে যোগ দিই। এখন আমি ওই ট্যুর কোম্পানির হলিউড ডবলি থিয়েটারে অপারেশন ডিরেক্টর হিসেবে কর্মরত আছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি পড়াশোনা করি ফ্যাশন ডিজাইন ও মার্কেটিং, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও ট্যুরিজমের ওপর। আমি গ্লোবাল কসমস ইন্টান্যাশনাল ট্যুর কোম্পানিতে পাঁচ বছর হলিউড ডিভিশনের ট্যুর ফটোগ্রাফার হিসেবে পার্টটাইম কাজ করি। হলিউডে কর্মরত অবস্থায় আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে অনেক চিত্র পরিচালকের এবং পল স্টুয়ার্ট পরিচালিত ‘ইমান’ নামের একটি ছবিতে ছোট একটা চরিত্রে অভিনয় করি। আমেরিকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কুটিরশিল্প আসছে তাদের নিজেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী। আমি মনে করি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের কাপড়, বেনারসি, খদ্দর, রাজশাহী সিল্ক, উপজাতীয়দের হাতের বোনা কাপড়, বাংলার হারানো ঐতিহ্যবাহী মসলিন, হাতের নির্মিত কাঁসা, পিতল, কাঠের শিল্প, পাথর, বাঁশ, মৃতশিল্প, বেত, সিরামিক, পাটের স্যুভিনির ব্যাগ, শামুক, ঝিনুক, চামড়া ও ইসলামিক স্যুভিনিয়র, চা-শিল্প, মধুর বিরাট সম্ভাবনা আছে এবং আমি ওইসব নিয়ে গবেষণা করেছি। উপমহাদেশের প্রাচীন আয়ুর্বেদ ওষুধ নিয়েও আমি গবেষণা করেছি, যা আমেরিকা ও ইউরোপে বাজারজাত করা সম্ভব বলেও আমি মনে করি।

লেখক
লেখক

আমি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালে অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ বিজনেস কনভেনশনে যোগ দিয়ে আমার গবেষণার ওপর বক্তব্য রাখি। আমি হলিউড এবং অরল্যান্ডোতে গিফট স্যুভিনিয়র ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত অবস্থায় ট্যুরিজম কনফারেন্সে যোগ দিয়ে লন্ডন, টোকিও, ব্যাংকক, দিল্লি, মিয়ানমার, মেক্সিকো সিটি, পানামা, বাহামা, নিউইয়র্ক, মায়ামি, লাস ভেগাস, বার্সেলোনায় বক্তব্য রেখেছি। এ বছর লন্ডন, লাস ভেগাস ও ব্রাসেলসে বক্তব্য রাখার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি বাংলাদেশে সিলেটের মৌলভীবাজার ও ঢাকার গাজীপুরে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসালট্যান্ট হিসেবে সংযুক্ত আছি। আমি ক্যালিফোর্নিয়ার ডা. কালী প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি।