উত্তরণ

ড. কফিলউদ্দিন জীবনে কোনোদিন কল্পনাও করেননি তাকে কোনোদিন বাসা থেকে কাজ করতে হবে। যিনি কিনা তার পেশাগত জীবনের প্রায় পঞ্চাশভাগ সময় ট্রাভেল করে কাটিয়েছেন। কোনো এক মাসে ট্রাভেল না থাকলে যার মন উসখুস করতে থাকে। ট্রাভেল করা এক ধরনের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে কফিলুদ্দিনের জীবনে। নিজের টাকায় ট্রাভেল করতে হলে কতটা করতেন তা জানা নেই তবে যা কিছু করছেন অফিসের টাকায় এবং অফিসের কাজের অংশ হিসেবেই। এসব কারণে এই চাকরি ছাড়তেও মন চায় না। অন্যান্য কোম্পানিতে ভালো কম্পেনসেশন থাকলেও তার বর্তমান চাকরির এই ট্রাভেলের সুবিধাটা ইউনিক। অফিসের টাকায় বিদেশ ঘুরতে পারলে এর চেয়ে মজার ব্যাপার আর আছে বলে মনে হয় না।  

কোভিড -১৯ কেমন করে কফিলুদ্দিনের মজার জীবনটাকেই ওলোটপালোট করে দিল। বাসায় বসে কখনও কাজ করা যায়? 

যদিও এক সময় এই কফিলউদ্দিন পেশাগত জীবনে যিনি একজন পরিবেশ প্রকৌশলী মনে করতেন বাড়ি থেকে কাজ করা দুর্দান্ত হবে। গাড়ী, টাই এবং স্যুটের দরকার নেই, প্রতিদিনের যাতায়াতের জন্য আর কোনও পেট্রোল পোড়াতে হবে না। বায়ু দূষণ এক নিমিষেই অর্ধেকে নেমে আসবে, এমন আরো অনেক কিছু। পরিবেশবাদীদের সাথে সুর মিলিয়ে তিনিও একসময় আন্দোলনে নেমেছিলেন যেন পঞ্চাশভাগ মানুষকে বাসা থেকে কাজ করতে বাধ্য করা হয় বিশেষ করে যারা কম্পিউটার নিয়ে কাজ করেন। যেমন হিউমান রিসোর্স, আই টি, ডাটা এন্ট্রি অ্যান্ড এনালাইসিস, এমন আরো অনেক পেশার লোকজন সহজেই বাসা থেকে কাজ করতে পারে। এতে পরিবেশ যেমন অনেকটা দূষণমুক্ত থাকতো সেই সাথে কোম্পানিগুলো অনেকদিক থেকেই লাভবান হতো। তবে বরাবরই যারা কাজ করবে তাদের ব্যাপারটিকে সেভাবে ভেবে দেখা হয়নি। যদিও সে আন্দোলন কখনোই সফলতার মুখ দেখেনি। কিছু মানুষ এখনো আন্দোলন করে যাচ্ছে কিন্তু সমাজবাদী, মনোবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের যুক্তির কাছে তারা সবসময়ই হার মেনেছে। কফিলউদ্দিন এখন সেই ব্যাপারটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। বাসা থেকে কাজ করা কতটা কষ্টকর। এখন মনে হচ্ছে তিনি একটা দারুন ভুল বিষয় নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। বাসা থেকে কাজ করায় আনন্দের কিছু নেই। বৈচিত্রহীন জীবন সত্যিই নিরস কাব্যশুন্য। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারেনা।

অবশ্য প্রথম কদিন খুব ভালো লেগেছিলো। আহা কি শান্তি, ট্রাফিক নেই, ঘুম থেকে ওঠার তারা নেই, কি করছি কেও দেখার নেই, বসের ফোন কল থাকলেও সে কলে কোনো তাড়াহুড়ো নেই, প্রতিদিন নিত্য নতুন পোশাক পরা, পারফিউম মাখার ব্যাপার নেই, জুম মিটিংয়ে ক্যামেরার সামনে নিজের ভিডিও মিউট করে করে রাখলে চুল কেমন এলোমেলো নাকি বিন্যস্ত সেটা দেখার কেও নাই। তবে সেটা উপভোগ্য ছিল মাত্র দুই সপ্তাহের জন্যে। নিজের জীবনে যখন বাসা থেকে কাজ করার মতো অতীতের একটা স্বপ্ন কোভিড-১৯ এর কারণে বাস্তবায়িত হয়েছে তবে আগের সেই কল্পনার কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি। এখন মনে হয় বাসা থেকে কাজ করা চিড়িয়াখানার জীবনের মতো। বানরের একটি বড় খাঁচা এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। কোলাহল হীন, নিস্প্রান গৃহকোনটি অসহ্য লাগে তার কাছে। মনেপ্রাণে দিবানিশি একটাই প্রার্থনা কখন শেষ হবে বাসা থেকে কাজের দিন কখন কাজে ফিরবেন তিনি। কোলাহলপূর্ণ জীবনই স্বাভাবিক, আনন্দময়। 

কফিলউদ্দিন বরাবরই একজন নিভৃতচারী মানুষ। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবেরা তাকে একজন নিরেট স্বার্থপর বলেই জানেন। তিনি নিজেকে নিয়েই থাকতে ভালোবাসেন। তবে তিনি এখনও জানেন না তার নিজের পরিবার তাকে নিয়ে কি ভাবে। কখনো সেটা জানার প্রয়োজন মনে করেছেন বলে মনেও হয় না। কফিলউদ্দিন দুর্দান্ত মেধার অধিকারী ছিলেন। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যখন ফুল ব্রাইট ফেলোশিপ নিয়ে আমেরিকা পাড়ি জমাবেন তখনি পরিবারের উদ্যোগে সুন্দরি তার বয়সের চেয়ে অনেক কম বয়সী শান্ত স্বভাবের মেয়ে দিলারাকে তিনি বিয়ে করে সস্ত্রীক আমেরিকা চলে আসেন। চৌকষ মেধা, একাগ্রতা এবং চেষ্টা তাকে জীবনের আরাধ্য সকল সিঁড়িগুলো একেএকে অতিক্রম করতে সহযোগিতা করেছে। করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি বা পাননি এমন ঘটনা তার জীবনে বিরল। পিএইচডি শেষ করার সাথে সাথেই তিনি ছয় ডিজিট বেতনের চাকরি পেয়েছেন যা কিনা তার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ছিল। বলাই বাহুল্য বিবাহের ২১ বছর পর তার সেই অবস্থান এখন অনেক ওপরে। নিজের মেধার উন্মোচনে, জীবন এবং জীবিকা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থেকেছেন যে কখনো দিলারাকে শুধু একজন স্ত্রী ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ তার হয়নি। 

সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ দিলারার জীবনে বিয়েটা ছিল অকস্মাৎ এক স্বপ্নভঙ্গ। অন্যরা যখন দিলারার একজন প্রকৌশলীর সাথে বিয়ে এবং প্রবাস যাত্রা নিয়ে হিংসে করছিলো দিলারার মনে ছিল অন্য কিছু। পরিবারের সিদ্ধান্তকে না বলার সাধ্য দিলারার ছিলো না। সদ্য ইন্টারমেডিয়েট পড়ুয়া একজন বাঙালি মেয়ের আজ থেকে ২১ বছর আগের পরিবেশে পরিবারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া অসম্ভব ছিল। আলো ঝলমলে চাকচিক্যময় আমেরিকান জীবন দিলারাকে খুব একটা কাছে টানতে পারেনি। জীবনকে মনে হয়েছে অসুম্পূর্ণ একটা উপাখ্যান। যে বয়সে যা হওয়ার কথা তা হয়নি। কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েলি জীবনে বান্ধবীদের নিয়ে এক ধরনের উপভোগের বিষয় থাকে সেটা দিলারা বুঝতে পারলেও উপভোগ টা হয়ে উঠেনি। কফিলুদ্দিনের সংসারে দিলারা নিজেকে আবিষ্কার করেছেন একটি অতি প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক উপকরণ হিসেবে। বয়সের কারণে হোক আর বুদ্ধির অপ্রতুলতার কারণেই হোক, দিলারা কখনোই মুখ ফুটে নিজের ভালো মন্দের কথা কফিলকে বলতে পারেননি অথবা একধরণের চাপা অভিমান থেকেই করেননি। সেই অভিমান প্রথম দিকে বাবা-মার প্রতি থাকলেও পরে সেটা কফিলের ওপরেই পড়েছে। 


দিলারার মনে হয়েছে বাবা মা না হয় তাকে একজন যোগ্য পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু অমন উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কফিল কেন বয়সের এতো প্রার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দিলারাকে বিয়ে করলো? শুধু সুন্দরি ছিল বলে? সুদীর্ঘ্য সংসার জীবনে দিলারা এটাও বুঝেছে কারো কাছেই তার নিজের সেই অভিমানের কোনো মূল্য ছিলো না অথবা কেউ পরোয়া করেনি। বিয়ের দুবছর পরেই দিলারার বড় মেয়ের জন্ম। পরের বছরেই ছোট মেয়ের জন্ম। সেই সময়ে যদি কফিলের মা আমেরিকা এসে দিলারাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা না করতেন তাহলে দিলারার পক্ষে এই জীবনে বেঁচে থাকাই দুরূহ ছিল। মেয়েদের আস্তে আস্তে বড় করে তোলা, কফিলের অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্খার কারণে সংসারের প্রতি একধরণের বিমুখতা সব মিলিয়ে দিলারার জীবনের সেই সময়গুলো ছিল অন্যরকম কষ্টের। বলতে গেলে দিলারা এখন পর্যন্ত জীবনকে একাই চালিয়ে নিয়েছেন। তার নিজের যোগ্যতার তুলনায় তিনি অসময়ে অনেক বেশি কিছু করে ফেলেছেন। যেই কষ্টের কথা কোনোদিন কাউকে বলে বুঝানো যাবে না। দিলারা জীবনে তার শাশুড়ির কাছ থেকে যে ভালোবাসা আদর পেয়েছেন সেটা তিনি কখনোই ভুলতে পারবেন না।


একটা ব্যাপারে দিলারার কখনোই কোনো অভিযোগ অথবা অনুযোগ নেই তা হলো আর্থিক সাচ্ছন্দ। এই দায়িত্বটি কফিল খুব ভালোভাবেই পালন করেছে। এখন দিলারার জীবনে সত্যিই আর তেমন একটা কষ্ট নেই। সুন্দর ফুটফুটে দুই দুইটি মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওরা এখন অনেকটাই স্বাধীন। নিজেদের সব কাজ নিজেরাই করে। মেয়েরাও বাবার ওপরে খুব একটা নির্ভরশীল নয়। দিলারা এটা ভেবে খুব আনন্দ পান। মেয়েদের হয়তো এমনই হওয়া উচিত। মেয়েরাও খুব লক্ষী। তাদের মা তাদের বাবার কাছ থেকে যে সময় পায়নি অথবা পায় না মেয়েরা তা পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। ওরা যতক্ষণ বাসায় থাকে মাকে সময় দেয়। মায়ের সাথে গল্প করে, আড্ডা দেয়, মুভি দেখে, গান শোনে। মাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যায়। 

নিজের জীবনে যা কিছু পাননি নিজের মেয়েদের জীবনে যেন তার কোনো কমতি না ঘটে সে ব্যাপারে খুবই সচেতন দিলারা জাহান। নিজে অল্প বয়সে বিয়ে করে যা কিছু মিস করেছেন মেয়েরা যেন কখনোই তা না করে সে ব্যাপারে খুবই সচেতন তিনি। তাই মেয়েদের দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি জানেন ছেলেমেয়েদের যদি খুব ছোটবেলা থেকে নিজের সংস্কৃতি, ধর্ম, পরিবার সম্পর্কে ভালো ধারণা দেওয়া যায় এবং ছেলেমেয়েরা যদি প্রতিনিয়তঃ সেসব নিজের পরিবারে বাবা-মাকে পালন করতে দেখে তবে সেই ছেলে-মেয়েদের পিছলে পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এখন তার মেয়েরা বাইরে কখন কি করলো, কার সাথে কথা বললো, কোন ছেলে কিভাবে তাকালো, কে প্রপোস করলো সব এসে মাকে বলে। মেয়েরা ঘরে ঢুকেই মা মা করতে থাকে, কে আগে মাকে নিজের কথা শোনাবে সেইটা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। এই ব্যাপারটি দিলারা খুব উপভোগ করেন। মেয়ে আর মায়ের সম্পর্ক এমনি হওয়া উচিত। নিজের জীবনে তা ঘটেনি। নিজে বড় হয়েছেন অত্যন্ত কঠিন একটা পরিবেশে। বাবা তো দূরের কথা মায়ের সাথে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহসও হতো না। দিলারা মেয়েদের বলেই দিয়েছেন তারা যদি কাউকে পছন্দ করে সরাসরি তাকে জানাতে। তাদের পছন্দে মায়ের কখনোই কোনো আপত্তি থাকবে না। দিলারার বিশ্বাস মেয়েরা এমন কাউকে পছন্দ করবেও না। আপাততঃ তার তাই মনে হয়। তাদের বাবা এসব নিয়ে খুব একটা ভাবেন বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে একদিন কফিলউদ্দিন হঠাৎ বাসায় ফিরে দিলারাকে বললেন তিনি তার বড় মেয়েকে বিয়ে দেবেন। ছেলে তার কলিগ, ভালো জব করে, ভালো পরিবার, এমন সম্পর্ক হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই প্রথম দিলারা কফিলকে মুখের ওপরে চিৎকার করে না বলে দেন। কফিল বেচারা দিলারার এমন আচরণে এক রকম ভ্যাবাচাকা খেয়ে যান। দিলারা বলেন, মেয়েদের এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। মেয়েদের যে বয়সে যা করা উচিত তারা তাই করবে। এই বয়সে বিয়ে দিয়ে মেয়েকে তিনি জীবনের তেমন কিছু আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চান না। কফিল উদ্দিন দিলারার এই কথার কোনো অর্থ বুঝেছেন কি না জানা নাই। 

কোভিড-১৯ এর লকডাউনে জীবনে এই প্রথম দিলারা এতো লম্বা সময় কফিলকে কাছে পেয়েছে। সেই সাথে মেয়েরাও। তবে এই কাছে পাওয়া একে ওপরের জন্যে কতখানি আনন্দের সেটা বলা মুশকিল। কফিল বাসা থেকে কাজ করছে প্রায় দুমাস। মেয়েরাও বাসায় বন্দী দুই মাসের ওপরে। মেয়েরা যার যার রুমে। বাবা বেশিরভাগ সময় কম্পিউটারে ব্যস্ত। সারাদিনই ফোন কল, জুম মিটিং এসব নিয়ে ব্যস্ত। দিলারা বেগম তার নিজের জীবনে এই করোনা ভাইরাসের প্রভাব খুব একটা দেখতে পাননি। শুধু মেয়েরা আগে বাইরে যেত এখন আর যাচ্ছে না। মেয়েরা সারাক্ষন চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করছে। সামনে এসে একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে, হাহুতাশ করছে। দিলারা জাহানের দৈনন্দিন কার্যক্রমে কোনো রকম ছেদ পড়েনি। রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, ফোন করে দেশে বিদেশে সব আত্মীয়স্বজন্দের খোঁজ খবর করা এসব। কিছু কাজ বেড়েছে যেমন কফিলুদ্দিনকে মাঝে মাঝে কফি বানিয়ে দেয়া, লাঞ্চ পরিবেশন করা ইত্যাদি। দিলারা বুঝতে পারেন সুদীর্ঘ্য সময়ে বাবার সাথে মেয়েদের যে দূরত্ব তৈরী হয়েছে সেই দূরত্ব মনের। বাবা কাছে থেকে যে সেই দূরত্ব কমেছে এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আর নিজের সাথে কফিলের? সেটা অনেক জটিল একটা অংক। সেই অংকের হিসেব মেলানো খুব কঠিন। তবে হ্যা, তিনি অনেক ভেবেছেন, তার সাথে কফিলের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্ক কে আরো সুন্দর করার জন্যে তার নিজের কি কি করনীয় আছে তার সব তিনি করেছেন কি না ? ভেবে কোনো কুল কিনারা খুঁজে পান নি তিনি। তিনি আসলে জানেন না তার পক্ষ থেকে আরও কি কি করা উচিত। আচ্ছা, এইযে কোরোনা ভাইরাসের কারণে চারটি মাত্র প্রাণীর পরিবারের সবাই দীর্ঘ দুইমাস বাসায়, এটা কি একটা অনেক বড় সুযোগ ছিলো না নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার? পৃথিবীর সব খারাপই কি খারাপ? করোনা ভাইরাস নিঃসন্দেহে অনেক বড় একটা অভিশাপ কিন্তু এর আড়ালেও কারো কারো জন্যে কি ভালো কিছু নেই? কফিল এর কি উচিত নয় বিষয়টি নিয়ে ভাবা? ব্যক্তিগতভাবে কফিল তো খারাপ মানুষ নন। হয়তো কফিল নিজে বুঝেনি না তিনি যা করছেন তা ঠিক নয়। নিজের পরিবারের ওপরে জগতের আর কিছু থাকতে পারে না। অথবা এটা কফিলের হয়তো মাথায়ই আসে না। সে জাস্ট তার মতোই। কিন্তু এটা চলতে পারে না। কফিল এক ভিন্ন কোনো গ্রহের প্রাণী নন, তার সাথে রয়েছে তার পরিবার। তার স্ত্রী তার সন্তান। পরিবারের প্রতি সবারই দায়িত্ব রয়েছে। প্রথম দিকে এসব না বলতে পারলেও গত ১৫ বছরে দিলারা কফিলকে এই বিষয়গুলো অনেকভাবে বুঝাতে চেয়েছেন। কফিল হয়তোবা এড়িয়ে গেছে অথবা পাত্তাই দেয়নি। সে চলেছে তার মতো। 

দুইমাস লকডাউনে থেকে কফিল হাফিয়ে উঠেছেন। তিনি বাইরে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। কবে সব কিছু স্বাভাবিক হবে। কবে আবার তিনি ফিরে যাবেন কোলাহল পূর্ণ কর্মময় জীবনে। একটু একটু করে আজকাল তার ভাবনায় একটা জিনিস কাজ করছে। আচ্ছা তিনি যদি তার অফিসের কথাই ভাবেন, সারাদিনে কজন মানুষের সাথে দেখা হয়? কথা তো বাসা থেকেই হচেছ। তাহলে তিনি আসলে কি মিস করছেন? দেখা হওয়া? তিনি চাইলেও তো আর আগামী এক বছরে কোনো ট্রাভেল করতে পারবেন না। বড় কোনো মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তার অফিস এ মানুষ মাত্র কজন। নিজের সহকর্মীরা ছাড়া তিনি তো আর খুব একটা বাইরে আড্ডাও দেন না। তাহলে বাসা থেকে কাজে আসলে তিনি কি মিস করছেন ? কারো সাহচর্য? নিজের আসে পাশেই তো তিন তিনটি প্রাণী। তারা সবাই তার খুব কাছের। যাদের চাইলেই ছুঁয়ে দেওয়া যায়। আদর করা যায়। কাছে বসে গল্প করা যায়। কিন্তু তিনি তা করছেন না কেন? মেয়েরাওতো আসছে না খোঁজ নিতে বাবা কি করছে। বাবার সাথে গল্প করতে। দিলারা তো সব কিছুই করছে। তিনি দিলারার ওপরে সামান্য রাগ করতে পারেন এমন বিন্দুমাত্র কিছুইতো দিলারা কোনোদিন করেনি। এসব ভাবতে ভাবতে ড্রয়ইং রুমে মা মেয়েদের উঁচুস্বরে খিল খিল হাসির শব্দে কফিলুদ্দিনের সম্বিৎ ফেরে। তিনি খুব ধীর পায়ে ড্রয়ইং রুমের দিকে এগিয়ে যান। দূর থেকে দেখেন মা আর মেয়েরা মিলে কিছু একটা ইউটিউবেদেখছে আর হাসছে। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের ওপরে গড়িয়ে পড়ছে। তিনি খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেন, দিলারার কাঁধের ওপরে ছোটমেয়ের হাত কি পরম মমতায় জড়িয়ে রেখেছে। আর মায়ের কোলে মাথা রেখে বড় মেয়ে কার্পেটে শুয়ে আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে। এমন দৃশ্য জীবনে কোনোদিন তিনি দেখেছেন বলেতো মনে হয় না। তিনজনের হাসি যেন থামছেই না। কফিলউদ্দিন আরেকটু সামনে এগিয়ে যান। নিশ্চিত হন মা মেয়েরা মিলে টিকটিকে মজার কিছু একটা দেখে হাসছে। একটু সময় নেন তিনি কি ওখানে যাবেন না কি যাবেন না। দ্বিধা ভুলে তিনি মেয়েদের কাছে এগিয়ে যান। বাবাকে দেখে সবার হাসি অকস্মাৎ থেমে যায়। বড় মেয়ে কার্পেট থেকে উঠে বসে। ছোট মেয়ে মায়ের গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। হাসির শব্দ থেমে যায়। দিলারা রিমোট হাতে নিয়ে টিভি বন্ধ করে দেন। কফিলউদ্দিন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। কি করবেন বুঝতে পারেন না। এক নিমেষে নিজেকে খুব একা বড় বেশি এক মনে হয় কফিলুদ্দিনের। জীবনে কখনো এতটা একা তিনি অনুভব করেন নি। মেয়েরা এক ফাঁকে উঠে যার যার রুমে চলে যায়। দিলারা কফিলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, কি মিটিং শেষ? এতো তাড়াতাড়ি মিটিং শেষ করলে? কফিল ইসারায় মাথা নাড়েন। 

-তোমাকে চা কফি কিছু দিবো?
-না 
-ও আচ্ছা। 
দুজনের আর কোনো কথা থাকে না। 

কফিলউদ্দিন চুপচাপ সোফায় বসে পড়েন। অন্তহীন ভাবনার সাগরে ডুবতে থাকেন তিনি। দিলারা বেগম উঠে নিজের কাজে চলে যান। টিভির রিমোট হাতে নিয়ে ইতস্তত ঘোরাতে থাকেন কফিল। নিজের একাকিত্ব আরো বেশি বাড়তে থাকে। এই মুহূর্তে বাইরের কোলাহলপূর্ণ জীবনটাকেও কেন জানি বড্ড বেশি ফিকে মনে হয়। নিজের অপরাধ বোধ উন্মোচিত হতে থাকে। নিজেকে অনেক গুলো প্রশ্ন করে বসেন নিজেই। আচ্ছা তিনি কি সত্যি জানেন তার মেয়েরা দেখতে কেমন? মেয়েদের চোখের রং কেমন? একটু আগে মেয়েরা কে কি ড্রেস পড়েছিল? কি রঙের? মেয়েরা কে কি খাবার পছন্দ করে? ওরা কেউ কি কাউকে পছন্দ করে কিনা ? মেয়েদের কথা বাদই দিলাম, দিলারা আসলে দেখতে কেমন? এই প্রশ্নটা কি খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে না? হয়তো শোনাচ্ছে কিন্তু সত্যি হলো এটাই কফিল তার সবচেয়ে প্রিয় এই মানুষগুলোর থেকে অনেক দূরে। একই ছাদের নিচে থেকেও তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। অথচ এরাই এই পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন। এরাই তার জীবনের কোলাহল। তিনি কখনোই জীবনের সত্যিকারের আনন্দ খুঁজে পেতে চাননি। ঠিক কবে সর্বশেষ মেয়েদেরকে বুকে নিয়ে আদর করেছেন মনে করতে পারেন না কফিলুদ্দিন। এইতো আর কদিন, মেয়েদের বিয়ে হবে যাবে। ওরা ওদের নিজেরদের জীবনে চলে যাবে। কফিলউদ্দিন শুধু একজন বাবা হয়ে ওদের সব অফিসিয়াল কাগজ পত্রে নাম হয়ে থাকবেন এটাই? বুকটা অনেক ফাঁকা হয়ে আসে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। অনুশোচনায় এবারে তিনি নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। সুদীর্ঘ সময়ে পরিবারের সাথে যে আত্মিক দূরত্ব তিনি তৈরী করেছেন তা কি খুব সহজে কমানো সম্ভব? জীবনের সব অর্জনকে আজ খুব ঠুনকো মনে হয় কফিলের।

দিলারাকে তিনি তার জীবনে কতখানি মূল্যায়ন করেছেন? আদৌ করেছেন কি? অথচ আজ মনে হচ্ছে সেই কৈশোরোত্তীর্ণ দিলারা জাহান, এক অসম্ভব সম্ভাবনাময় তরুণী, যাকে জীবনে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য কিছুই করতে দেয়া হয়নি, সেই কিনা তার থেকে অনেক বেশি সফল। দুই মেয়ে নিয়ে একটু আগেই যে অকৃত্তিম হাসি দিলারা হেসেছে কফিলের জীবনে সেই হাসি কোনোদিন হাসতে পেরেছেন কিনা মনে পড়ছেনা। 

আরো একটি বিষয় কফিলুদ্দিনকে ভাবিয়ে তোলে। নিজেতো চাকরির সুবাদে হোক আর যাই হোক দুনিয়া ঘুরে বেড়িয়েছেন আর মাত্র দুইমাসের লকডাউনে পরিবার পরিজন সাথে থাকার পরেও তিনি হাফিয়ে উঠেছেন। কিন্তু দিলারা? সুদীর্ঘ্য ২১ বছর যে বলতে গেলে লকডাউনের মতো করেই কাটিয়ে দিয়েছে। এই বিষয়টিতো তার মাথায় একবারও আসেনি। তিনি ইচ্ছে করলে কি একবারও দিলারাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতেন না? সবসময়ই কোনোনাকোনো অজুহাতে দিলারাকে তিনি এড়িয়ে চলেছেন। কেন তিনি দিলারাকে এড়িয়ে চলেছেন? সেই কারণটাও তিনি হয়তো জানেন। দিলারা কি জানে? প্রথম মেয়ে হলো, তারপর মেয়েরা ছোট, এরপর মেয়েদের স্কুল, মেয়েদের এক্সাম, মেয়েদের ইউনিভার্সিটি আরো কতকি? পরিবারের দায়িত্ব তো যা পালন দিলারাই করেছে। 
কফিল এবার উঠে দাঁড়ালেন। এই দূরত্ব ঘুচাতে হবে। এই অপরিসীম আনন্দের ভাগিদার তিনিও হতে চান। কেন নয়? কেন তিনি নিজেকে জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় কোলাহল থেকে বঞ্চিত করবেন। কফিলুদ্দিনের কাছে আজ তার নিজের পরিবারকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যবান মনে হয়। মনে মনে করোনাভাইরাস আর লকডাউনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি দ্রুত রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ান। ওখান থেকেই শুরু করতে হবে। এই মুহূর্তে ওখানে দিলারা রয়েছেন।