লন্ডনের ফাঁসির মঞ্চ এবং স্পিকার্স কর্নার

বর্তমান স্পিকার্স কর্নার। ছবি: লেখক
বর্তমান স্পিকার্স কর্নার। ছবি: লেখক

একটা সময়ে লন্ডনের সবচেয়ে বড় পার্ক হাইড পার্কের বিখ্যাত স্পিকার্স কর্নারে যেতাম মাঝেমধ্যে, রোববার৷ কারণ, শুধু রোববার দুপুরের পর থেকে বিকেলের দিকে সেখানে লোকজন আসত স্পিচ দিতে। বিলেতে তখন আমি কিছুটা নতুন। স্পিকার্স কর্নার সম্পর্কে আগেই জানতাম।

পূর্ব লন্ডন থেকে ২৫ নম্বর বাসে চড়ে টটেনহাম কোর্ট রোড স্টেশনের কাছে নামতাম। ওখান থেকে অক্সফোর্ড স্ট্রিট ধরে সোজা মার্বেল আর্চে, যেখানটা দিয়ে হাইড পার্কের ওই উত্তর–পূর্ব কর্নারটায় ঢুকতাম।

স্পিকার্স কর্নার প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো। এখানে যে কেউ যেকোনো বিষয়ের ওপর ওপেন স্পিচ দিতে পারেন, যদি না সেটা আইনের চোখে অপরাধের না হয়।

আড়াই শ বছর আগেও লন্ডনের আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের প্রকাশ্যে ফাঁসি দিত এই স্পিকার্স কর্নারের পাশে। টাইবার্ন গ্যালোজ নামে একটি ফাঁসির মঞ্চ স্থাপন করা হয় ১১৯৬ সালে। ত্রিভুজাকৃতির মঞ্চটি তিনটি সমান মাপের লম্বা গাছ দিয়ে বানানো হয়, যেটাকে ট্রিপল ট্রিও বলা হতো। ১৫৭১ সালে এই মঞ্চকে ভেঙে আরও বড় আকার দেওয়া হয়, যেখানে একসঙ্গে ২০ থেকে ৩০ জনের ফাঁসি দেওয়া যেত। ফাঁসির পাশাপাশি অনেক অপরাধীদের পুড়িয়ে মারা হতো এখানে আর সামরিক বাহিনীর অপরাধীদের গুলি করা হতো এই কর্নারে। ফাঁসি দেওয়ার আগে অপরাধীদের স্পিচ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া থাকত। কেউ নিজের দোষ স্বীকার করত, কেউ নিজেকে নির্দোষ বলত আবার কেউবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমালোচনা করত। তখন অনেক মানুষের কাছে এই ফাঁসি কার্যক্রম একটি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি দর্শকদের জন্য কাঠের তৈরি বসার জায়গার ব্যবস্থা ছিল এবং দর্শকেরা টিকেট কেটে ফাঁসি দেখতে আসত। প্রতিবাদের মুখে ১৭৮৩ সালে এই ফাঁসির মঞ্চ ভেঙে দিয়ে তা জেলখানায় স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু সে পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষের ফাঁসি দেওয়া হয় এই কর্নারে।

উনিশ শতকের মাঝামাঝি স্পিকার্স কর্নার। ছবি: সংগৃহীত
উনিশ শতকের মাঝামাঝি স্পিকার্স কর্নার। ছবি: সংগৃহীত

ফাঁসির মঞ্চ ভেঙে দেওয়ার পর অনেকে তখন এই জায়গায় বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ সমাবেশ করা শুরু করেন; সেই থেকে আস্তে আস্তে এ জায়গাটি স্পিকার্সদের কর্নারে রূপ নিতে থাকল। ১৮৭২ সালে জনগণের চাপে এই অভিনব পদ্ধতি আইন করে দেওয়া হলো যে শহরের এই একটি নির্ধারিত কোনায় যে কেউ তার নিজের যা খুশি বলতে পারবে, প্রচলিত আইন তার ওপর প্রযোজ্য হবে না। এমনি করে অত্যাচারিত মানুষও ধীরে ধীরে নিজেদের কথা বলার একটা সুযোগ পেল। অনেক বোহেমিয়ান, ফিলোসফার, সাধারণ কৌতূহলী মানুষ, লেখক, আর্টিস্ট একসময়ে এখানে তাঁদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারণা ও মতবিনিময়ের সুযোগকে কাজে লাগাতেন। সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক কিছু মানুষ তাদের মনের খোরাক পেত এই কর্নারে এসে।

স্পিকার্স কর্নারের আগে যখন ফাঁসির মঞ্চ ছিল। ছবি: সংগৃহীত
স্পিকার্স কর্নারের আগে যখন ফাঁসির মঞ্চ ছিল। ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব যেমন কার্ল মার্ক্স, ভ্লাদিমির লেনিন, জর্জ ওরয়েল এই কর্নারে তাঁদের স্পিচ দিয়েছেন। এখনো যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মানুষ জড়ো হয় এই কর্নারে, যা পুরো পার্কে ছড়িয়ে যায় বিদ্যুৎ গতিতে। যদিও স্পিকার্স কর্নারের সেই রমরমা দিন আর নেই। এখন ক্যাপিটালিস্ট হওয়ার অন্ধ চাহিদায় বেশির ভাগ মানুষ ছুটছে। কারণ পাশেই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভোগ্যপণ্যের আস্তানা অক্সফোর্ড স্ট্রিট।