খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টের অনুভূতি

১.

জীবন ডায়েরির স্মৃতির পাতায় কত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, পাওয়া না–পাওয়ার অতীত। থাকে সুন্দর কিংবা অসুন্দর, রূঢ় বাস্তবতা। সফলতা, ব্যর্থতা। হাজারো অভিজ্ঞতা—ভালো, খারাপ; কোনোটা অনুভূতিহীন। মিশ্র অভিজ্ঞতা। পথ চলতে একদিকে যেমন অভাবী ভুখানাঙা ও দিন মজুরশ্রেণির মাটির মানুষের সঙ্গে মেশা হয়, অন্যদিকে সমাজের অনেক উঁচু দরের যোগ্যতাসম্পন্ন অথবা বিত্তবান মানুষের সঙ্গে মেশারও অসাধারণ সুযোগ থাকে। বিপদে সহায়তার হাত বাড়ানো খেটে খাওয়া ভুখানাঙা দিনমজুর রিকশাচালকদের কথা মনে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন মফস্বলের মানুষের কথাও মনে পড়ে। খেটে খাওয়া মানুষেরা সালাম তোমাদের, স্যালুট! জীবন ও জীবিকার তাগিদে নিত্যদিনের কাজে কী যে হাড়ভাঙা খাটুনি আর কষ্ট! কজনই–বা আমরা তা অনুধাবন করি? খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টের কী অনুভূতি, তা কি জানি? কষ্টকর কাজে ব্যথা আছে, তবে পরিশ্রমের ফসলে আনন্দ আছে।


২.
খেটে খাওয়া মানুষের নিত্যদিনের পরিশ্রম কী যে কষ্টের হয়, তা বোধ হয় কিছুটা হলেও আজ বুঝতে পারছি। রসহীন রসায়নের শক্ত কিছু পড়া শেখা হয়েছে বলে কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কাটে রসায়ন গবেষণাগারে। পরিশ্রম আছে তাতে, মজাও আছে। রসায়ন বিষয়টিতে আগ্রহ আছে, আর উপার্জনের ব্যাপার তো তো বটেই। ছাত্রজীবনের মধুর দিনগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। জীবন ডায়েরির স্মৃতির পাতায় আছে সেগুলো। কর্মজীবনের এই সময়ে অফিসের কাজ শেষে অবসরে বেশ কিছুদিন ধরে নিজ গার্ডেনে খাটাখাটুনি চলছে। বাগান করার কাজ মহাধুমধামে, নতুন উদ্যোগে। নিজের কাজ। সবজি বাগানের বেড তৈরি করা, মাটিতে লুকিয়ে থাকা আগাছা পরিষ্কার করা, এরপর সেই বেডে নতুন মাটি ভরাট করা। আর বীজ ও গাছ লাগানো। বিস্তর কাজ। এসবে হাত-পায়ের গোড়ালি, কনুই, হাঁটু, কোমর, ঘাড়—সব জায়গায় ব্যথা। শরীরের নাট-বল্টু সব খুলে গেছে মনে হয়। কী যে পরিশ্রম! 

বেশি পরিশ্রম করলেই বা কী। বর্তমান সময়ে আবহাওয়ার হেঁয়ালিতে করোনার দিনগুলো বেশ এলোমেলো। কানাডায় এই বছর এপ্রিল মাসে মনে হয়েছিল আবহাওয়া ভালো হচ্ছে। তাই বাগানের ঘাস পরিষ্কার করে তাতে সবজির বীজ ছিটিয়েছিলাম। আবহাওয়ার হেঁয়ালি খেলায় সেসব বীজের প্রাণ মরে গেছে। মাটি ভেদ করে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি সেগুলো। ব্যতিক্রমী ঠান্ডার কারণে এ বছর মে মাসেও বাগান করা যায়নি। ভেবেছিলাম বাগানে সবজি করে বাজারে যাওয়া কমিয়ে করোনা থেকে দূরে থাকব। পুরোটায় ব্যর্থ।

বাগানের কাজে এই ব্যর্থতায় দমে যায়নি। জুন মাসে সবকিছু নতুন করে শুরু। নতুন উদ্যোমে। বাড়ি ও বাগান তৈরির কাজে প্রয়োজনীয় সবকিছুর সরঞ্জামে ভরা মার্কেট হোম ডিপোট থেকে প্রায় ২০০ ডলারের কাঠ, তারকাঁটা, আর সংযুক্তির জন্য ধাতব পাত কিনে বানানো হলো বেড ফ্রেম। গৃহস্থালির কাজের জন্য অপরিহার্য হাতুড়ি, স্ক্রু ড্রাইভার, আর শোভেল জাতীয় অনেক যন্ত্রপাতি ঘরেই ছিল। এসব অনেক কাজে লাগে। তাই বছরের বিভিন্ন সময়ে ঘুরে ঘুরে কেনা হয়েছে সেগুলো।

৩.
বাগানের বেড ফ্রেমের মধ্যে পুরোনো মাটির কিছুটা তুলে ফেলে দেওয়া হলো। আর অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করে মাটিতে লুকিয়ে থাকা আগাছা ও সেসবের মূল পরিষ্কার করা হলো। শক্ত মাটি, আর কঠিন কাজ! হাতের তালু, কনুই, ঘাড় আর কোমরে চিনচিনে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠি। শীতপ্রধান দেশে ঠান্ডায় থেকে গায়ের যে চামড়া কিছুটা ফ্যাকাশে সাদা হয়েছিল, জুন মাসে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিতে এখন তা পুড়ে গেল। ছোটবেলার সেই শ্যামলা–কালো রং আবার ফিরে পেলাম। প্রবাসে গ্রীষ্মের রোদে পুড়ে আবার সেই কালো ছেলে আমি। প্রচুর ঘাম ঝরেছে শরীর থেকে, সময়মতো পানির তেষ্টা না মেটানোয় মাথায় টনটনে ব্যথাটাও বাড়ল। কষ্টের মধ্যেই মনে পড়ে সেই গান, ‘তোমার হাতপাখার ওই বাতাসে...প্রাণ জুড়িয়ে আসে...।’ কাজের মধ্যে ফিরে তাকাই, সহধর্মিণীর মিষ্টিমুখের হাসি আর এগিয়ে দেওয়া পানিতে শক্তি পায়।

বাগান তৈরি করে সবুজের মাঝে আনন্দ খোঁজা। ছবি: সংগৃহীত
বাগান তৈরি করে সবুজের মাঝে আনন্দ খোঁজা। ছবি: সংগৃহীত

বাগান করায় এই আগ্রহ আর শক্তি পাওয়ার কারণও আছে। দামি জিনিস মাছ–মাংসের বদলে শাক-সবজি হচ্ছে আমার সহধর্মিণীর খুব বেশি প্রিয়। শুনেছি, সুন্দরী মেয়েরা বোকা হয়। তিনি খুব সহজ-সরল এটা নিশ্চিত। তবে কঠোর পরিশ্রমী ও স্বল্পভাষী। আর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স। স্বল্পভাষী হলেও ইভা তাঁর নিজ পরিবারের হোম মিনিস্টার—সবকিছুতে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। বাগান না করে আমার উপায় নেই।

সবজি বাগানের বেড তৈরি করার এক সপ্তাহ আগেই গার্ডেন সেন্টারে ট্রিপল মিক্স আর গোবর মেশানো মাটির অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এক ট্রাক মাটি, প্রায় ৩০০ ডলারের অর্ডার। ঠিক সময়েই পেলাম। প্রতিদিন অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাকেটে বোঝায় করে সেগুলো বাগানের বেডে ছড়িয়ে প্রায় এক সপ্তাহে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হলো। খুব পরিশ্রমের কাজ। পেটের মেদ বেশ কিছুটা ঝরেছে মনে হলো। বেশ কয়েকটি সবজির চাষ শুরু করলাম, এগুলো লালশাক, ডাঁটাশাক, করলা, লাউ, কুমড়া, টমেটো, ঝুকিনি, শিম, বরবটি, মরিচ, বেগুন। চেষ্টা করছি, দেখা যাক কী হয়। খরচ উঠবে না হয়তো, তবে শখের জিনিস বলে কথা।

৪.
বাগানে কাজ করছি, এটা আব্বা জানতে পেরে এখন অনেক খুশি। মা বেঁচে থাকলে অবশ্য বলতেন, আহারে আমার কালো ছোট গুধা, এত কাজের দরকার নেই। মায়েদের মায়ার তুলনা নেই। ছোটবেলায় এসব কাজ থেকে আমি দূরে থাকতাম। দুজন বড় ভাই থাকলে ছোটদের কাজ করা লাগে না। আমি সৌভাগ্যবান।

তখন আশির দশক। ছেলেবেলার সেসব দিনের কথা খুব মনে আছে। শ্যামলা গাত্রবর্ণের ছেলে আমি। প্রখর রোদে বেশি ঘোরাঘুরিতে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে গায়ের রং পুড়ে অনেকটা আফ্রিকানদের মতো লাগত। ইংরেজদের মতো উজ্জ্বল সাদা বর্ণের খুব হ্যান্ডসাম রবিউল ভাই আর জামান ভাইয়ের অনেক আদুরে তাঁদের এই খেলার সাথি। শরীরটা মোটা গড়নের। চেহারাটা তাই একটু নাদুসনুদুস। খালি গা, খালি পা। পরনে একখানা হাফ প্যান্ট থাকত। সারা দিন ধুলোবালি, আর কাদামাটিতে গড়াগড়ি করা। আর খেলা।

খেলায় অবশ্য কেনা কোনো খেলনা থাকত না। বানানো খেলনা। বাঁশ আর কনচি দিয়ে বানানো তরবারি ও গাড়ি, তালপাতা দিয়ে বানানো ঘড়ি ও চশমা, ধানের খড়কে পাটের আঁশ দিয়ে বেঁধে বানানো খেলার বল। সেই তরবারি দিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হতো। আবার কিছু নিয়ে মনোমালিন্যের ফলে ইংরেজ চেহারার বড় ভাইদের মারামারি শুরু হলে সেটা থামাতে আমার তরবারির ব্যবহার হতো। মায়ের বিশেষ যত্নেœবহু বছর এই তরবারিটি রাখা ছিল। কালের গর্ভে কখন হারিয়ে গেছে।

হারিয়ে যায়নি স্মৃতি। রাজশাহীর এক চরাঞ্চলে সবুজের সৃষ্টির পেছনে যে রহস্য, সেটা অনেকটা জানি। সেখানেই কাটিয়েছি ছেলেবেলা। লেখায় ওপরের ছবির সবুজ আমবাগানের উত্তরাধিকার আমি, আর সহোদরেরা। নীরবে–নিভৃতে এ রকম অনেক সবুজ বিপ্লবের সৃষ্টিকারী হলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী একজন জীবনসংগ্রামী মানুষ। স্কুল বয়সী নিজ সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে মাটি কুপিয়ে, অনুর্বর মাটি সরিয়ে, পলিযুক্ত ভালো মাটি অন্য জায়গা থেকে উঠিয়ে, মাথায় বহন করে এনে সেগুলো জমিতে দিয়ে, একটি একটি করে গাছ লাগিয়েই আশির দশকের চরাঞ্চলে এই বিস্তর সবুজ বিপ্লব। জীবনসংগ্রামী, চৌকস আর তীক্ষ্ণèবুদ্ধির এই জ্ঞানী মানুষটি আমার বাবা। রাগী মানুষ, পান থেকে চুন খসলেই রক্ষা নেই। লেখাপড়ায় ভালো না করলে সেদিনের স্কুল বয়সী এই গল্পলেখকের গায়ে রন্না (আসবাব মসৃণ করতে এটা ব্যবহৃত হয়) চালাতে চেয়েছিলেন তিনি। সরকারের মন্ত্রী না হয়েও নিজ এলাকায় আজ মিনিস্টার নামে তাঁর পরিচিতি। উপাধিটা পেয়েছেন মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।

৫.
জীবনে কষ্ট না পেয়ে থাকলে আনন্দের মজাটা অনুভব করা যায় না। দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা, ব্যর্থতা, অপমান—এসব না থাকলে সুখ আর সম্মানের ব্যাপারকে ভোগ করা যায় না। যেমনটা অন্ধকার আছে বলেই আলো কী তার গুরুত্ব বোঝা যায়। কষ্টময় অন্ধকার সময়ের শেষ হলেই আনন্দময় সকালের সোনালি সূর্য ওঠে। স্যালুট, সব দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষদের।


*ড. সাদেকুল ইসলাম পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, টরন্টো, কানাডা।