সাইকেল আউর আওরাত

১.

লাল বাতিতে দাঁড়িয়ে আছি। পেছন থেকে জড়ানো গলায় হাঁক এল, ‘সাইকেল নিয়ে কই যাও?’ ফিরে দেখি, মহল্লার পরিচিত মাতাল। চলতে–ফিরতে সামান্য হাই-হ্যালোর মতো আলাপ। কী ভেবে এক গাল হাসি হেসে সাইকেল ঘুরিয়ে আনলাম তার কাছে। বাসস্টপেজের বেঞ্চিটায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন ভদ্রমহিলা। চোখেমুখে এই সাতসকালে গাঢ় মেকআপ। কড়া লিপস্টিকে বয়সটা ষাট থেকে ধাক্কায় পঞ্চাশে নেমে এসেছে। পরিপাটি ববকাট চুল আর লম্বা ঝুলের ফুলেল স্কার্টের সঙ্গে একেবারেই বেমানান ভঙ্গিতে পায়ের কাছে অ্যাবস্যুলুট ভদকার স্বচ্ছ একটা বোতল অলস গড়াগড়িতে ব্যস্ত। দৃশ্যটা বলেই দিচ্ছে, আর দশজনের মতো বাস ধরার তাড়া নেই বোতলমালিকের। বেঞ্চিতে সে আজকে একাই বসে। অন্য সময় সহমাতাল হিসেবে দু–চারজনকে পাশে ঝিমুতে দেখা যায়। একসঙ্গে চোঁ চোঁ টেনে চুর চুর হয়ে পড়ে না থাকলে মজা কোথায়।

‘তা, তোমার লোকজন কই?’ ভকভকে ধোঁয়া ছেড়ে সে জবাব দিল, ‘নাশতা আর মালপাতি কিনতে গেছে।’ এবার কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘ধোঁয়াটা বড্ড বেশি সাদা। কী টানছ, বলো তো?’ নির্লিপ্ত উত্তর এল, ‘এই ঘাসপাতা আর কি।’ মানে গাঁজার পুরিয়াটুরিয়া–জাতীয় কিছু হবে। আর নাক না গলিয়ে ‘আচ্ছা, খাও মজাসে, আসি এখন’ বলে চলেই যাচ্ছিলাম।

আবার ডাক পড়ল, ‘হেই, হেই, হঠাৎ সাইকেল কেন বললে না যে? মিউনিখের বাস-ট্রেনে কি ঠাডা-গজব পড়েছে?’ কথার ধরনে হাসি চেপে বললাম, ‘গজবই তো। করোনা গজব। আপিশ যেতে ভিড় এড়াতে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছি। আজকেই প্রথম। খাস দিলে দোয়া করে দাও তো।’ দোয়ার বদলে করোনাভাইরাসের বাবার উদ্দেশে দাঁত খিঁচে সে এমন কতগুলো গা হিম করা গালি দিল যে কলিজায় রীতিমতো কাঁপন ধরে গেল। অবশ্য পরমুহূর্তেই চমৎকার সহজ গলায় আশীর্বাদ করে বলল, ‘আস্তে ধীরে চালিয়ো, মেয়ে। লোকে গালি দিলে দিক। ট্রামের নিচে পড়লে কিন্তু নিমেষেই চার টুকরা। আর মাথা থেঁতলে গেলে তো আরও বিচ্ছিরি কাণ্ড। ঘিলুমিলু ছড়িয়ে একাকার, ছ্যাহ্ ছোহ্...।’

আশীর্বাদের বহর আর সেটা বলার বাহার দেখে মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ‘হে হে, তা আর বলতে...।’ ভাঙা একটা দেঁতো হাসি আড়ালে চরম গ্রাফিক আশীর্বাদটা কপাৎ করে গিলে নিলাম। এমন শুভাকাঙ্ক্ষাী আর হয় না। নার্ভাস ভঙ্গিতে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম সিগন্যালে।

২.
মাতালদের অন্তর্দৃষ্টি দারুণ প্রখর। নইলে কি করে বলল যে লোকে গালি দেবে? এই মাত্র একজন ‘চল, ফোট’ বলেছে। অপমান লাগার কথা। কিন্তু লাগছে না। খানিক আগেও দুবার গালি শুনতে হয়েছে। একবার মোড়ের সিগন্যালে। আরেকবার ট্রামের সামনে লাল বাতিতে। বাতি সবুজ হতেই চট করে প্যাডেল মেরে রওনা দিতে পারিনি। সাইকেল লগবগিয়ে এদিক–সেদিক এঁকেবেঁকে কাত হয়ে পড়ার জোগাড়। আর তাতেই বাকি সাইকেলওয়ালা মাইকেলরা সব রেগে টং। মাঝবয়সী এক লোক বলেছে, ‘আরে ভ্যাট! আগে বাড়তে পারে না আবার সাইকেল চালায়!’ আরেকজন গজগজিয়ে উঠেছে, ‘এ্যাই তুমি আন্ধা, না লুলা?’ এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সাইকেলের চাকায় ঠ্যাং দিয়ে ল্যাং মেরে ফসফসিয়ে পগার পার।

এ শহরের লোকজন যে এতটাই দুর্ধর্ষ, কে জানত? এমনিতে গাড়িচালক হিসেবে মিউনিখের লোকদের বেশ বদনাম আছে। কারও পান থেকে চুন খসলেই এরা মিছেমিছি হর্ন চেপে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। নতুন লাইসেন্স পাওয়া নবিশ পেলে তো আরও মজা। আঙুল উঁচিয়ে গালির বন্যা বইয়ে দেয়। তর্জনী, মধম্যা কিছুই বাদ যায় না। ভালোমানুষ চেহারার সাইকেলম্যানরাও যে একই দলের, এই সত্য জেনে কিছুটা মিইয়ে গেলাম।

মাঝপথে এসে ফিরে যাওয়ার মানে হয় না। তা ছাড়া অফিস তো যেতেই হবে। তবে সব খারাপেরই ভালো দিক আছে। খানিক আগেও হালকা তিরতিরে বাতাসে চিন্তার ঘুড়ি এদিক–সেদিক হারিয়ে যাচ্ছিল। এখন সব মনোযোগ পিচঢালা রাস্তার সরলরেখা ধরে চলছে। এ–ও মন্দ কি। বেরিয়েছিলাম দুরু দুরু বুকে টিকটিকি হয়ে। এখন ২০ মিনিটের মাথায় টক-ঝাল গালটাল খেয়ে মোটা চামড়ার কুমির বনে গেছি। কথাটা ভাবতেই লেজ দাবড়ে এঁকেবেঁকে সরসরিয়ে চলতে থাকলাম সরু পথটা ধরে।

ঘাম ছুটে গিয়েছে দেখে অল্প থেমে জ্যাকেট খুলে কাঁধের ছোট্ট ঝোলায় পুরে নিয়েছি। সুতির লাল টকটকে ফতুয়াটা সকালের নরম রোদে ঝিকিয়ে কমলা দেখাচ্ছে। নিজেকে আগুনের গোলা মনে হচ্ছে হঠাৎ। আবার কেউ গাল দিতে আসলে এবার আগুন লাগিয়ে দেব। অনেক হয়েছে তোমাদের দাদাগিরি!

কিন্তু এক ফুঁয়ে আগুনের গোলা নিভিয়ে ফেলতে হল। চোখে পড়ল, চৌরাস্তার মোড়ে খাম্বার কাছে চাকা তোবড়ানো একটা নীল সাইকেল ঠেস দিয়ে রাখা। তাতে ফটোফ্রেমের মতো কী যেন ঝুলছে। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে পুরোটা পড়া গেল। বড় বড় হরফে লেখা ‘প্রিয় অ্যালেক্স, না বলেই চলে গেলে। ওপারে ভালো থেক। তোমার জন্য প্রতিদিন তাজা ফুল।’ তাকিয়ে দেখি সাইকেলের পায়ের কাছে এক গুচ্ছ লাল-সাদা গোলাপ। বুঝি বা এইমাত্র কেউ রেখে গেছে। কে জানে কোন দুর্ঘটনায় অ্যালেক্স মিয়ার ইহলৌকিক কম্ম সব কাবার হয়ে গেছে। অজানা আতঙ্কে ঘেমো হাতে সাইকেলের হাতলটা আরও শক্ত করে ধরলাম। চার কিলোমিটারের পথকে এখন চল্লিশ মাইল লাগছে। কি ফ্যাচাঙেই যে পড়া গেল আজকে।

৩.
সামান্য দুই চাকার সাইকেল চালাতে পারে না, এমন বলদ লোক এই শহরে নেই বললেই চলে। দুর্ভাগ্য, আমি সেই সংখ্যালঘুদের একজন। সেই বছর দু–এক আগে অতি কষ্টে খুঁজে পেতে একটা কোর্সে ঢুকেছিলাম। চার দিন প্যাডেল মারা শিখিয়ে আশি ইউরো কেড়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আমিও ঘরে ফিরে যা যা শেখা হয়েছিল, সব ইচ্ছে করে মাথা ঝাঁকিয়ে ভুলে গেলাম। তারও এক বছর পর একরকম অনিচ্ছায় এ দোকান সে দোকানে ধরনা দিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মাল জুটিয়ে ফেললাম। এখানেই শেষ না। আলসেমির কুখ্যাতিটা আরও একবার সত্যি প্রমাণ করে বছর ঘুরিয়ে সাইকেলটা বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে ছয় ইঞ্চি ধুলোর পরত ফেলে নিষ্ঠুর আত্মতৃপ্তি পেলাম যেন। সাইকেল অধ্যায়ের ইতি প্রায় এক রকম ঘটেই গিয়েছিল।

তাই ভাবছি, কোনো রকম টেস্ট ট্রায়াল ছাড়াই আজকে এমন হঠাৎ করে রাস্তায় নেমে যাওয়া কি ঠিক হলো। করোনার এমন দুর্দিনে বাস-ট্রেনের ভিড়-ভাড়াক্কা আর হাঁচি-কাশির ছোঁয়াচ এড়ানো যাচ্ছে বটে কিন্তু অ্যালেক্স ভাইয়ের মতো বেখেয়ালে একটা অঘটন ঘটলে তখন কী হবে? হঠাৎ সংবিত কেড়ে কে যেন পেছন থেকে বলে উঠল, ‘গো, গো, গো। থেমে গেলেই চিৎপটাং।’ বুঝে ওঠার আগেই লোকটা দারুণ গতিতে ওভারটেক করে উধাও হয়ে গেল। সে লোক মিলিয়ে গেলেও কথাটা মাথায় ঘুরতেই থাকল, ‘থেমে গেলেই চিৎপটাং’। আগেও কোথায় যেন শুনেছি। আইনস্টাইন বা তেমন তাবড় কেউ বলেছিলেন। ‘জীবন আর সাইকেল একই রকম। তাল রাখতে ছুটে চলার বিকল্প নেই।’ নইলে নাকি পপাৎ ধরণিতল।

কিন্তু আইনস্টাইন তো ওভার অ্যাচিভার টাইপ লোক ছিল। জীবন নিয়ে অমন উচ্চাশা–টুচ্চাশা কিচ্ছু নেই আমার। নিতান্তই এলেবেলে ম্যাংগো পাবলিক। নাহ, পা দুটি টনটনিয়ে উঠছে। রাস্তাটা সামান্য ঢালু হতেই আইনস্টাইনের অমৃত বাণীর নিকুচি করে প্যাডেল ঘোরানোতে আলাব্বু দিলাম। সাইকেল দেখি আপনা–আপনি বাতাসে শিস তুলে দুপেয়ে পঙ্খীরাজ হয়ে ছুটে চলছে। আইনস্টাইনের কথায় আসলে গলদ আছে। জীবনের সাইকেল শুধু গাধার মতো চালিয়ে গেলেই হবে না। মাঝেমধ্যে সুযোগ খুঁজে খানিকটা জিরিয়ে নিতে হয়। এত ইঁদুর দৌড়ের আছেটা কি? তা ছাড়া কোথায় আইনস্টাইন আর আমি কোথাকার কোন ছার। বড় মানুষের বড় কথা ছোট মানুষের ছোট জীবনে খাটে না সব সময়।

৪.
রাস্তাটা গাছের ছায়ায় ছাওয়া। সবুজ পাতার ফোকর গলে রোদ হানা দিয়ে চোখ অন্ধ করে দিতে চাইছে যেন। হুঁশিয়ার হয়ে চাকা ঘোরাচ্ছি। ফুটপাতের সমান্তরালে মসৃণ পথ। সাইকেল ছাড়া আর কিছুর চলা নিষেধ। গাড়ি ঘোড়ার সাধ্যি নেই গাছের বেড়া ডিঙিয়ে হামলে পড়ে সামনে। নিরিবিলি পথটায় উঠে এসে বেশ নির্ভয় লাগছে। ঢং ঢং শব্দ ভেসে আসছে পুরোনো গির্জার চূড়া থেকে। চিরকালের খাঁ খাঁ করা চার্চটার সামনে আজকে দেখি ফুলের তোড়া আর মোমবাতির ভিড়। মহামারির অদ্ভুতুড়ে পৃথিবীতে ভরসার জায়গা হারিয়ে লোকে আবার শিকড়ে ফিরে আসছে।

গির্জার পাশে সারি সারি পুরোনো দালান। মিউনিখ শহরটা বেশ পুরোনো। দারুণ একটা বনেদি ভাব আছে সেকেলে ইট–কাঠের চেহারায়। লাল টালির গায়ে গায়ে জোড়া লাগানো কাঠামোতে খাঁটি ইউরোপীয় ট্রেডমার্ক আভিজাত্য। গোঁড়া ক্যাথলিক ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে অনেক দালানের খাঁজে আবার সাধুসন্তদের মূর্তি সাজানো। সেগুলোর কোনোটা সযত্নে ধাতব তারের জাল দিয়ে ঘিরে রাখা। কিন্তু কোনোভাবে একটা সাধু বাবাও যদি হুরুমুড়িয়ে ঘাড়ে পড়ে, তাহলে আর রক্ষা নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভবলীলা সাঙ্গ করে স্বর্গপানে রওনা দিতে হবে। সাধু বাবাদের থেকে বেশ খানিকটা তফাতে চলছি দেখে নিশ্চিন্ত লাগছে।

সময়টা বেশ নিরূপদ্রুবই কাটছিল। নতুন এক উপদ্রুব উদয় হল। উল্টো দিক থেকে বাই বাই শাঁই শাঁই সাইকেল আসছে। তবে আসল উপদ্রুব দ্বিচক্রযানগুলো না। বরং তার সওয়ারি। তাদের আঁটোসাঁটো টি–শার্টের ভেতর থেকে সিক্স প্যাক তেড়েফুড়ে বেরোচ্ছে। আর তাতেই এই নবিশের সাইকেলের হ্যান্ডেল বিগড়ে যাচ্ছে। প্রতি ছয়জনের পাঁচজনেরই সিক্স প্যাক থাকলে এই জার্মান দেশে সব মিলিয়ে এমন কত লাখো গ্রিক দেবতা আছে, ভাবতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।

শুধু কি তা–ই? ভালো করে ফুটপাত বরাবর তাকিয়ে দেখি, লোকজন সেখানে উসাইন বোল্টের বেগে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। পুরুষেরা যেমন সুঠাম, নারীরা তেমনি সুগঠিত, সুললিত। বিন্দু বিন্দু ঘামে সামর্থ্য আর সৌন্দর্য মিশে একাকার। শহরের সব ভাস্কর্য কি আজকে আড়মোড়া ভেঙে পথে নেমে এল? আর একটা দেশের গড়পড়তা সবার শরীর সৈনিকের মতো পেটানো হলে হাজার ঝড়ঝঞ্জা এলেও সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আপনা থেকেই তৈরি হয়। তাই বুঝি করোনাযুদ্ধটা সবাই মিলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে জিতে নিল এবার।

মোড়ের কাছে এসে পথ বেঁকে গেছে। এবার পার্কের কোল ঘেঁষে যেতে হবে। এই পথ জনশূন্য। কতগুলো বেরসিক হোৎকা দাঁড়কাক কর্কশ ডেকে চলছে, ‘ক্রা ক্রা...’। একেবারে লোক নেই বললে ভুল হবে। অল্প বয়সী মায়েরা বাচ্চাদের সকালের রোদ খাওয়াতে স্ট্রলার নিয়ে বেরিয়েছে। পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে তেমনি এক রোদখেকোকে আড়চোখে হালকা ভেঙচি কেটে দুষ্ট হাসলাম মিটমিটিয়ে। বেচারা দুষ্টুমিটা ঠিক ধরতে পারল না। তার বদলে এমন চিল চিৎকার জুড়ে দিল যে কাকগুলো ডানা ঝাপটিয়ে হুটপুটিয়ে পালাল। বাচ্চাকে কোন বেয়াদপ ভয় দেখিয়েছে, তাকে খুঁজতে মাকে চারপাশটা দ্রুত স্ক্যান করতে দেখা গেল। জোরসে প্যাডেল মেরে কালপ্রিট আমি ফুড়ুত করে উড়ে গেলাম। ছোট শিশুর মায়ের হাতে কিল খেলে আজকে সাইকেল চালানো বীরত্ব ঠুস করে ফুটে যাবে।

৫.
সব পথেরই শেষ আছে-এই আপ্তবাক্য প্রমাণ করে ম্যাক্স ওয়েবার প্লাৎজের ক্যাম্পাসটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ছোট্ট একটা মুশকিল। নিরিবিলি রাস্তাটা ফুরিয়ে গিয়ে গাড়িঘোড়ার ব্যস্তসমস্ত রাজপথে গিয়ে পড়েছে। জোরে একটা দম নিয়ে নেমে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গেই আলাদিনের দৈত্য আকারের এক লরি ‘প্যাঁওও...’ করে ভেঁপু বাজিয়ে কান ঘেঁষে চলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য জমে কাঠ হয়ে গেলাম। জার্মান ‘মান’ কোম্পানির সুবিশাল এই লরিগুলো সেই রকম মরদ এক একটা। তার পাশে লিকলিকে আওরাত আমি তেমনি তুচ্ছ আর ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র, ভীতু, ক্যাবলাকান্ত আমিই যে গরিয়ে গড়িয়ে কীভাবে চলে এসেছি সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেলে সওয়ার হয়ে, সে-ই এক বিস্ময়। বিচিত্র একটা হাসি ফুটিয়ে অজান্তেই নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম।

দিন যে কোথা দিয়ে উড়ে গেল হাজারটা কাজে কর্মে, খেয়ালই ছিল না। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে মনের ভুলে পাতালরেলের স্টেশন বরাবর পা চালিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়ালাম। ছাউনিতে সাইকেলটা ঠায়ে দাঁড়িয়ে। কালো ধাতব শরীরটাকে এক পলকের জন্য কালো পশমে ঢাকা টগবগে ঘোড়া বলে ভুল হলো যেন। আহ্, নিজের একটা বাহন! আনন্দটাই অন্য রকম। একলাফে উঠে বসলাম কালো ঘোড়ার পিঠে। পিচঢালা মেঘ কেটে প্রায় উড়ে চললাম ফিরতি পথে। দুই চাকায় ভর দিয়ে নতুন এক স্বাধীনতার টিকিট কিনলাম যেন আজকে।

কখন যে বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি, খেয়ালই হয়নি। উদগ্রীব একটা কণ্ঠ ডাক দিয়ে থামাল হঠাৎ, ‘সব ঠিক ছিল তো?’ তাকিয়ে দেখি সকালের সেই পাড়াতুতো মাতাল ভদ্রমহিলা। ঘোরলাগা লাল টকটকে রক্তজবা চোখ আগ্রহে চকচক করছে। অন্য সময় হলে হয়তো দূর থেকে হাত নেড়েই এড়িয়ে যেতাম। বেসামাল অবস্থা বলে কথা। কিন্তু এখন দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এসে ভর করেছে কাঁধে। খুব উৎসাহে এগিয়ে গেলাম, ‘হ্যাঁ ঠিক তো ঠিক, একেবারে ঠিকের বাপ ছিল।’ তবুও সন্দিগ্ধ প্রশ্ন শোনা গেল, ‘ঘিলুটিলু বেরিয়ে যায়নি বলছ তাহলে?’

প্রমাণ দিতে এক ঝটকায় হেলমেট খুলে ফেললাম। এরপর মাথা হাতড়ে চুয়ে পড়া ঘিলুর সন্ধান না পেয়ে ফিক করে হেসে জানালাম, ‘না, খুলির ভেতরেই সব আছে দেখছি।’ উত্তরে পাড়াতুতো পাঁড় মাতাল ফোস করে হাঁপ ছেড়ে হাতের বোতলটা দেখিয়ে বলে বসল, ‘জানো, তোমার চিন্তায় বাড়তি এই বোতলটা শেষ করেছি। খালি ভেবেছি হাবাগোবা বিদেশি মেয়েটা জ্যান্ত ফিরতে পারবে তো। ভালোয় ভালোয় এসেছ। এখন এই খুশিতে আরেকবার হয়ে যাক।’ তাকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাতের পুঁটলি থেকে সবুজ আরেকটা মাল বের করতে দেখা গেল।

বিচিত্র পৃথিবীর মমতার ধরনগুলোও বিচিত্র। পড়ন্ত বিকেলে উষ্ণ মায়ার রেশ নিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকলাম। বোকাসোকা বিদেশি মেয়েটা আর তার হাতে ধরা সাইকেলের ছায়াটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকল যেন। কোথায় যেন কোন সবুজ বোতলের ছিপি গড়িয়ে পড়লো টুংটাং শব্দে।

*গবেষক: ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি