ফে দ ক

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বৃষ্টি সব সময়ই আমার ভালো লাগে। আজও সকাল থেকেই ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু আজ আমার মন ভালো নেই। সকাল হলেই আবার অফিসে যেতে হবে, যতবারই মনে পড়ে, ততবারই মন খারাপ হয়ে যায়। কেন যে বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টি হয় না। তার ওপর পাশের বাড়ির মোখলেস সাহেব নাকি আবার বিয়ে করছেন। যেভাবে তার বউয়ের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাতে অচিরেই ওনার বাড়ি মহিলা সমিতিতে পরিণত হবে বলে মনে হচ্ছে। মোখলেস সাহেবের বয়স ৪৬ হবে। দেখতে অনেকটা বাংলা ছবির অভিনেতা কাবিলার মতো। কথায় খুব পটু। চোখে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু সব সময় চশমা পরে থাকেন। কোনো এক নারী নাকি তাঁকে বলেছিলেন, মেয়েরা চশমা পরা ছেলেদের অধিক পছন্দ করে। তারপর থেকেই ওনার এই চশমাপ্রীতি।

বরাবরের মতো এবারও মোখলেস সাহেবের হবু বউয়ের সঙ্গে পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে। মোখলেস সাহেব ইদানীং বেশির ভাগ সময়ই ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকেন। আমাকে দেখলেই বলেন, ‘বুঝলা মিয়া, আমি তো এখন ফেসবুক সেলিব্রেটি। আমি একটা স্ট্যাটাস দিলেই মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে, লাইক–কমেন্টর বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। বড়ই ভালো লাগে।’ বলতে গিয়ে তার চোখ ছলছল করে, কিছুটা গর্বও অনুভব করেন তিনি।

আজকাল সারা দিনই ফেসবুকে থাকেন মোখলেস সাহেব। এমনকি ঘুমালেও স্ট্যাটাস দেন, ‘আমি এখন ঘুমাচ্ছি।’ মানুষ ঘুমন্ত অবস্থায় আবার কীভাবে স্ট্যাটাস দেয়, এটা একটি বিরাট গবেষণার বিষয়। ফেসবুকের খুব কমন স্ট্যাটাস হচ্ছে ‘আজ আমার মন ভালো নেই’। কিছুদিন আগেই ফেসবুকের মাধ্যমে ঢাকার ভূতের গলির বাসিন্দা জব্বার মিয়ার সঙ্গে আমেরিকা নিবাসী রাজকুমারী ক্রিস্টিনার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে পরিণয়, তারপর সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে রাজকুমারী ক্রিস্টিনা আমেরিকা থেকে এসে বাংলাদেশের জব্বার মিয়াকে বিয়ে করে আমেরিকায় নিয়ে যান। মোখলেস সাহেবের ধারণা, তার ক্ষেত্রেও একদিন এমন হবে। সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একবার না পারিলে দেখো শতবার, এই নীতিতে এগোচ্ছেন। তবে প্রতিবারই নিরাশ হন। মোখলেস সাহেবের আজ মন অত্যধিক ভালো। গতকাল ফেসবুকে তার এক স্ট্যাটাস থেকে প্রায় ৬০০–এর মতো লাইক পড়েছে। এর মধ্যে ৫০০–ই নারী ফলোয়ার। নারীদের বেশির ভাগ লাইক–কমেন্টসে তিনি খুব অনুপ্রেরণা পান। ছেলেদের লাইক কমেন্ট থেকেও তার অনুপ্রেরণা পাওয়া উচিত, কিন্তু কী কারণে যেন তিনি তা পান না। পাওয়ার দরকারও মনে করেন না। ফেসবুক তাঁকে ইদানীং অতিরিক্ত নারীপ্রেমী করে দিচ্ছে বোধ হয়।

বাড়িতেও মোখলেস সাহেব ল্যাপটপ অন করে ঘুমান। তার স্ত্রী এসে মাঝেমধ্যে যন্ত্রণা করেন। ইদানীং এই মহিলাকে তার খুবই বিরক্তিকর মনে হয়। সারা দিন কানের কাছে বেহুদা প্যানপ্যানানি। তার স্ত্রী তাকে বলেন, ‘এই সারা দিন কম্পিউটারে কী? লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো ইয়াং মেয়েদের ছোট ড্রেস পরা ছবি দেখো, তোমার লজ্জা করে না? যত বুড়া হচ্ছো, ততই ক্যারেক্টার লুজ হচ্ছে।’ মোখলেস সাহেব খুবই বিরক্তির ভাব নিয়ে বললেন, ‘ফালতু কথা একদম বলবে না। মেয়েদের প্রতি যে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সেটা তো তোমার অজানা থাকার কথা নয়। দেখো না তোমাকে দেখলেই বিরক্ত হই।’

মোখলেস সাহেবের স্ত্রীও কম যান না। বিচিত্র সব মুখভঙ্গি করে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা তার নিত্যদিনের কাজ। তার ওপর আবার নতুন উপদ্রব শুরু হয়েছে কথায় কথায় ফেসবুক লাইভে যাওয়া। গতকাল বেলা দুইটায় ফেসবুক ওপেন করতেই দেখি বিউটি কুইন বিলকিস (মোখলেস সাহেবের স্ত্রীর ফেসবুক আইডি) লাইভ করছেন। তিনি কীভাবে শর্ষের তেলে বেগুন ভাজি করছেন, সেটা লাইভে দেখাচ্ছেন। আমি তার লাইভে যুক্ত হয়ে একটি লাইক দিতেই তিনি ও প্রান্ত হতে খুশিতে চিৎকার করে বললেন, ‘ভাই, আগামীকাল কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ রান্না লাইভ করব, দেখতে ভুলবেন না যেন।’ আমি তাড়াতাড়ি লাইভ থেকে বেরিয়ে গেলাম। শুনেছি এই ভদ্রমহিলা নাকি প্রতিদিন বিউটি পারলার থেকে সাজেন শুধু এই লাইভ করার জন্য। তার ভিউয়ার্স আবার প্রায় ৫ হাজার। এক ভদ্রমহিলা গরম তেলে বেগুন ভাজি করছেন আর ৫ হাজার আমজনতা কাজকর্ম ফেলে তা বসে বসে লাইভে দেখছে। কী অদ্ভুত বিচিত্র এই দেশ। মাঝেমধ্যেই ভাবি, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুলের সময় যদি এই ফেসবুক থাকত এবং তাঁরা যদি তাঁদের গান–কবিতা লেখার পর ফেসবুকে পোস্ট করতেন, তাহলে লাইক এবং কমেন্টসের সংখ্যা কী পরিমাণ দাঁড়াত!

আমার কাছে বিরাট এক যন্ত্রণার নাম এই ফেসবুক। কিছুদিন আগে মধ্যরাতে হঠাৎ মোবাইলে টুং শব্দে ঘুম ভাঙতেই দেখি একজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। মহাবিরক্ত হয়ে ফেসবুক ওপেন করে দেখি, যে আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে, তার নাম angry birds. পাখিরাও আজকাল ফেসবুক চালায় নাকি, তা–ও আবার বিরক্ত পাখি। আজকাল অনেকেই ফেসবুকে ফেক আইডি ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছেলেরা এসব আইডি ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে সকালে অফিস যাওয়ার মুহূর্তে দেখি খালার ফোন। খালা ওপাশ থেকে ভয়ংকরভাবে ফিসফিস করে বলছে, ‘তুই কোথায়? তাড়াতাড়ি বাসায় আয়, তোর খালুর প্রেশার অনেক বেড়েছে।’ আমি বললাম, হঠাৎ প্রেশার বাড়ল কেন। খালা বলল, ‘তোর খালুকে এক ব্যক্তি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, তার নাম খাইছি তোরে।’ খালু আবার খুব ভীতু স্বভাবের লোক। অল্পতেই ঘাবড়ে যান। খালুর বায়িং হাউসের ব্যবসা। তার ধারণা, পাড়ার মাস্তানেরা ওই ফেক আইডি থেকে তাকে এমন রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। অদ্ভুত সব ফেক আইডির বাহার আজকাল ফেসবুকে। বোকা ছেলে, মেঘবালিকা, ডিজে কুদ্দুস, অচেনা পথের পথিক, অবুঝ মন, এলিয়েন জাহাংগীর, কালা ভুনা, চুদুরবুদুর শামসু, ঝাকানাকা ইদ্রিস, এঞ্জেল ফারিয়া, জেল থেকে বলছি—এ রকম আরও অনেকে নামে–বেনামে আইডি খুলে মানুষকে বিরক্ত করে। অনেকে আবার প্রোফাইল লক করেও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। এ ধরনের বিচিত্র পদার্থদের ছবি ছাড়া নাম, বয়স, লিঙ্গ, আকৃতি, কাঠামো, ওজন কিছুই অনুমান করা যায় না। এরা ভাবে, পৃথিবীর মধ্যে তেনারাই সবচেয়ে চালাক আর বাকি সব বোকা। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদকের মতো অচিরেই ফেদক (ফেইক আইডি দমন কমিশন) খুলে চিরুনি অভিযান চালাতে পারলে ফেসবুকের আকাশ ফেক আইডিমুক্ত হতো।

আমার বেশির ভাগ লেখাই আমার এলোমেলো ভাবনা, কল্পনা ও বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে এবং কিছুটা সংগৃহীত। কাউকে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। যদি কেউ আঘাত পেয়েই যান, তাহলে ক্ষতস্থানে মান্নান মিয়ার তিতাস মলম লাগাতে ভুলবেন না যেন। পরিশেষে চশমা পরিয়া একটি স্থিরচিত্র আপলোড করার লোভ আর সামলানো গেল না।