পুরোনো সেই খেলার কথা

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

সকালে ঘুম থেকে উঠেই চোখে পড়ত বাড়ির সামনের বেড়া কলমির ঝোপের দিকে, সেখান থেকে ভেসে আসত শালিকের ডাক। পাশের পুকুরে দেখতাম বকের দল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে শিকার ধরবে বলে। বেড়া কলমির জঙ্গল পেরিয়ে ছিল ভিক্টোরিয়া মাঠ, মাঠ পেরিয়েই ছিল আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে—বাঁকা নদী। তখন বাঁকা নদীতে স্বচ্ছ পরিষ্কার জল বইত সারা বছর ধরে। গ্রীষ্মের শুরুতে পড়া শেষ করেই বন্ধুদের সঙ্গে ঝাঁপাতাম বাঁকা নদীতে। চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাপাদাপি। যতক্ষণ না বাড়ির লোক এসে নিয়ে যেত।

একটা সময় সবুজ পরিবেশ ছিল শহরজুড়ে। তখনো কম্পিউটার বা স্মাট‌ফোন আসেনি। স্কুল শেষে রোজ বিকেলে মাঠজুড়ে চলত খেলা। কত রকমের খেলা আর তার পূর্বপ্রস্তুতি সেসব ফসিল হয়ে গেছে। শহরে তখন গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে বসত আলাদা খেলার আসর। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ির সামনে বড় গাছটির নিচে চলত গুলি (মার্বেল) খেলা। অনেক রকম তার ভাগ চেলে, টোক্কা, আটে, জোর-বি আরও অনেক কিছু। আটে খেলায় মাটি খুঁড়ে তৈরি হতো গাব। খেলোয়াড়দের ওই গাব লক্ষ্য করে গুলি চালতে হতো। যার গুলি গাবের কাছে পৌঁছাত, সে জয়ী হতো। দুপুরে মায়ের চোখ এড়িয়ে গুলি খেলার জন্য ঘর থেকে বেরোতাম। কোনো বন্ধুর সঙ্গো দেখা হলেই সে বলত গুলি খেলবি? আমি কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সে বলে উঠত ‘হেই লাস্ট’ অথাৎ সে সবার শেষে গুলি চালবে, অন্য আরেক বন্ধু বলে উঠত ‘তারেঙ্গা’ অর্থাৎ শেষের আগে সে গুলি চালবে। ব্যস শুরু হয়ে যেত খেলা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যেত শেষ হতে।

সন্ধ্যায় বড় দিদির তত্ত্বাবধানে শুরু হতো পড়া। লোডশেডিং মানে ভূতের গল্প আর দেয়ালজুড়ে ছায়া। হাতের কারসাজিতে হারিকেনের আলোয় দেয়ালজুড়ে হরিণ, খোরগোশ, ছাগল। পড়তে বসে সবচেয়ে মোটা বইটা নিয়ে শুরু হতো ‘বুক ক্রিকেট’—পাতা উল্টে চার, ছয়, আর শেষে শূন্য থাকলে আউট। গাভাস্কার, কপিলদের রেকর্ড ভাঙত হামেশাই। খাতার শেষ পাতায় কাটাকুটি খেলা।

বর্ধমান মানে প্রত্যয় জানা না থাকলেও ইংরেজিতে লিখতে হলে ‘বার্ডওয়ান’ হয়ে যায়, খেয়াল থাকত ঠিকই। বর্ধমান আর বার্মিংহাম যখন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে এক হয়ে যেত না, ইচ্ছে করলেই প্রবাসী মানুষটাকে যখন ওয়েবক্যামে দেখা যেত না...টেম্পলরান বা ক্যান্ডিক্রাসের জায়গায় খেলা ছিল অনেক রকম।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের প্যাকেট কেটে হতো তাস। তার মূল্যও ধার্য হতো কোনোটা দশ, কোনোটা এক শ, বা এক হাজার। একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে টালি ভেঙে তৈরি বাট্টুল ছোড়া হতো। যে প্রথমে ছুড়ত সে বাজি ধরত। অন্যজন তার বাট্টুল ছুড়ে তার কাছে এক বিদ্যার মাপে পৌঁছালে জয়ী হতো অন্যথায় পরাজিত হয়ে বাজি হারত। অরেকটি খেলা ছিল সতলিয়া। পরিত্যক্ত টালি জড়ো করে ছোট ছোট করে ভেঙে সাতটি ঘুঁটি তৈরি করা হতো। তারপর নিচ থেকে ওপরে পরপর সাজানো হতো। একজন টিপ করে ছুড়ে মারবে বল। বল লেগে টালি এলোমেলো। সেই ছিটকে যাওয়া বল একদল কুড়িয়ে আনতে যাওয়ার আগে অন্য দল যদি টালিগুলো একই রকম সাজিয়ে ফেলতে পারে তা হলে ভালো। নয়তো ছুড়ে মারা বল যদি অন্য দলের কোনো খেলোয়াড়ের গায়ে লাগে সে দল হবে আউট।

গ্রামবাংলায় এখনো আচমকা দেখা যায়, মস্ত ফ্ল্যাটগুলো যখন আকাশ ঢেকে দেয়নি। ডালপালা নিয়ে গাছগুলো যখন পাড়াজুড়ে থাকত...শীতকালে মফস্বলে চোরকাঁটা আর পাঁচিল ঘেঁষে কাঁটাফল তখনো হতো.. খেলা ছিল অনেক রকম ইকরি-মিকরি, ডাংগুলি, বউ-বাসন্তী, কানামাছি, চোর–পুলিশ, এলাটিং-বেলাটিং, কিতকিত, ধাপসা, ঝালঝাপাটি প্রভৃতি। মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল কিতকিতের একটু পরিশীলিত ভার্সন ‘লেম্যান’—এক পায়ে ধাওয়া করে নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে অন্যজনকে আউট করতে হবে। পরবর্তীকালে সংসারে শাশুড়ি, ননদ-জায়ের মধ্যে যে খেলা ধারাবাহিক। এলাটিং-বেলাটিং শৈল/ কিসের খবর আইল/ রাজামশাই, রাজামশাই একটি বালিকা চাইল—রাজামশাইয়ের ডাকে বালিকারা নিরাপদেই থাকত। সেসব খেলায় শহরের আনাচকানাচে ভরে যেত। লুকিয়ে থাকা জিনিস খুঁজতে হতো। লুকিয়ে রাখা জিনিসের কাছে গেলে শুনতে হতো গরম আর দূরে গেলে ঠান্ডা। সেসব খেলোয়াড় মেয়েরা এখন পাস বই বা ছেলের মার্কশিট গুছিয়ে রাখেন। বর্ষায় অনবরত বৃষ্টির মধ্যে চলত ফুটবল। নিজেকে ম্যারাডোনা বা প্লাতিনি ভেবে চলত দাপাদাপি। মনে আছে ’৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের মহড়া। জার্মানি–আর্জেন্টিনায় ভাগ হয়েছিলাম দুই দলে। যেন ফাইনালের আগেই ফাইনাল।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পুজো মানেই পটকা। ধূপকাঠির নিচে পটকা রেখে দিয়ে অনেকক্ষণের অপেক্ষা। নাম দেওয়া হতো টাইমবোমা। নারকেল মালাইয়ের নিচে সেট করা হতো। যা ফাটার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যেত মালাই অথবা ছিটকে কোথায় পড়ত খুঁজে পাওয়া যেত না। দেয়ালে দাগ দিয়ে টানা উইকেট, চটি দিয়ে ঘেরা বাউন্ডারি। ছক্কা মারলেই আউট। বিকেলজুড়ে শর্টপিচ ক্রিকেট। ক্রিকেট তো নয় আসলে হিরো হওয়ার আয়োজন। একটা বাউন্ডারি বা ডিরেক্ট হিট করতে পারলেই পাশের ছাদে মেয়েলি আড্ডায় কদর বেড়ে যেত।

তখন ফাইনাল পরীক্ষা হতো নভেম্বর মাসের শেষে। রেজাল্ট বের হতো ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে। পরীক্ষা শেষে সন্ধ্যাবেলায় চলত লুকোচুরি খেলা—আলো–আঁধারিতে ঝুল মেখে আলমারির পেছনে। ধাপ্পা দেওয়ার অপেক্ষা। চৌকির তলায়, আলনার পেছনে সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে থাকা। একই ঘর আর সেখানে ঘুরে ঘুরে রোজ নতুন নতুন লুকানোর জায়গা আবিষ্কার। শীতকাল মানে পিকনিক, আর পিকনিক মানেই প্রান্তিক বা ডিভিসিতে দল বেঁধে গিয়ে রেঁধে খাওয়া। এত কিছু না হলেও পড়ার মধ্যেই আলুসেদ্ধ করে নুন–লঙ্কা দিয়ে মেখে খাওয়া। তারপরই অদ্ভুত এক খেলা ঝালঝাপটা। খেলা হয় সাত থেকে দশজন মিলে। একজন বাদে অন্যরা বড় গাছে ওঠে। একজন নিচে থাকে যাকে তাকে ঝালঝাপটা খাটতে হয়। তার উদ্দেশ্য হলো অন্য কোনো খেলোয়াড়কে গাছের নিচে থাকা অবস্থায় ছুঁয়ে দেওয়া। যাকে ছোঁয়া হলো সে মোড় হয়ে যায়। গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়লে মোড় করা যায় না। ঝাপটা খাটা দীর্ঘক্ষণ কাউকে ছুঁতে না পারলে শাস্তি হিসেবে দাঁতে খড় কাটতে হয় বা তার সঙ্গে পিঁপড়ের বিয়ে দেওয়া হয়। বড়দিনের ছুটিতে চলত ঘুড়ি ওড়ানো বা কেটে যাওয়া ঘুড়ির পেছনে ধাওয়া করতে করতে হাত–পা কেটে বাড়ি ফেরা। ছোড়দির সঙ্গে খেলতে যেতাম ধাপসা। ছেলেরা একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে। প্রতিদল থেকে একজন করে অপর দলের দিকে ‘কিতকিত’ বা ‘চু-উউ’ বলতে বলতে ধেয়ে গিয়ে ছুঁয়ে আসা। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা ধরে ফেললে বা দম ফুরিয়ে গেলে আউট।

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পাড়াজুড়ে হইচই করে ছোটাছুটির সেসব দিন ফুড়িয়েছে। হোলির দিন রং গুলে দাঁড়িয়ে থাকা। নিশানায় এলেই গায়ে দিয়ে দেওয়া হবে। মেজদাকে দেখতাম কে রং দিবি দে বলে বসে পড়ত। একসঙ্গে সবার রং গিয়ে পড়ত ওর গায়ে। মুহূর্তে চেনা মানুষ হয়ে যেত অচেনা। পাল্টে গেছে পৃথিবী, হারিয়ে গেছে গ্রামের ধন্যি মেয়েরা। টিভি, নাচ, গান, সাঁতার, অঙ্কন, কম্পিউটার, স্মার্টফোন, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ চুরি করেছে শৈশবকে।