অনামিকায় অঙ্গুরীয়

তার হাতের অনামিকায় অঙ্গুরীয় আছে কি না, দেখতে ব্যাকুল হয়ে আছি।

তার এই একটিমাত্র আঙুলে কোনো রিং দেখতে চাই না। আরও কত আঙুল তো আছে। হাত-পায়ের অন্য উনিশ আঙুলে অঙ্গুরীয় পরে বসে থাকুক। কিন্তু অনামিকায় যেন না থাকে। এই একটি রিং আমার স্বপ্ন-জগতের বিচরণ থামিয়ে দেবে।

নিউজফিডে মেয়েটির একটি ছবি ভেসে উঠেছিল। আমি দেখেই থমকে গেলাম। মেয়েটি অচেনা হলেও মনে হলো তাকে আমি চিনি। আমার মনোজগতে বাস করা মেয়েটির সঙ্গে এই মেয়েটির অদ্ভুত মিল।

এফবিআইয়ের মতো অনুসন্ধান চালিয়ে দেখি মেয়েটি সাজিদের মিউচুয়াল ফ্রেন্ড। তাদের মধ্যে সিকি পরিমাণ জানাশোনাও আছে। তবে মেয়েটির ব্যক্তিগত কোনো তথ্য তার জানা নেই।

আমি উন্মত্ত হয়ে খুঁজতে লাগলাম কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তর। তার মনের আকাশে কি কেউ প্রবেশ করেছে? নাকি নিঃসঙ্গতাই তার একমাত্র সঙ্গী! এ ক্ষেত্রে চরম স্বার্থপরতার দেয়ালে আটকে গেল চিন্তাধারা। মেয়েটিকে নিঃসঙ্গতা আলিঙ্গন করে রাখুক, আর বেশি উদার হতে পারিনি।

প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো, তার অনামিকাই হতে পারে উত্তরদাতা। নিঃসঙ্গতার চিহ্ন বহন করবে রিংবিহীন অনামিকা। না হলে অনামিকায় শোভা পাবে একটি ঝলমলে রিং।

আমার স্বপ্ন পূরণের কারিগর হিসেবে এগিয়ে এল সাজিদ। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে একদিন নিয়ে গেল তার সঙ্গে। একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অল্প ভিড় ঠেলে খুঁজে নিল মেয়েটিকে। আমি তার সম্মুখে দাঁড়ালাম। তার অবয়বজুড়ে জগতের সব সৌন্দর্য এসে উপচে পড়ছে। তার মধ্য থেকে একটা সৌন্দর্য আলাদা করার চেষ্টা করলাম। এক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার ‘ব্যক্তিত্ব’। সেটা পাহাড়সম। প্রভাবিত করতে পারার অসাধারণ ক্ষমতা। তার কথা বলার ভঙ্গি শিল্পের পর্যায়ে পড়ে।

আমার সমস্ত দৃষ্টি খুঁজতে লাগল তার অমামিকা। আড়চোখে দেখি, সে বসে আছে হাত গুটিয়ে। অভদ্র বললে বলুক, লুকোচুরি রেখে সরাসরি তাকালাম হাতের দিকে। তার দশ আঙুল জড়াজড়ি করা হাত ওড়নার ভাঁজে আড়াল হয়ে আছে। অনামিকার দেখা নেই। আমার অস্থিরতা বাড়ছে। মনে হচ্ছে সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে আছি। আর দেরি সইছে না। সাজিদকে কনুই দিয়ে আলতো গুঁতা দিলাম।

সে এতক্ষণ ধরে আলাপে ব্যস্ত রেখেছে মেয়েটিকে। এবার পরিচয় করিয়ে দিল তার বন্ধু হিসেবে। মেয়েটি অস্ফুট গলায় ‘হাই’ বলল। আমি ‘হ্যালো’ বলেছি। তবে শুকনো গলায় আটকে গেল বলে শুনতে পেয়েছে কি না, কে জানে।
সে মাথা দুলিয়ে নাম বলল ‘আরোহী’। প্রত্যুত্তরে আমার যে নাম বলতে হবে, এই ভদ্রতাটুকু ভুলে গেলাম। তার কণ্ঠের অনুরণন আমার ব্যাকুল মনটা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়া এক টুকরো তুলার মতো অজানায় নিয়ে গেছে। ফিরে আসতে সময় লাগল। ধাতস্ত হয়ে আবার খোঁজা শুরু করলাম তার অনামিকা। সেখানে একটা অঙ্গুরীয় থাকা মানেই আমার কৃষ্ণপক্ষ। আর না থাকা মানেই শুক্লপক্ষের পথ ধরে হাঁটা।

আমার মনোজগতে যে অস্তিত্বের আনাগোনা; মনের ক্যানভাসে কল্পনার তুলির আঁচড়ে সে অবয়ব দৃশ্যমান হয়ে উঠতে সময় লেগেছিল। অনেক দিন অনেক বছর ধরে আমি তাকে লালন করে আসছি। কোনো অসুন্দর তাকে ছুঁতে পারেনি। বৃষ্টির দিনে সে আমার সঙ্গে বসে পানিতে বৃষ্টির নাচন দেখে। আমরা একসঙ্গে ভিজি। ভরা জোছনার রাতে হাত ধরে হাঁটি, একসঙ্গে কাব্যগাথা রজনীর সঙ্গী হই। সেই অবয়বটি এখন আমার সামনে। যেন স্বপ্নালোক আর বাস্তবতা মিলিত হলো এক বিন্দুতে এসে।
সাজিদ আমার চোখের দিকে এক বিন্দু তাকালে ইশারায় হতাশা প্রকাশ করি। সে হঠাৎ বলে উঠল, আমার এই বন্ধুটি খুব ভালো হাত দেখে। একদম বলে দেবে আদ্যোপান্ত। দেখাও না তোমার হাত।

আমি কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কবে থেকে আমি আবার হস্তবিশারদ হলাম! বরং এই কাজ আমার সবচেয়ে অপছন্দের। কিন্তু তার অনামিকা দেখার জন্য এটাই তো মোক্ষম অস্ত্র। সাজিদের বুদ্ধি দেখে আমি চমকে উঠি।
আরোহী স্মিত হেসে তাকাল আমার দিকে। একটু ভেবে নিল কিছু একটা। তারপর কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
—এই নিন। বলুন তো দেখি আমার ভাগ্যে কী আছে?
আমার ভেতরটা ধক করে উঠল। না আমি তার হাত স্পর্শ করিনি। চোখ মেলে দেখলাম অভিজ্ঞের মতো। ডান হাতের মধ্যমায় একটা রিং আছে। সেটি দেখে আমি হেসে উঠলাম অজান্তে। যাক, অনামিকায় তো নেই। কিন্তু বাঁ হাতের অনামিকায় যদি থাকে! একটা শঙ্কা তবু রয়ে গেল। থাকলে সোজা বলে দেব, আপনার চলমান সম্পর্ক অশুভ। শনির দশা আছে। সঙ্গী বদলান।
—হাসছেন কেন? অদ্ভুত কিছু পেলেন নাকি?
—ডান হাত দিলেন তাই। হস্তরেখা দেখতে হয় বাঁ হাতের। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম।
সহসা বাঁ হাত মেলে ধরল আমার চোখের সামনে।
আমি দুরু দুরু বুকে তাকালাম। আঙুলগুলো চাপাকলির মতো। আমার চোখ তার অনামিকায়।
হঠাৎ আমার ভেতরটা কেমন যেন আলো ঝলমলে হয়ে উঠল। চোখ চকচক করছে। অনামিকায় কোনো রিং নেই। আমি আনমনে বলে উঠলাম ‘ওয়াও’।
—কী হলো! কিছু পেলেন?
—না মানে ইয়ে, হ্যাঁ।
—বলুন তো তাড়াতাড়ি।
কী বলব বুঝতেই তো পারছি না। আমার উদ্দেশ্যটা বলে দিলে কেমন হয়। অন্যভাবে ইঙ্গিতটা দিয়ে দিই।
—শিগগিরই আপনার জীবনে একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। দুর্দান্ত একটা প্রেম এবং বিয়ের সম্ভাবনা শতভাগ।
শব্দ করে হেসে উঠল আরোহী। বিশ্বাস করল কি না, বোঝা গেল না। আমি হাসলাম মনের আনন্দে।

এই শুরুটায় হাত দেখাটা দৃষ্টি আকর্ষণের ছুতো হিসেবে থাকল। ফেসবুকে তার বন্ধু তালিকায় জায়গা হলো। কিছুটা শঙ্কা আর সংশয় নিয়ে মেসেঞ্জারে নক করা শুরু করলেও সে সমস্ত সংকোচের দেয়াল ভেঙে দিয়েছে। ফলে বার্তা আদান–প্রদান হতে থাকল একটা লেভেলে।

আমার মনে হলো সুন্দর শব্দটা সে প্রায়ই শুনে। চলতে–ফিরতে এটা শুনে শুনেই বড় হয়েছে। এই শব্দের মধ্যে কোনো নতুনত্ব খুঁজে পায় না এখন আর। আমি অন্য পথে গেলাম। একদিন বললাম,
—আপনার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আপনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে।

আমি ভুল বলিনি। মিথ্যা বলিনি। চরম সত্য বলেছি। এবং সেটা তার ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ দিয়ে বলল,
—কেন মনে হলো? আমার ব্যক্তিত্বে আপনি কী দেখলেন।
—আপনার চারপাশের অঘোষিত দেয়াল। সেটা ভাঙা কঠিন।
—আপনি ভাঙতে চেষ্টা করেছেন?
—না।
—না করেই বললেন?
—আমি ভাঙতে পছন্দ করি না। সদর দরজা খুঁজি।
—এত কঠিন করে বলেন কেন?
—সহজে বোঝাতে অক্ষম বলে।
—আচ্ছা, আপনি ইতিহাসের ছাত্র হয়ে হাতের রেখা বোঝেন কী করে?
—সব সময় রেখা দেখতে হয় না। মাঝেমধ্যে চোখ ও অবয়ব দেখেও বলা যায়।
—আমার চোখে কী দেখলেন?
—সমুদ্রের মতো অতল। ডুবন্ত মানুষ কিছু দেখে না।
—তাহলে কীভাবে বললেন?
—যা বলেছি সেটা সত্য।
—আপনার কি ধারণা আমি বিশ্বাস করেছি?
—করেননি, তবে শুনতে ভালো লেগেছে আপনার।
—কেন মনে হলো?
—আপনার হাসি দেখে। চমৎকার হাসিতে কোনো কৃত্রিমতা ছিল না।
—অদ্ভুত মানুষ তো আপনি।

একদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হলো বইয়ের দোকানে। আষাঢ়ের ঝুমঝুম বৃষ্টি। ছাতা নেওয়ার অভ্যাস আমার কোনো কালেই ছিল না। অবশ্য স্কুলে নিয়ে যেতে হতো।
ভিজে জবুথবু হয়ে একটি দোকানে আশ্রয় নিয়েছি। কিসের দোকান তা–ও খেয়াল করিনি। অল্প ভিড়ের মধ্যে ঠাঁই নিয়েছি। হঠাৎ ভেতর থেকে ডেকে উঠল আরোহী। বই কিনে বের হচ্ছে। এতক্ষণে দেখলাম এটা লাইব্রেরি।

এই ঝড়বৃষ্টির দিনেও সে কেমন পরিপাটি। হাতে গোলাপি রঙের ছোট্ট একটি ছাতা। বের হতে উদ্যত হলো। আমি চাইলাম রিকশা ডেকে দিতে। কিন্তু আশপাশে কোনো রিকশা নেই।
অগত্যা আমিও বের হলাম তার সঙ্গে। না, সে আমাকে সৌজন্যতার খাতিরেও বলেনি একই ছাতার নিচে ঢুকতে। তবে খুব করে বলল না ভিজতে। অসুখ বাধবে জাতীয় মেয়েলি কথাগুলোর একটিও বাকি রাখল না।
আমি তার পাশাপাশি হাঁটছি। সে ছাতার নিচে। আমি আকাশের নিচে। বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়। আমার ভীষণ ভালো লাগছে। ম্যানহোলের ঢাকনায় হোঁচট খেয়ে আমার সেন্ডেল ছিঁড়ে গেল। না, সে একটুও হাসেনি। চরম দুঃখী চোখে তাকাল। সেই দৃষ্টি আমার দিনটি সুন্দর করে তুলেছে।

আমি বৃষ্টির জলে বিসর্জন দিলাম স্যান্ডেল জোড়া। খালি পায়ে হাঁটছি। বাতাসের ঝাপটায় উড়ন্ত বৃষ্টির ছিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে।
হঠাৎ কী মনে করে বলল, আর কত ভিজবেন! আসুন মাথাটা অন্তত ছাতার নিচে রাখুন।
হয়তো অপরাধবোধ থেকে, নয়তো পরিস্থিতিতে সৃষ্ট অনুরাগ থেকে বা মানবিক হয়ে বলেছে। এই ডাকে তেমন জোর ছিল না, যতটা ছিল না ভিজতে বলার মধ্যে, অসুখ করবে বলার মধ্যে।
আমি হেসে উঠলাম। তবে তার প্রস্তাবে সাড়া দিলাম না। থাক না একটু জড়তা, একটু লাজুকতা। একটু দূরে থেকে কাছে আসার আকুতিই তো সুন্দর।
সে বলল, আপনি তো হস্তবিশারদ। তার ওপর বর্ষাকাল। জানতেন না বৃষ্টি হবে? এভাবে কেউ বের হয়?
—আজ দিনটি আমার জন্য শুভ। তবে এতটা শুভ হবে, জানতাম না।
একটা রিকশা পাওয়া গেল। তাকে তুলে দিলাম।

সে রিকশায় উঠে তার ছাতাটা বাড়িয়ে দিল আমার দিকে।
—নিন, এটা নিয়ে বাসায় চলে যান। বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না।
ছাতায় তার স্পর্শ আছে বলে একবার ভাবলাম নিয়েই নিই। কিন্তু নিলাম না। বললাম—
—আজ সারা দিন ভিজব। রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে খালি পায়ে হাঁটব। দিন শেষে অসুখ বাধাব। সে অসুখে... মনে মনে বললাম তোমার ছোঁয়া থাকবে।
অদ্ভুত সুন্দর দিনটি তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। প্রেমের চেয়ে প্রেমের শুরুর বুক ধকধক করা ক্ষণটাই সুন্দর, আর প্রিয় মানুষের সঙ্গে ঝগড়ার পর ভালো হয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাই মধুর হয়। সেটা সময়ের হাতে রইল।
রাতে জানতে চাইল বৃষ্টিতে ভিজে আমি অসুখে পড়লাম কি না। বললাম, এখনো পড়িনি, তবে চেষ্টায় আছি।
তারপর উচিত-অনুচিত এবং আমার বৈরাগ্যভাব নিয়ে কিছু উপদেশ শুনাল। এটাকে শাসন বলতে পারলে ভালোলাগার মাত্রাটা বেড়ে যেত। আমি কেবল বাধ্য ছাত্রের মতো মেনে নিলাম। এই মেনে নেওয়াতেই আনন্দ।
সময় গড়াতে থাকল। বর্ষা প্রায় শেষ। শরৎ এসে গেল দুয়ারে। প্রতিদিন কত কথাই হয়। তবু আমার অব্যক্ত কথা আড়ালেই থেকে যায়।
আমি সরাসরি কিছু বলতে পারব না। ভালোলাগার কথা, মনের অভিব্যক্তি কিছুই না। মনের অনুভূতি যখন ভাষা পায় চোখে, সেটা প্রকাশ পায় আচরণে; সে ডাক শুনতে পায় প্রণয়িনী। আরোহীও পাবে নিশ্চয়ই।

একদিন জানতে চাইল আমি মিথ্যা বলি কি না। বললাম, মাঝেমধ্যে বলি।
—আমার সঙ্গে কখনো বলেছেন?
—জি, বলেছি। চট করে উত্তর দিলাম।
—কোনটা?
—আপনি যেটা শুনতে চাইছেন সেটা।
—আমি কী শুনতে চাইছি?
—হাত দেখার ব্যাপারটা।
—আপনার সেন্স অব হিউমার ঈর্ষা করার মতো।
—আমি উত্তর দিলাম না।
সে বলল, তাহলে বলছেন ওটা মিথ্যা ছিল?
—জি। পুরোটাই মিথ্যা। আমি হাত-টাত দেখতে পারি না। ব্যাপারটা আমার ভীষণ অপছন্দের।
—আমার মনে হয় আপনি এখনো মিথ্যা বলছেন।
—তাহলে সত্যটা কী?
—আপনার মধ্যে সেই গুণটা আছে।
আমি অবাক হয়ে ব্যাপারটা অনুধাবনের চেষ্টা করছি। হাত দেখে প্রেম ও বিয়ের কথা বলেছিলাম। তবে সে কি তেমন কিছুই বোঝাতে চাইছে? আমার মনের ভাষা কি তাকে স্পর্শ করেছে? সে কি ইতিবাচক সাড়া দিতে প্রস্তুত? আমার ভেতরটা কেমন করে উঠল। প্রচণ্ড ঢেউয়ে তোলপাড় হচ্ছে বুকের ভেতর।
—কী হলো চুপ করে আছেন কেন?
—আপনার কেন মনে হলো?
—সেটা পরে বলি।
আমি লাফিয়ে উঠলাম। অবশেষে স্বপ্নটা আলো পেয়ে গেল! হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে চিত্ত। এই মুহূর্তের জন্য আমিই কি তবে জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ!
আমি দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। সে সম্মতি দিল। চেয়েছি কালই দেখা হোক। সে বলল দুই দিন পর।

সময় ফুরায় না। প্রতি সেকেন্ড যায় দিনের হিসাবে। অবশেষ সময়টি এল।
শরতের নীলাভ আকাশ। কাশফুলে ছেয়ে গেছে চারপাশ। আমি দাঁড়িয়ে আছি আরোহীর অপেক্ষায়। আমার পকেটে একটি ছোট্ট বাক্স। বাক্সের ভেতর একটি নীল রঙের হিরের রিং। আমার শখের ‘এন্ডি টিমন্স’ মডেলের ইলেকট্রনিক ‘ইবানেজ’ গিটারটা বিক্রি করে দিয়েছি। শখের চেয়ে স্বপ্ন বড়।

একটা লাল রঙের গাড়ি এসে থামল অদূরে। নীল শাড়ি পরে নেমেছে একটি মেয়ে। হ্যাঁ, আরোহীই তো। চুল ঠিক করে নিয়ে ছোট ছোট পায়ে আসছে। আমি অল্প এগিয়ে গেলাম। মেয়েটিকে এত সুন্দর লাগছে কেন আজ! দুপাশে ছড়ানো চুল। চোখে গাঢ় করে কাজল টানা। এই অপ্সরীরর দিকে আমি আর তাকাতে পারছি না। ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করতে হলো। চোখ খুলতেই আরোহী বলল, আমার বাগদত্তা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক ভদ্রলোক। গাড়ি পার্ক করে এল মাত্র।
আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল তার ব্রিলিয়ান্ট বন্ধু হিসেবে। তারপর বলল, জীবনে এত তাড়াতাড়ি একটা পরিবর্তন আসবে বুঝতে পারিনি। এনগেজমেন্টটা আকস্মিকভাবে হয়ে গেল। আর হাত দেখেই আপনি সেটা কত আগে বলে দিলেন! অসাধারণ!
আমি অস্ফুট গলায় কিছু একটা বলেছি কি বলিনি! বুকটা ভারী ভারী লাগছে। গলার ভেতর কী একটা কুণ্ডলী পাকাচ্ছে।
হাত দিয়ে পকেট চেপে ধরেছি। সে যেন না দেখে।

অবচেতন মনে বলে উঠলাম, আমার পকেটে কিছু নেই। কিছুই নেই!
তার হাতের অনামিকায় গোলাপি রঙের রিং ঝলমল করছে। আমি সেদিকে চোখ রেখে পেছনের দিকে মৃদু পা ফেলছি।

নড়বড়ে পা ফেলে অল্প পেছনে এসে, ঘুরে দ্রুত বেগে ছুটছি। গন্তব্যহীন যাত্রায়। এই শহর আমার নয়। এই শহর ছেড়ে...