আব্বা আসার খুশি ছাপিয়ে

আব্বা একটি ঘুম পাড়ানি কবিতা শোনাতেন,

একদিন নিশাকাল অবসান হলে

মৃগশিশু এল এক ভরতের কোলে

সকরুণ আঁখি মেলি মাঙিল আশ্রয়

রাজা ভাবে পথ ভুলে এল সুনিশ্চয়

কোথা হতে এল এই স্রোতে ভাসা ফুল

অসহায় মৃগ যেন মায়ার পুতুল

এই একই মায়াবী সুরে শেখ সাদির ‘কারিমা’ পাদ্যাবলি গেয়ে আমাদের চার ভাইবোন এবং নাতিদের ঘুম পাড়াতেন আব্বা।

কারিমা বে বাখশা ইবার হালিমা (Oh Kareem have mercy upon us)

কি হাস্তাম আসিরে কামানদে হাওয়া (For we are captives in the snare of lust!)

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যেত আব্বার কোরআন তিলাওয়াত শুনে,

‘...ইয়াগফির লাকুম যুনুবাকুম ওয়া

ইয়ুদখিল কুম জান্নাতিন তাজরি মিন

তাহতিহাল আনহার, ওয়ামা সাকিনা তাইইবা তান ফি

জান্নাতি আদনিন জালিকাল ফাউযুল আযিম।’

ওয়ামা ‘সাকিনা’তে এসে ১০ বছর বয়সী গাল বেয়ে নদী নামতো কেন জানি না।

‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ গানটা তিন ন্যানো সেকেন্ডে হাজির করল তিন দশক ওপার থেকে আব্বাকে,

যিনি মহাব্যস্ত ঈদ আয়োজনে। ঈদের চাঁদের সঙ্গে আব্বার ছুটির চাঁদ উঠেছে। একসঙ্গে দুই চাঁদের জ্যোৎস্নায় ভাসছে ঘরদোর, মন। টিভিতে বাজছে মন রমজান। জান যায় যায় খুশির সুবাসে চারপাশে। সে সুবাস বাড়ানোর মিশনে আব্বার দাঁড়ানোর সময় নাই দুদণ্ড। সদ্য বাজারফেরত আব্বা আবার দৌড়ান গ্রিন সুইটসে দইবড়ার জন্য টকদই, কাস্টার্ডের জন্য ড্রাইকেক, ফলমূল কিনতে।

ঈদের ছুটিরও একাংশ কাটত আব্বার পেপার কাটিং, ফাইলপত্র করে। ডাইনিং রুমটা তখন পার্বত্য অঞ্চল হয়ে যেত। সারি সারি পেপার ও ফাইলপত্রের পাহাড়ের উপত্যকায় বসে আমি ও আব্বা গুগল গড়তাম। আমার পাশের পাহাড়ে যে সব আর্টিকেলস, নিউজগুলোতে আব্বা লাল দাগ দিয়ে রাখতেন, সেসব কেটে, নির্দিষ্ট অর্ডারে, নির্দিষ্ট ফাইলে গ্লু করতাম।

আর একটি প্রিয় কাজ ছিল আমার, আব্বার ডিকটেশানে লেখা। ঝড়ের বেগে দুপুরবেলা ভাত খেতে আসতেন আব্বা। ভাত খাওয়ার পর, সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলতেন, আমি লিখতাম। চোখ বুঁজে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক প্রভৃতি জটিল বিষয়ের স্থান, কাল, পাত্রসহ কীভাবে বয়ান করতেন আব্বা কে জানে! এরপর, একটু চোখ বুলিয়েই পাতাগুলো নিয়ে চলে যেতেন অফিসে, যেখানে কেউ অপেক্ষায় আছেন লেখাটা নিতে। আব্বার নিশ্ছিদ্র স্ক্যাজুয়ালে জ্বর-জারির সাহস ছিল না জায়গা দখল করার। সাইনাসের লাগাতার ধর্মঘটও আব্বার গতি মন্থর করতে পারত না। সপ্তাহে ৭ দিন অফিস করতেন। এর মাঝে মুষলধারার মিটিং সামলাতেন অব্যাহতভাবে।

রুবেল নানার ডাক্তার ভাই থাকতেন সেঞ্চুরি টাওয়ারে, সেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাট রেখে রুবেল নানা সপরিবারে আমাদের বাসায় উঠতেন ঢাকা বেড়াতে এলে। ১৫ দিন ধরে বেড়ানোর একপর্যায়ে নানা তাঁর ভাইয়ের বাসায় ঢুঁ মারতেন একবেলা। এমন অনেক রুবেল নানা ছিলেন যারা আপনজনদের চেয়ে আমাদের বাসায় থাকা পছন্দ করতেন ঢাকায় এলে। চিকিৎসা, চাকরি, বিবাহ প্রভৃতি নানান দরকারে, অদরকারে, অভাবে, আবদারে আব্বার কাছে আসত মানুষ স্রোতের মতো। আব্বা কখনোই বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। সাধ্য অনুযায়ী সবাইকে সাহায্য করতেন।

তখন, দেশ থেকে এসেছি সবে পাঁচ বছর হয়েছে। কাঁচা বিরহে কাতর মন দেশের জন্য। সেই বিরহ কাতরতার একটা উদাহরণ দি, ‘হারানো দিনের মতো হারিয়ে গেছ তুমি’, এই ‘তুমি’ দেশ হয়ে যেত গানটা গাইতে গেলেই। প্রথম লাইনের পাদদেশে এসে সুর-তাল-লয়সহ ভেসে যেত গান এক বিশেষ বানে। বছর দুই আগে আম্মা বেড়িয়ে গেছেন। মন বলে এবার আব্বার পালা। পালাটা কীভাবে আসবে জানি না। তাই, দিবাস্বপ্ন দেখি আব্বা আসার লৌকিক, অলৌকিক নানান উপায়সংক্রান্ত। ৮ বছর আগে আব্বা যেমন রাষ্ট্রীয় সফরে আমেরিকা এসেছিলেন, তেমন আবার আসুক এই দোয়া করি। একদিন, এক বিখ্যাত ঝড়ের রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে, এশার নামাজ শেষে টেবিলে এলাম। কোরআন পড়তে পড়তে কখন জানি দোয়ায় গেলাম। হারিকেন ‘ইসাবেলে’র হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৫০ কিমি, আর আমার দোয়ার বেগ ঘণ্টায় ১০০ কিমি। সে রাতে আকাশের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ঝরেছে এই দুই চোখে। একসময়, সব প্রার্থনা একটি চাওয়ায় পরিণত হয়। কোনো দিন এভাবে চাইনি আব্বাকে দেখতে। কোনো দিন এভাবে কিছু চাইনি যেন আল্লাহর কাছে। শেষ রাতে ক্লান্ত, তৃপ্ত দেহমনে ঘুমাতে যাই।

সকালে উঠে শুনি ঝড়ের কারণে স্কুল বন্ধ। বাচ্চাদের ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যায়। ওরা নাশতা খেয়ে খেলতে শুরু করে। আমি এই সুযোগে দেশে ফোন করি। শাকিল ফোন ধরে। হালকা কুশলাদি বিনিময়ের পর ও জানায়,

—আব্বা আমেরিকা যাচ্ছেন

—কি? আব্বা আমেরিকা আসছেন?

—হ্যাঁ, ইউএস সরকারের আমন্ত্রণে

—কবে?

—অমুক তারিখে

—সত্যি?

—হ্যাঁ, আজ দুপুরেই টিকিট কনফার্ম করে এলাম।

ফোন রেখে অশ্রু আড়াল করার জন্য আমি পাকঘরে দৌড়াই। আব্বা আসার খুশি ছাপিয়ে সেই মহাব্যবস্থাপকের স্পর্শ সুখে আন্দোলিত হই।

তারপর, ১৫ দিন পর আব্বা এলেন। ওয়াশিংটন ডিসির ম্যারিয়ট হোটেলে উঠলেন। পরদিন মেরিল্যান্ড থেকে এক ঘণ্টা ড্রাইভ করে হোটেলে গেলাম। এলিভেটরের দরজা খুলতেই দেখি কফি স্যুটে, মুচকি হেসে আব্বা দাঁড়িয়ে।

আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটে সরকারি সফর শেষে আব্বা বাসায় এসে ৯ দিন ছিলেন। তখন ছিল রোজার দিন। আব্বার পিছে তারাবিহ পড়তে আগের মতোই উৎসবমুখর লাগত। সেই আবাল্য শ্রুত, দরদ বিগলিত তিলাওয়াত শুনে চোখে পানি আসত। আব্বার তিলাওয়াত শুনে শুনে অনেক সুরা মুখস্থ হয়েছিল ছোটবেলায়। আমার তিন ছেলেকে একই চাদরে মুড়িয়ে গল্প করতেন আব্বা। ইচ্ছা করত কাজ ফেলে আমিও এসে যোগ দিই সে অনুষ্ঠানে।

ছোটবেলায়, আব্বা যখন আলোচনা করতেন ধর্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে, তখন মনে হতো এ সময় আর শেষ না হোক কোনো দিন। আব্বার কাছে কোনো পড়া বুঝতে চাইলে ক্রিস্টাল-ক্লিয়ার করে দিতেন। অবোধ্য ভাবসম্প্রসারণ লিখে দিতে অনুরোধ করলে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে তারপর, বলতেন, ‘এবার লিখে আনো তো দেখি।’ লেখা দেখে মন্তব্য করতেন, ‘খুব সুন্দর হয়েছে। আমিই তো এত সুন্দর করে লিখতে পারতাম না।’

আব্বা অফিসে চলে গেলে, ব্রিফকেস খুলে, সিরিজ লেখার খাতা নিয়ে আমরা ভাইবোনেরা ধূমায়িত পর্বটা পড়তাম। একবার, এক ভরা খাতা আপাদমস্তক এডিট করেছিলাম। ভালো না লাগা অংশগুলো লাল ব্রাকেটে আবদ্ধ করে পাশে ক্রস চিহ্ন এঁকে রেখেছিলাম। তারপর, অনেক দিন কোনো রি-অ্যাকশান না পেয়ে আম্মাকে জানাই ব্যাপারটা। আম্মা বলেন, ‘ওওও! ওই কাজ তুই করেছিলি, তোর আব্বা মনে করেছে সোহেল। তোর আব্বা বলে, “দেখো, তোমার ছেলের কাণ্ড! ... কী সাংঘাতিক এডিট করেছে সে!”’ উল্লেখ্য, ঐ দুর্ধর্ষ কাজটা যে আমি করেছিলাম, তা আব্বা আজও জানেন না।

যখন বুয়া আসত না, আব্বা সাতসকালে উঠে বাসন মাজতে বসতেন। থালাবাসনের শব্দে ঘুম ভেঙে দৌড়ে যেতাম কল পাড়ে, কিন্তু আব্বাকে কিছুতেই ওঠাতে পারতাম না। আব্বা বলতেন, ‘যাও তুমি পড়তে বস গে।’ আমাদের অসুখ হলে, আব্বা মাথায় পানি ঢালতেন, রান্না করে দিতেন। ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলে মধ্যরাতে অফিসফেরত আব্বা জামা না বদলেই ডেকে তুলে খাওয়াতেন। এতে ১ ঘণ্টার শ্রম হয়তো লাগত মিনিমাম। কিন্তু প্রথম থেকে শেষ অবধি কোনো রাগ-বিরক্তি ছাড়াই কাজটা সম্পন্ন করতেন, ‘মা ওঠো, ওঠো, খাও মা খাও।’ কালের সাধ্যাতীত সে বাক্যগুলো মোছা।

নাতিদের জন্য বাংলাদেশ সম্পর্কে নানান তথ্যমূলক সচিত্র ইংলিশ বইপত্র, ক্যালেন্ডার, বর্ণমালার বই প্রভৃতি পাঠাতেন আব্বা। আর আমাকে বারবার তাগিদ দিতেন বাচ্চাদের বাংলা শিখাতে। বিদেশ থেকে অনেক আকর্ষণীয় চাকরির সুযোগ পেয়েও আব্বা গ্রহণ করেননি। আব্বাকে বারবার বলেছি, Birth সার্টিফিকেটটা তৈরি করে দেন, গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করি, কিন্তু তিনি সব সময় এড়িয়ে গেছেন নানান অছিলায়।

আমার সৎদাদির কাছে শোনা, ‘তোর বাপ যেমন ভালোভাবে পড়াশোনা করত, তেমন ঘরের কাজও করত। কোনো কাজে না বলত না। গরু চরাতে যেতে বললে সে বইও নিয়ে যেত বগলদাবা করে। গরুর খুঁটি পুঁতে তারপর পড়ত।’

My dad

Your eyes like a sky where

I can fly in peace.

Your heart like an ocean where

I can swim in bliss.

You're my google, my

encyclopedia.

My best teacher, my mentor,

and media.

A sweet song in my heart that's

always new.

You're my dad. I'm glad

to have you.

আমার বাবা

তোমার চোখে আকাশ ছিল, একটি সুখের আবাস ছিল

অন্তরে এক সাগর গভীরতা।

নদীর মতো কলরোলে, দিনগুলো সব যেত চলে

তোমার কোলে, এই সেদিনের কথা।

তোমার কলম যুদ্ধরত, বখতিয়ারের ঘোড়ার মতো

টগবগিয়ে কেবল শুধু ছোটে।

তন্দ্রাহত মনে কত, স্বপ্ন ছড়াও অবিরত

সত্যগুলো আলোর মতো ফোটে।

ভয়ভীতিতে সাহস দিতে, আলোক আলয় চিনিয়ে দিতে।

আলো হয়ে জ্বলতে আমার পাশে।

আঁধার এসে নানা ছলে, ডাকলে এসে দলে দলে

হারাইনি পথ তাই তো ভুলোচ্ছ্বাসে।

*লেখক: স্কুলশিক্ষিক