করোনা গবেষণা ও আমাদের প্রতিক্রিয়া

ছবি রয়টার্স
ছবি রয়টার্স

সারাক্ষণ করোনা বিষয়ে শুনতে শুনতে কি আপনি ক্লান্ত ও বিরক্ত? তাহলে চলুন করোনা বাদ দিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলা নিয়ে কথা বলি। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কিলাত কিলাব মাঠে হওয়া আইসিসি ট্রফির খেলার কথা মনে আছে? যেবার বাংলাদেশ ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল?

আমার মনে আছে। আমি তখন ক্লাস টেনে পড়ি। রাস্তায় আরও অনেকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি দোকানের রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শুনেছিলাম। মাত্র ২৫ ওভারে ১৬৬ রান তাড়া করে জিতে যাওয়ার পর আমাদের সে কী বাঁধভাঙা উল্লাস! রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হয়েছিল। টিভি-পত্রিকায় কয়েক দিন শুধু সেই খেলার কথাই প্রচার করেছিল।

খেলোয়াড়েরা মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে আসার পর সরকার তাঁদের বীরের সংবর্ধনা দিয়েছিল। শুধু বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেই সারা দেশে এত এত উচ্ছ্বাস দেখে ক্রিকেটের বড় বড় দেশগুলো নিশ্চয়ই খুব হাসাহাসি করেছিল। নিশ্চয়ই ঠাট্টা করে বলেছিল, বাংলাদেশের লাফালাফি দেখে মনে হচ্ছে, ওরা বিশ্বকাপটাই জিতে গিয়েছে!

ওরা হাসলে হাসুক! তাতে আমাদের কিছুই যায় আসেনি। যদিও আমরা খুব ভালো করেই জানতাম, ক্রিকেটের বড় বড় দেশগুলোর অর্জনের তুলনায় আমাদের ওই সামান্য অর্জন তেমন কিছুই নয়, তবুও আমরা আমাদের ওই অতটুকু অর্জনকেই বুকভরে গ্রহণ করতে কার্পণ্য করিনি। আমরা খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়েছি, ক্রিকেটে বিনিয়োগ করেছি। যার ফল আমরা হাতেনাতেই পেয়েছি। আমরা এখন ক্রিকেটের সব বড় বড় দেশগুলোর সঙ্গে লড়াই করতে পারছি।

যাক, ক্রিকেট নিয়ে অনেক কথা বললাম। মনটা কি একটু ভালো হয়েছে? তাহলে চলুন এবার করোনাভাইরাস নিয়ে কথা বলি।

বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষণার তেমন একটা সুযোগ নেই। তবে আনন্দের ব্যাপার হলো, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়ে কিছু কিছু গবেষণামূলক কাজ হচ্ছে। গণস্বাস্থ্য অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট বানাল, শিশুস্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশন জিনোম সিকোয়েন্স বের করল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগ আরটি-ল্যাম্প টেস্ট নিয়ে কাজ করল, এ রকম আরও অনেকে হয়তো কাজ করছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, যখনই তাঁরা তাঁদের গবেষণার কাজগুলো প্রকাশ করছেন, লোকজনের কাছ থেকে দুটো বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। একদিকে যেমন অনেকেই আনন্দিত হচ্ছে, অন্যদিকে অনেকে আবার এসব গবেষণার নেতিবাচক সমালোচনায় মেতে উঠছে। তাদের কথা হলো, এসব গবেষণা নিয়ে এত মাতামাতি করার কী আছে? এগুলো তো কোন নতুন উদ্ভাবন নয়? এসব কাজ তো উন্নত দেশগুলোতে প্রতিদিনই হচ্ছে!

যাঁরা এসব নেতিবাচক সমালোচনা করছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাঁরা সেসব দেশের সর্বাধুনিক গবেষণার সঙ্গে পরিচিত। তাই স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের গবেষণাগুলোকে তাঁদের কাছে নতুন কিছু মনে হচ্ছে না। আমিও মেনে নিচ্ছি, হ্যাঁ, উন্নত দেশগুলোতে জিনোম সিকোয়েন্স বের করা, আরটি-ল্যাম্প পদ্ধতি দিয়ে ভাইরাস শনাক্ত করা এসব আহামরি কোনো কিছু নয়। তাদের গবেষণাগারগুলোতে এসব কাজ অহরহ হচ্ছে। কিন্তু সেসব দেশের সঙ্গে তো আমাদের নিজেদের তুলনা করলে চলবে না। দেশে যেখানে গবেষণাটাই ঠিকভাবে শুরু হয়নি, সেখানে এখনই নতুন নতুন 'উদ্ভাবনের' খোঁজ করাটা অবাস্তব প্রত্যাশা।

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম, গণস্বাস্থ্যের কিট ভাইরাস শনাক্তকরণে ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু রক্তে অ্যান্টিবডি নির্ণয়ে নাকি তা ৭০ শতাংশ সফলতা দেখিয়েছে। যদি সত্যি তা-ই হয়, তাহলে এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক প্রাপ্তি। যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ অ্যান্টিবডি নির্ণয়ে মাত্র ৪০-৫০ শতাংশ সাফল্য দেখানো টেস্ট কিটকেও 'ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশন'–এর আওতায় অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু সেটা যে খুব ভালো সিদ্ধান্ত তা বলছি না। আমার কথা হলো, গণস্বাস্থ্যের কিটটিকে বাতিল ঘোষণা না করে তারা বরং তাদের ৭০ শতাংশ সাফল্যকে গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে আরও বাড়াতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের সরকারের সহযোগিতা করা উচিত। তার ফলে এই কিটটির মাধ্যমে সঠিকভাবে উপসর্গহীন সংক্রমণ ও উপযুক্ত প্লাজমা ডোনার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। অন্যান্য দেশের সঙ্গে অর্থহীন তুলনা করে জিনোম সিকোয়েন্স বের করা, আরটি-ল্যাম্প পদ্ধতি ব্যবহার করার মতো গবেষণামূলক কাজগুলোকে নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনা বন্ধ করে গবেষকদের যথাযথ সম্মান দেওয়া উচিত। তাহলে অন্যরাও গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হবেন।

মোদ্দা কথা হলো, গবেষণায় আমাদের ছোট ছোট সাফল্যগুলোকে উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করা অত্যন্ত অযৌক্তিক। দেশে যেখানে গবেষণাই হচ্ছে না, সেখানে এসব ছোট ছোট অর্জনই আমাদের জন্য 'নতুন উদ্ভাবন'। এসব প্রাপ্তিতেই আমাদের উল্লাস করতে হবে। গবেষকদের 'বীরের' সংবর্ধনা দিতে হবে। গবেষণায় অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে। আর তা করতে পারলেই ভবিষ্যতে গবেষণায় বিশ্বমানের সাফল্য আসবে। উন্নত দেশগুলোর মতো তখন আমরাও সত্যিকারের 'উদ্ভাবন' করতে পারব।

২৩ বছর আগে ক্রিকেটের ওই অতটুকু প্রাপ্তিকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা না করে যেভাবে বুকভরে গ্রহণ করেছিলাম, গবেষণার বিষয়টিতেও আমাদের একই রকম মানসিকতার পরিচয় দেওয়া উচিত। অবশ্য ক্রিকেটকে প্রমোট করার পেছনে ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল। গবেষণার বিস্তারে তো আর ক্রিকেটের মতো অত স্পন্সর পাওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে তাই সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে আমরা যাঁরা উন্নত দেশগুলোতে গবেষণার সঙ্গে জড়িত আছি, দেশের সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে সেখানকার গবেষক ও তাঁদের গবেষণাকাজগুলোর প্রতি আমাদের আরও 'এপ্রিশিয়েটিভ' মনোভাব পোষণ করতে হবে।

*লেখক: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, অ্যাবোট ল্যাবরেটরিজ, শিকাগো, যুক্তরাষ্ট্র