ঢাবি জীবনের কথা: যে পথে আলো জ্বলে ১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল।

১.

একটি সুন্দর জাতি গঠনে গুণগত শিক্ষা অপরিহার্য সবার জন্য। শুরুটা শিশুকাল থেকে। শিশু বয়সের কচি মনে পরম যত্নেœপরিবারের গড়ে দেওয়া জ্ঞানের নরম বীজশালায় অঙ্কুরিত শিক্ষাটাকে বৃদ্ধির জন্য যেতে হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর মাধ্যমিক শিক্ষা। শক্ত ভিত নিয়ে কৈশোরে কলেজে যাওয়া। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি কৈশোরে পরিবার ছাড়িয়ে সমাজমুখী হতে হয়। সমাজ দেয় নৈতিক, মানবিক ও মিলেমিশে থাকার জীবনের শিক্ষা। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে সব বিষয়ভিত্তিক প্রচলিত বেসিক জ্ঞান। সময়ের সঙ্গে সঠিক পথে চলে মজবুত করতে হয় জ্ঞানের ভান্ডারকে। বেসিক সব জ্ঞানে কিশোরের অর্জিত শিক্ষাটা তখন প্রস্ফুটিত হওয়ার অপেক্ষায়। দরকার উচ্চতর পরিবেশ। এই উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা মাধ্যমিক থেকে অবশ্যই আলাদা। সঞ্চিত জ্ঞানকে যথোপযুক্ত ব্যবহার করে আহরিত নিত্যনতুন বিষয়গুলোকে এখানে পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ করতে হয়। মুক্তচিন্তায় নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। জাতি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে নিজ নিজ বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে হয়। ‘জ্ঞানের জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও’ এই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের থিম। বিশ্বজ্ঞানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বশিক্ষা।

২.
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের বিশ্বশিক্ষার জন্য আছে মেডিকেল, টেকনিক্যাল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বজ্ঞানের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। তবে পড়ার যোগ্যতা প্রমাণে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। ভর্তিযুদ্ধ। শুরু হয় দৌড়াদোড়ি। আর তা দেশব্যাপী। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। মেডিকেল ভর্তি ব্যবস্থায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। বিদ্যমান প্রায় সব কটি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা হয় একসঙ্গে। কী চমৎকার, তা–ই না? টেকনিক্যাল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ছেলেমেয়েদের ছুটতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ইউনিটভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতির ফলে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি–ইচ্ছুকদের জন্য এটা আরও ভয়াবহ কষ্টকর।

সত্যিই কষ্টকর। প্রাণের বাংলাদেশে একটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সুবিধাবঞ্চিত। জরাজীর্ণতায় বেড়ে ওঠা তাদের জীবন। প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি বাল্য বয়সেই জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অন্যান্য অনেক কাজ করতে হয় তাদের। মনের গহিনে বড় স্বপ্ন লালন করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এদের ভাবতে হয় ভ্রমণ খরচ, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ অনেক কিছু। উপরন্তু, মেয়েদের জন্য প্রধান ভাবনা নিরাপত্তার বিষয়। আরও আছে অজানা আশঙ্কা, প্রতিযোগিতায় টিকে গেলে কে দেবে পড়ার খরচ? পথিকের চোখ জলে ছলছল। তবু চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ সেথা শির। প্রতিযোগিতায় নামতে হবে।

তুমুল প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মেধাই প্রধান। মেধা দিয়েই বড় কিছু পাওয়া যায়। কে না চায় বড় হতে? কিশোরদের জীবনের স্বপ্ন দেখাতে পারলে এরা যে কেউ অনেক বড় হতে চাইবে—বিজ্ঞানী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, লেখক, উদ্যোক্তা, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ আরও কত কী। হোক না সে পাড়াগাঁয়ে জরাজীর্ণতায় বেড়ে ওঠা কিশোর অথবা শহর-বাজারে আভিজাত্যের কিংবা বস্তির কেউ।

৩.
উত্তরবঙ্গের এক অবহেলিত জনপদ থেকে সেদিন নিঝুম রাতে ছুটে আসা দূরপাল্লার বাসটা ঢাকার গাবতলীতে এসে থামল। তখন শীতের ভোররাত, ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে। দেশের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি–ইচ্ছুক সাতজনের দলটা এই গাবতলীতে এসে লোকাল বাসে ওঠে। পরের দিন সেখানে বিজ্ঞান বিভাগ ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। রাতে কোথাও তাদের থাকা দরকার। ভরসা এলাকার এক বড় ভাই। দুরু দুরু হৃদয়ে অনিশ্চিত পথে পা বাড়ায় দলটা। গন্তব্যে পৌঁছে যায় তারা। শহীদুল্লাহ হল। অপরূপ সাজের এই হলে লাল রঙের প্রধান ভবন, আর আছে দুটি এক্সটেনশন ভবন। বড় এক্সটেনশন ভবনে ঢুকে চারতলায় এক কক্ষে ঠকঠক আওয়াজ দেয়। কী সৌভাগ্য! সুদর্শন চেহারার সেই ভাই অমায়িক হাসিতে অভ্যর্থনা জানালেন! দরকারি সব সহায়তাও করলেন তিনি।

যথারীতি ভর্তি পরীক্ষা হলো। মফস্বল থেকে আসা সেই দলের দুজন উত্তীর্ণ। বন্ধু ওয়াকিল পড়বে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। আমিও। আমাদের এই দুজনের প্রথম বর্ষে ভর্তির কাজ শেষ হলো। দেশের রাজধানীতে অবস্থিত স্বনামধন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখন ১৯৯৬ সাল। তাকিয়ে দেখছি, আপন মহিমায় সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ কারুকার্যে ভরা অনেকগুলো লাল বিল্ডিংয়ের সমাহারকে। বিখ্যাত এ কার্জন হল এলাকায় থাকব। অতি আনন্দের শিহরিত দোলা তখন শরীরের শিরা–উপশিরায়। অণুতে-পরমাণুতে। তবু আছে অনেক শঙ্কা, আর অনিশ্চয়তা। শুরু হবে ক্লাস। শুরু হবে ঢাকার জীবন।

৪.
কার্জন হল এলাকায় বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান আর ফার্মেসি অনুষদ, সেখানে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু। মেধায়-মননে এগিয়ে থাকা অনেক ছাত্রছাত্রীদের ভিড়ে এই মফরা। মফস্বল থেকে আসা নতুনদের সংক্ষেপে বলা হতো ‘মফু’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর স্মার্টদের দেওয়া এ নাম। এ রকম বাহারি আরও নাম আছে। কলু, পিলু। সেই সময় কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করা গ্র্যাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করতে এলে তাদের এসব নামে ডাকা হতো। স্মার্টদের ভিড়ে কিছুটা হতবিহ্বল। তবে ভয়ে ভীত হইনি। গাঁওগ্রামের উন্মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা মফুদের ভীতি থাকে না। মেধা চর্চার সুযোগ কম বলে সীমিত জ্ঞান যদিও। বিশ্ববিদ্যালয়ে যথারীতি ক্লাস শুরু হয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের কঠিন তত্ত্বগুলো আমার অনুর্বর মস্তিস্কের কোষে দোলা দিতে পারল না। পরের সপ্তাহে রসায়ন বিভাগে নাম লেখাই, বন্ধু ওয়াকিলসহ।

কাগজে–কলমে ফজলুল হক হলের ছাত্র আমি। থাকার ব্যবস্থা কিন্তু তখনো হয়নি সেখানে। দিনে ক্লাসের জন্য থাকি ডিপার্টমেন্টে আর রাতে ঘুমাই শহীদুল্লাহ হলে, কিছুটা ভাসমান জীবন। সোনার হরিণ পেতেও পারো পথিক যুবক, তবে হলে সিট পাওয়া কঠিন। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ৩০ হাজার ছাত্রছাত্রী এখানে, আর হলের সংখ্যা অপ্রতুল। তবে আমি অনেক ভাগ্যবানদের দলে। গণিত বিষয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত সেই সুদর্শন ‘পিলু’ ভাইয়ের শত চেষ্টায় শহীদুল্লাহ হলে কাটানো আমার তিন সপ্তাহের ভাসমান জীবন শেষ হলো। নিজ হলে থাকার জায়গা পেলাম।

ঢাকায় একটা ঠিকানা পেলাম। ২০১১ নম্বর কক্ষ, ফজলুল হক হল। চার বেডের কক্ষ, দৈতাবাস (এক ছোট্ট বেডে দুজন) থাকি। অফিশিয়াল বৈধতা তখনো কিন্তু পায়নি! দৈতাবাস কিংবা বৈধতার ব্যাপারগুলো তখন নগণ্য। গণরুমের বাসিন্দা হতে হয়নি, ছাত্ররাজনীতির নেতাদের অগোচরে থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এই ঢের বেশি যে পথিক সোনাবাবু! রসায়নের মাসুদ ভাই এই দৈতাবাস আর অফিশিয়াল বৈধতার ব্যবস্থা করে দেন। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই উনি, ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন হয় না! সব বিপদে এই ভাইয়েরা জুনিয়রদের জন্য তুমুল বৃষ্টিতে শক্ত ছাতার মতো। কৃতজ্ঞতায় মাথা নোয়াই আমি। চলবে...

*পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, কানাডা। [email protected]