ঢাবি জীবনের কথা: যে পথে আলো জ্বলে ২

ঢাবি রসায়ন বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে (মোকারম ভবন, ১৯৯৭)। ছবি: সংগৃহীত
ঢাবি রসায়ন বিভাগের বন্ধুদের সঙ্গে (মোকারম ভবন, ১৯৯৭)। ছবি: সংগৃহীত

আমার বিজ্ঞান বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে ১৯৯৬ সালে। পদার্থবিজ্ঞানে ছাত্রত্ব আরম্ভ করেও পরের সপ্তাহেই আমি রসায়ন বিভাগে নাম লেখাই। গাণিতিক সমীকরণ আর তত্ত্বে ভরা পদার্থ বিজ্ঞানটা বুঝি না। তবে রসহীন রসায়নটা পড়তে মজা পাই, কিছুটা বুঝি। কলেজ পর্যায়ে রসায়নের শিক্ষক ইসরাইল স্যার, ইস্রাফিল স্যার, আর আখতার স্যারদের অবদানে হয়তো। রসায়ন বিষয়ে আমার প্রথম দিনে গেলাম মোকাররম বিজ্ঞান ভবনের রসায়ন ২০০ নম্বর কক্ষে। সেখানে এই পাঠশালায় রসায়ন পরিবারের জনা পঁয়তাল্লিশেক কচি সদস্যদের দেখলাম। মনে আমার অনেক শঙ্কা, তবু অনেক উচ্ছ্বসিতও। সহপাঠীদের সঙ্গে বসলাম পেছনের বেঞ্চে। পাশাপাশি বসলাম বন্ধু ওয়াকিল ও আমি।

গুরুগম্ভীর স্বভাবের অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কিছুটা খাটো গড়নের একজন শিক্ষক ২০০ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করলেন। কচি সদস্যদের কোলাহলে পূর্ণ কক্ষটিতে হঠাৎই পিনপতন নীরবতা। উনি অধ্যাপক মুহিবুর রহমান। পিএইচডি কেমব্রিজ। প্রখর স্মৃতিশক্তি তাঁর। অত্যন্ত মেধাবী আর প্রভাবশালী শিক্ষক তিনি। জানলাম তিনি বিভাগের প্রধানও। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির বস। পড়ানোর স্টাইল্টাই তাঁর অন্য রকম। মুগ্ধ হয়ে তাঁর সব কথা শুনলাম। মজা পেয়েছি। তয় দুর্ভাগ্য, আমার অজ্ঞ ব্রেনে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির পড়া কিছুই বুঝিনি! সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে টের পাই, আমি ঢের কম জানি। কয়জন সহপাঠী তারা স্যারের সঙ্গে ইংলিশেই কথোপকথন করল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। কী স্মার্টই না তারা! বুঝলাম তারা আসলেই মেধাবী, আর অনেক জান্তা।

ক্লাসসূচিতে চোখ রাখলাম, পরের ঘণ্টা জৈব রসায়নের। হাস্যোজ্জ্বল নরম মনের শান্ত শিক্ষক অধ্যাপক কাদের স্যার এলেন। রসায়ন বিভাগে তোমাদের স্বাগতম, তিনি কথা বলা শুরু করলেন। সব বিজ্ঞানের মূল হলো রসায়ন, বললেন তিনি। এটা ভালো করে শেখো। কী জানি ভালো লাগা পেয়ে গেলাম! আমি ইতিবাচক চিন্তার একজন মানুষ। অজানা অনেক কিছু। হতাশ হতে পারি, কিন্তু ভেঙে পড়ি না। বেসিক আলোচনা না করেই কিছু কথা শেষেই জৈব রসায়নের ‘রিয়াক্সন মেকানিজম’ আলোচনায় তিনি টার্ন নিলেন। নিজের সীমিত জ্ঞানেও দমে যাইনি। মজা আছে বিষয়টিতে। আরও মনোযোগী হই। ভালো লাগার সূচনা। রিয়াক্সন মেকানিজমের ভয়ে ভীত কলেজ বন্ধু ওয়াকিলের জন্য রসায়নের এটাই শেষ ক্লাস! পরে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগেই ফেরত যায় সে।

শিক্ষাজীবনের প্রায় সব স্তরে হার না–মানা তুখোড় মেধাবী শিক্ষক নিশাত ম্যাডাম অজৈব রসায়ন পড়াতে এলেন। যেমন সুন্দরী, তেমনি সদা হাস্যোজ্জ্বল। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা এই পাঠশালায়, সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে তাঁর দিকে। নিজের পরিচয়ের একপর্যায়ে ম্যাডাম বললেন তাঁর সন্তানেরাও বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। স্বনামে ধন্য সিনিয়র শিক্ষক মফিজ স্যারের মেয়ে তিনি। তুখোড় মেধাবী তাঁকে হতেই হবে। প্রথম ক্লাস, অনেকটা মজা করেই কাটল। ছাত্রছাত্রীদের মনে রসায়নের ভয়ভীতিকে দূর করার চেষ্টায় শিক্ষকদের এটা একটা কৌশল হতে পারে।

কার্জন হলের একটি লাল দালানে রসায়ন বিভাগের মূল অফিস। এখানে আছে ব্যবহারিক রসায়নের জন্য বেশ কিছু ল্যাবরেটরি। রসায়ন লাইব্রেরি। আরও আছে একটি বড় অডিটরিয়াম। ইতিহাসের সাক্ষী এই কার্জন হল। রসায়ন অডিটরিয়ামও তার একটি। একপেশে ঔষধনীতি ১৩ (১) ধারা বাতিলের জন্য ১৯৯৮-১৯৯৯ সালে সব কেমিস্টদের (কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি, অ্যাপ্লায়েড কেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজির ছাত্রছাত্রীরা) আন্দোলন তখন তুঙ্গে। সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুরোধে রসায়নের এই অডিটরিয়াম ভরপুর আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে অধ্যাপক মুহিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছিল।

ঢাবি কার্জন হলে রসায়ন বিভাগ। ছবি: লেখক
ঢাবি কার্জন হলে রসায়ন বিভাগ। ছবি: লেখক

রসায়নের রসবিহীন শক্ত তত্ত্বীয় বিষয়গুলোকে পড়ানো হয় দোয়েল চত্বরের ওপাশে মোকাররম ভবনে। বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভালো কিছু করতে শিক্ষকদের চেষ্টা প্রতিনিয়ত। নজরদারি বাড়িয়ে আর গবেষণাবিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়ায় মনোযোগী করেন। শিক্ষকদের বসার অফিস, আর গবেষণা ল্যাবগুলো মোকাররমেই।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোকাররম হোসেন খোন্দকারের নামানুসারে এই মোকাররম ভবন। আলোর দিশারি রসায়নের এই অধ্যাপক ছিলেন ভৌত ও অজৈব রসায়নের নামকরা গবেষক। দীর্ঘ সময়ের জন্য দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় প্রধান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চলবে...

* পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, কানাডা। [email protected]