সোজা পথে কেউ চলি না কেন

একটি নতুন পথ বের করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেক বাধা-বিপত্তি ও ঝুঁকি নিয়েই এ পথ পাড়ি দিতে হয়। কেউ পারে, কেউ পারে না। তবে অনেকেই পারে না। আর পারে না বলেই এটি বাঁকা পথ হিসেবে বিবেচিত। আর যার কারণেই এ পথের পথিক খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন।

আমরা প্রতিটি জীবের দিকে তাকালে একই ঘটনা দেখতে পাব। ধরুন, কেউ একজন বনে ঘুরতে গেছে, সেটা হতে পারে বান্দরবান। এখন, কেওক্রাডাং বা সাকা হাফং পাহাড়ে উঠতে গেলে কিন্তু বনের ভেতর দিয়ে পায়ে হাঁটা আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা (ট্রেইল) ধরে এগোতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো এতই সরু হয় যে দুজন একসঙ্গে হাঁটা যায় না। একজনের পেছনে আরেকজন হাঁটতে হয়। পথিকের পায়ের পেষণে এখানকার তৃণকুলের বিবর্ণ চেহারা দেখে এই চিকন রাস্তা চিনতে ভুল হয় না, যা কিনা আগে কে বা কারা এই পথটি দেখিয়েছেন। হয়তো তিনি এটিকে সত্যিকার অর্থে সহজ পথ হিসেবে দেখছেন অথবা বাঁকা পথকে সহজ মনে করেছেন। যা-ই হোক, এটাকে সহজ পথ মেনে নিয়েই কেওক্রাডাং বা সাকা হাফংয়ে উঠতে হবে।

অন্যদিকে ক্ষুদ্র প্রাণী কানবিহীন পিঁপড়াও একই নিয়ম অনুসরণ করে। চিনিদানা বহন বা তাদের স্বজাতিকে উদ্ধারে তারা দল বেঁধে লাইন ধরে একই রাস্তা দিয়ে চলাচল করে, যে পথটি সামনের একটি পিঁপড়া আবিষ্কার করেছে। এবং এটাই সহজাত প্রবণতা।

এরই ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, পুলিশ বাহিনী, সেনাবাহিনীসহ হাজারো প্রতিষ্ঠান। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসব আজ মাথা উঁচু করে সগর্বে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। এগুলো একেকটি প্রতিষ্ঠান বিশেষ বিশেষ কাজে নিয়োজিত।

আমরাও তার ব্যতিক্রম না। আমাদেরও সবই আছে, কিন্তু যার যে কাজ সেটি নিয়ে কি তারা সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে তা শতকরা কত ভাগ সঠিক পথে, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হতে পারে। অনেকেই বলবেন ইউরোপ, আমেরিকা কেউ তো শতভাগ সম্পূর্ণ না। কিন্তু ৫০ শতাংশ দিয়ে ৯৫ শতাংশকে যে বৈধতা দেওয়া যায় না, এটা জেনেও মানতে চাইবেন না। ৯৫ টাকার জিনিস ৫০ টাকা দিতে চাইতে তাঁদের কজন মানবেন?

সম্প্রতি দেশে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ফলাফলে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ (যেমন- পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ ক্যাডার) পদগুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের জয়জয়কার। ব্যাপারটি সাদাচোখে দেখলে ভালোই লাগবে। সাধারণত মেধাবীরাই এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। মেধার মূল্যায়ন হয়েছে। মেধাবীরা দেশেই থাকছেন। মেধার পাচার হয়তো কিছুটা কমবে।

সামনের সারির মেধাবীরা সাধারণত দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজ গুলেতো পড়াশোনা করে থাকেন। তাঁরা তাঁদের মেধার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে চান। তাঁরা ৪-৫ বছরে যে জ্ঞান লব্ধ করেছেন, তার যথাযথ ব্যবহার করবেন, আবিষ্কার করবেন। যার মাধ্যমে দেশ, জাতি তথা সমগ্র মানবজাতি উপকৃত হবে। এখন তাঁরা যদি এসব ক্যাডারে চাকরি করেন, তাহলে তাঁরা কি তাঁদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করলেন। হ্যাঁ, এটি সত্যি, তাঁরা মেধার সর্বোচ্চ প্রয়োগ সেখানে ঘটাতে চাইবেন। ফলে সেখানকার সেবার মান হয়তো ভালো হবে। কিন্তু একই সঙ্গে এটি চিন্তার বিষয়ও বটে।

এমন টেকনিক্যাল স্কিলধারী লোকজন কেন নন-টেকনিক্যাল ফিল্ডে যেতে চাচ্ছেন। সরকারি বেতনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা এখন বেশি। কিন্তু, তাঁরা তো এর থেকেও বেশি পেতে পারতেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বা নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে। জানতে ইচ্ছা হয়, এর থেকেও কি বায়বীয় কোনো কারণ আছে, যা তাঁদের ভিন্ন দিকে ধাবিত করতে প্ররোচিত করছে।

আমাদের এখনকার চলিতটাই যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। সবাই অল্পতেই বেশি পেতে চাই। সবাই সব কাজে প্রথম হতে চাই। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের নির্দিষ্ট শক্তির জায়গা ও স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য আছে। প্রত্যেকেই স্ব-স্ব জায়গায় শ্রেষ্ঠ। রাজনীতিবিদেরা রাজনীতি করুন, ডাক্তাররা ডাক্তারি করুন, শিক্ষকেরা শিক্ষকতা, গবেষকেরা গবেষণা করুন। নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা থেকেই যদি আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিতে পারি, তবেই মানসম্মত কাজ পাওয়া সম্ভব।

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

হয়তো এ কারণেই যাঁর কাছ থেকে যা পেতে চাই, তা পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রেই এটা প্রতীয়মান। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে সবার আশা থাকে, পড়াশোনা, গবেষণানির্ভর কর্মমুখর এক পরিবেশ, কিন্তু পাচ্ছি ভিন্ন জিনিস। দুই-চারটি ব্যতিক্রম বাদে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে একই চিত্র। আশার কথা, বেসরকারিগুলো ঠিকমতো চলার চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দেশে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ) কর্তৃক প্রথম করোনার (কোভিড-১৯) জিন নকশা উন্মোচিত হয়। সম্প্রতি, ২ জুলাই গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড নামের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির টিকা আবিষ্কারের প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সন্তোষজনক ফলাফল ঘোষণা সরকারের সব মহলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (যারা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে দাবি করে) দেশের নামকরা সব গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে। অথচ এই পুঁচকে কোম্পানির নাম হয়তো অনেকেই জানে না (গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের যাত্রাকাল ২০১৬ সালে)।

এখন টিকা বা ভ্যাকসিন এত বেশি পরিচিত যে, এর কার্যকর টিকা পাওয়া যে সহজ হবে না, তা কম-বেশি সবাই জানে। এখন পর্যন্ত ১৪০টির বেশি টিকার এ রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। নিত্যনতুন এই লিস্ট আরও লম্বা হচ্ছে। অনেকেই শেষ পর্যন্ত সফলতা পান না। তাই গ্লোব বায়োটেক সফলতা না পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং সফলতা পেলেই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার ঘটবে। কারণ, বিশ্বের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠানই এই টিকা নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত নয়। তবে তারা আশাবাদী, ভালো ফলাফল আসবে।

হয়তো অনেকেই সমালোচনার বাক্যবাণে গ্লোব বায়োটেককে ঝাঁঝড়া করে ফেলবেন বা ফেলছেন। গণস্বাস্থ্যের কিটের মতো গঠনমূলক সমালোচনা করার চেয়ে নিরুৎসাহিত করাতেই নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করবেন। আমরা হয়তো-বা এমনই। নিজে করব না, অন্যকেও করতে দিতে যত আপত্তি। গ্লোব বায়োটেক তো নিজের টাকা খরচ করে এত দূর এসেছে, নতুন কিছু করার চেষ্টা করছে। লকডাউনের মধ্যেও কাজ করে গেছে। যেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণাও এই সময় বন্ধ রেখেছে। অথচ, কোভিড-১৯ নিয়ে গবেষণা করা অতিপ্রয়োজনীয় কাজের মধ্যে ছিল। তাই প্রশংসা করতে না চাইলেও অন্তত গঠনমূলক সমালোচনা তাদের প্রাপ্য, যা পরবর্তী প্রজন্মকে নতুন কাজে উৎসাহী করবে। যা বাঁকা পথটিকে সোজা হতে সাহায্য করবে।

*পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা। [email protected]