ঢাবি-জীবনের কথা: যে পথে আলো জ্বলে ৩

ঢাবি কার্জন হলে রসায়ন বিভাগ। ছবি: লেখক
ঢাবি কার্জন হলে রসায়ন বিভাগ। ছবি: লেখক

শিক্ষার উপকরণের সহজলভ্যতা, গুণী শিক্ষকের আধিক্য, আর্থিক সচ্ছলতাসহ বিভিন্ন কারণে ঢাকার ছাত্রছাত্রীরা মেধায়-মননে এগিয়ে, তা অনস্বীকার্য। রসায়ন বিভাগে আমি তা দেখেছি।

নটর ডেম কলেজ আর ঢাকা কলেজে পড়ুয়ারা একটু বেশিই এগিয়ে, এ–ও বুঝলাম। এই ভালো ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে দরকার কঠিন অধ্যবসায়। পেছনে ফেলে আসা বছরগুলোর অজানা সেই একাডেমিক বিষয়ে এই স্মার্টদের সঙ্গে সমতা আনতেই অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। সঙ্গে চলতি ক্লাসের কঠিন কঠিন বিষয় তো আছেই।

আমি কাঁদি। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে ওঠে। কেউ বলে, ‘পথিক ভয় পেয়ো না, উঠে দাঁড়াও।’ আমি উঠি, মসজিদে নামাজ পড়ি। দোয়া করি, শক্তি তুমি দাও প্রভু। কথা বলি একই হলে থাকা নতুন বন্ধু বায়োকেমিস্ট্রির জুবায়ের, ফলিত পদার্থের নাইম, কম্পিউটার বিজ্ঞানের জুলিয়াস ও পরাগদের সঙ্গে। ওরা সাহস দেয়।

অজৈব রসায়নের ‘অ্যানালাইটিক্যাল’ ল্যাবরেটরি। ফ্লেম টেস্ট, চারকোল ট্রিটমেন্ট, টাইট্রেশন, ইনডিকেটর-লিটমাস, ফেনফথেলিন, থাইমল, মিথাইল অরেঞ্জ, মিথাইল রেড—এসব কী যেন হাবিজাবি কাজ। সবকিছু মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। বুঝি না। ল্যাবরেটরি ক্লাসের দায়িত্বে থাকা তিন শিক্ষকের একজন হলেন ড. এতমিনা ম্যাডাম। স্পষ্টভাষী, অপরূপ রূপের অধিকারী। আর সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। ঘোমটা পরা এই শিক্ষকের মধ্যে একজন মায়ের সব মায়া দেখতে পেলাম। তাঁর সঙ্গে আছেন একটু রাগী দুজন অধ্যাপক—ড. আলতাফ আর তাঁর সহযোগী অধ্যাপক ড. আনোয়ার। ভরসা খুঁজে এতমিনা ম্যাডামকে স্পষ্টতই বললাম অ্যানালাইটিক্যাল ল্যাবে আমার না বোঝার অপারগতা। দিন দিন পরম মমতায় একটু একটু করে তাঁর কাছে বিষয়টি শিখেছি। আত্মবিশ্বাসে ঢের জোর পেয়েছি।

রসায়নের কিছু বিষয় পড়তে মজা পাই। কিছু ক্লাসের পুরোটাই বুঝি না। তারপরও কোনো ক্লাস ফাঁকি দিইনি। শিক্ষকদের পড়ানো বিষয়গুলোকে নোট করেছি। প্রতিটি বিষয়ের আলাদা আলাদা পরিচ্ছন্ন নোট করতে হবে, দেখে শিখেছি। এই ফজলুল হক হলেই আছেন একই বিভাগের সিনিয়র তাজিম ভাই, রওশান ভাই, কামরুল ভাই। তাঁরা সবাই নিজ নিজ ক্লাসে প্রথম! সুযোগ খুঁজেছি তাঁদের সঙ্গে একটু কথা বলতে। মিশতে। তাঁরা ভালো ছাত্র, ভালো মানুষ হবেনই, আশা আমার। হ্যাঁ, ঠিক তা–ই। সুযোগ পেয়েছিও। এগিয়ে যাওয়ার কৌশল বলেছেন তাঁরা আর দিয়েছেন সাহস।

কোনো ক্লাস ফাঁকি দিই না। তবে বিশেষ কারণে একদিন একটি ক্লাসে উপস্থিত হতে পারিনি। বিশেষ ক্ষতি হয়ে গেল আমার। ইতিমধ্যে ভালো ছাত্রী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া একজনের কাছে সাহায্য চাই। না, ক্লাস নোট সে দিল না। মনে প্রচণ্ড জেদ চেপে গেল। এটা ভালো। এই মফুকে সে আসলে নিজের অজান্তেই প্রতিযোগিতার মাঠে নিয়ে এল।

অধ্যবসায়ে আরও মনোযোগী হই। দিন যায়। ধীরে ধীরে আস্থা বাড়ে। পেছনের সারির বেঞ্চ ছেড়ে সামনের সারিতে এগোচ্ছি। বাড়ছে সাহস। ক্লাসে শিক্ষককে বেশি বেশি প্রশ্ন করি। শিক্ষকের মনোযোগ কেড়েছি। বিধাতা বোধ হয় কথা শুনেছিলেন। ভিশন ঠিক করি, জয় করব। আর একদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হব।

প্রথম বর্ষ পরীক্ষা শেষে ফল বের হলো। খুব ভালো করেছি। কার্জন হলে একা হাঁটি। রাগে আর খুশিতে বলতে চেয়েছি ‘পারলে ঠেকাও’। আনন্দে গা ভাসালে চলবে না, নিজেকে বোঝাই। পরে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। বাধা পেয়েছি। দুজন বন্ধু আমার দুটি ক্লাস নোট নিয়ে হারিয়েছিল। বিপদে পড়েছি, তবু থেমে যাইনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ পেরিয়ে বিএসসি (সম্মান) পরীক্ষায়ও ভালো ফলের ধারাবাহিকতা থাকল। খুব দুঃখ, ক্লাস নোট না দেওয়া ওই মেয়েকে আসলেও আমি হারাতে পারিনি। সে হয়ে যায় প্রথম আর দ্বিতীয়তে আমার অবস্থান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকসহ ডিনস অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের সঙ্গে সস্ত্রীক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখকসহ ডিনস অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তদের সঙ্গে সস্ত্রীক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

কার্জন হল বিজ্ঞান অনুষদ থেকে রসায়নে চারজনকে (প্রথম থেকে চতুর্থ) ডিনস অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে। এটাই প্রথমবার। আয়োজন চলছে। তা পাবে লিমা, সাদেক, টুশি ও আফরিন। নিজের অসচেতনতায় অতীতে ঢাকা বোর্ডে স্ট্যান্ডধারী তুখোড় মেধাবী মাহবুব অল্পের জন্য এই সুযোগ পায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের বিশাল অডিটরিয়ামে শুরু হলো ডিনস অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান। মঞ্চে আছেন উপাচার্য, বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় প্রধানরা। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, বন্ধু, অভিভাবক, আত্মীয়—সবার উপস্থিতিতে অডিটরিয়াম পূর্ণতা পেয়েছে। সে সময়ের তুমুল জনপ্রিয় এবং আজ অবধিও, জাতির অহংকার ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ স্যারকেও পেলাম। স্যার রসায়নের অধ্যাপক, তাঁর সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমাদের কাছে এই পরিচয় সবার আগে! ধন্য আমরা। স্যারের কথা শুনলাম, আর তাঁকে আমাদের মাঝে নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করলাম। তিনি আমাদের প্রেরণা। সদা-সর্বদা।

গুণীজনেরা বলেন, ‘বিপদে হতাশ হতে পারো, ভেঙে পড়ো না। উঠে দাঁড়াও। চলতে থাকো, খুঁড়িয়ে হলেও। ভয়ে ভীত হবে না। মনে সাহস রাখো। গর্জে ওঠো। না পাওয়ার বেদনায় ব্যথিত হতে পারো, মনে শক্তি রাখো। আবার জ্বলে ওঠো।’ সেসব গুণীজনকে অনেক শ্রদ্ধা।

গরিব বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য একাডেমিক, আবাসন আর খাওয়ার খরচাদির দুশ্চিন্তা সবকিছুর ওপরে। আমি নিম্নমধ্যবিত্তের একজন। জীবনের তাগিদে রসায়নের রসবিহীন শক্ত বিষয়গুলো আয়ত্তে আনার পাশাপাশি আয় করারও দরকার ছিল। হন্যে হয়ে টিউশনি খুঁজি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বছরগুলোতে টিউশনি পাওয়া কষ্টকর হয়। ভাগ্যের ব্যাপার অনেকটা। একবার সেটা পেয়ে গেলে পরিচিতি বাড়ে। অভিজ্ঞতা আর সুনামে পরেরবার পেতে সহজ হয়ে যায়। আমি ভাগ্যবানদের দলে। বাবা-মায়ের দৈন্যদশায় তাঁদের কষ্টের বোঝা বাড়াইনি।

এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে অনেক ছাত্রছাত্রী পড়িয়েছি। তখন আমি একজন প্রাইভেট টিউটর। পড়াই আর বিনিময়ে টাকা পাই। দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিনিয়ত কঠিন অধ্যবসায়ে নিজেকে এগিয়ে রাখার সদা চেষ্টা করেছি। টিউটর হিসেবে কদর বেড়েছে। ঢাকা কলেজে পড়ুয়া ছেলেকে পড়ানোর দায়িত্ব দিতে সরকারের খুব উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা যেদিন ফজলুল হক হলে এসে এই মফুকে নিয়ে গেলেন, আত্মবিশ্বাসটা সেদিন অনেক গুণ বেড়েছে। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীকেও পড়ানো শুরু হলো।

পথ চলতে একদিকে যেমন অভাবি, ভুখানাঙ্গা ও দিনমজুরশ্রেণির মাটির মানুষের সঙ্গে মিশেছি, অন্যদিকে সমাজের অনেক উঁচু দরের যোগ্যতাসম্পন্ন অথবা বিত্তবান মানুষের সঙ্গে মেশারও এক অসাধারণ সুযোগ হয়েছে। মিশ্র অভিজ্ঞতা—ভালো লাগা, খারাপ লাগা।

পড়াতে গিয়ে রিকশায় কত উঠেছি। আহ্‌ কী যে মজার সে বাহন। ভাড়া ঠিক করার সময় রিকশাচালকের সঙ্গে কখনো দর–কষাকষি করলেও গন্তব্যে পৌঁছার পর সুন্দর করে ধন্যবাদ দিয়ে কিছু টাকা বেশি দেওয়ার অভ্যাস ছিল। তখন এতে তাদের চেহারা আর আচরণে পরিবর্তন আসে। তাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছি চোখেমুখে পরিপূর্ণ তৃপ্তির অমায়িক হাসিটা। এই ভালো লাগাটা উপভোগ করেছি। অনেকদিন, অনেকবার। মানুষের হাসিমাখা মুখ দেখতে খুব ভালো লাগে। চলবে...

*পিএইচডি: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, কানাডা। [email protected]

আরও পড়ুন: