থমকে যাওয়া জীবন, মৃত্যুর আলিঙ্গনে-১৪

রোদেলার সঙ্গে তিন কুকুরছানা। ছবি: লেখক
রোদেলার সঙ্গে তিন কুকুরছানা। ছবি: লেখক

জীবন কি শুধুই কষ্টের? জীবনে হতাশা আছে, কষ্ট আছে, আবার আছে আনন্দ। আজ এই মুহূর্তে সে রকমই ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। বাইরে ঝলমলে রোদ, সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে। ভীষণ জ্বল জ্বলে। তবে সেই আলোয় এক আহ্লাদী, মায়াময় পরশ।

কাঠের ডেকটার সিঁড়ির গোড়ায় রোদেলা বসে আছে। তার সঙ্গে তিনটি কুকুরছানা। একটা ওর কোলে উঠছে, আরেকটা শরীরের ফাঁক গলে চলে যেতে চাইছে সিঁড়িতে, আরেকটা ওর জামার লেস ধরে কামড়াচ্ছে। ওর মুখে কি এক মায়াময় আচ্ছন্নতা। ওর বসে থাকার ভঙ্গিতে ভীষণ দায়িত্বশীলতা। এরা ছোট্ট পাপি। এদের বয়স দুই মাস। এদের জন্মের পর ওদের মাকে নেওয়া হয়েছে অন্য জায়গায়। ওদেরকে দেওয়া হবে দত্তক। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত ওদের থাকার জায়গা নেই। রোদেলাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, ওদের কিছুদিনের জন্য থাকতে দিতে পারবে কি না। রোদেলা ওদের বাসায় এনেছে। করোনাকালে আমাদের মা-মেয়ের চমৎকার সময় কাটছে এদের নিয়ে।

রোদেলা পরিবেশ নিয়ে কাজ করে। প্রকৃতি নিয়ে ওর অনেক উদ্বেগ। সে ভালোবাসে পশুপাখি। বাড়ি এলে সেল্টার হোম থেকে কুকুর পাঠানো হয়, দেখাশোনা করার জন্য। সেটা সে আনন্দের সঙ্গে করে। একে বলে ভলায়ান্টিয়ার ওয়ার্ক। এসব দেশের মানুষ এই ভলান্টিয়ার ওয়ার্ক প্রচুর করে, কেউ করে দায়িত্ব থেকে, কেউ করে ভালো লাগা থেকে, আবার কেউ শুধু চমৎকার সময় কাটানোর জন্য।

এই করোনাকালে, ভলান্টিয়াররা বিভিন্নভাবে কমিউনিটিকে সাহায্য করতে চাইছে। রোদেলা যেহেতু কুকুর পছন্দ করে, তাই সে আবেদন করল কুকুরের ফসটার মা হতে। ফসটার হোম থেকে আবেদন পাওয়ার পর এসে দেখে গেছে কেমন বাড়ি, কতজন মানুষ থাকে আমাদের বাসায়, কতটুকু খেলার জায়গা আছে কুকুরদের জন্য, সে বাড়ির মানুষগুলো কতটুকু কুকুর পছন্দ করে। এত কিছু দেখার পর তাদের পছন্দ হলেই তারা কুকুর দেবে পালার জন্য। যদিও থাকবে মাত্র এক থেকে দুই সপ্তাহ। তারাই সবকিছু সাপ্লাই করবে।

ওদের থাকা-খাওয়ানো, স্বাস্থ্য—সবকিছুর দায়িত্ব এখন তার। এ দেশে অনেক কুকুর, বিড়াল থাকে, যাদের ঘর থাকে না। এই করোনাকালে তাদের থাকার জায়গার বড়ই অভাব। করোনার ভয়ে তো মানুষ ঘর থেকেই বের হয় না। পশুপাখির শরীরেও করোনা সংক্রমিত হয়। পশুপ্রেমী কিছু মানুষ বিভিন্ন নন প্রফিট অরগানাইজেশন করে যারা ঠিকানাবিহীন এসব পশুপাখির দায়িত্ব নেয়। তাদের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করে। তাদের খাওয়া, চিকিৎসা, আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র এই সংগঠনই দেয়। তাদেরকে ফান্ড করে পশুপ্রেমী মানুষেরা।

কুকুরের জন্য পার্ক। ছবি: লেখক
কুকুরের জন্য পার্ক। ছবি: লেখক

রোদেলার দায়িত্ব তাদের প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, আদবকায়দা প্রশিক্ষণ দেওয়া, আর যত্ন-আত্তি করা। এবার ওদের জায়গা হলো গ্যারেজে। বাইরে গ্রীষ্মকাল, কটমটে রোদ। ওখানে ওরা আরামে থাকতে পারবে। পুরো গ্যারেজটা ওদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হলো। তারা তিনজন গ্যারেজজুড়ে খেলাধুলা করে ক্লান্ত হয়ে তাদের ছোট্ট বাক্সে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা মা-মেয়ে তিনবেলা খাওয়ার পর ভ্রমণে বের হই লেকের পাড়ে। ওরা তিন ভাইবোন খুনসুটিতে মেতে ওঠে। কিংবা ঘাসের আড়ালে খুঁটে খুঁটে খুঁজে ফিরে প্রকৃতির রহস্য। তাদের প্রাত্যহিক শারীরিক পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা সে–ই তিনবেলা ভ্রমণেই সমাধান হয়। কুকুররা বেশিরভাগই নিজেদের থাকার জায়গা নষ্ট করে না। এ এক অদ্ভুত বুদ্ধিমত্তা তাদের। ভালোবাসা বুঝতে তাদের মুহূর্তই লাগে না। এক টুকরো ভালোবাসার জন্য তারা একবুক ভালোবাসা দেবে। কুকুরের মতো বাধ্য প্রাণী আর আছে কি না, আমার জানা নেই।

বিজ্ঞানীদের মতে, কুকুরের জন্ম হয়েছে wolf (নেকড়ে) থেকে। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে কোনো দুর্বল নেকড়েকে পোষ্য নিয়েছিল। তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলো সেই পোষ্য প্রাণীটি। বিবর্তনের ধারায় আস্তে আস্তে এই প্রাণীটির জীবন আবর্তিত হতে থাকল মানুষকে ঘিরে। শিকার, মাছ ধরা, খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো এবং একজন দেহরক্ষী হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভার ছিল তখন। আস্তে আস্তে কুকুর মানুষের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং অনুগত সঙ্গীতে পরিণত হলো। নিজের জীবন বাজি রেখে মালিকের জীবন রক্ষার অনেক গল্প আমরা শুনেছি।

ইউরোপিয়ান, আমেরিকানরা এখন কুকুরকে পরিবারের অংশ হিসেবেই মনে করে। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই একটি কুকুর থাকে, যাকে তারা নিজেদের সন্তানের মতোই বড় করে। একটা কুকুরের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়, খাদ্য, ওষুধের জন্য। তাদের জন্য খেলনাও কিনতে হয়। কখনো কখনো তাদের চিকিৎসায় খরচ হয় প্রচুর টাকা। এ কারণে এসব দেশে আছে ইনস্যুরেন্স। ইনস্যুরেন্স কাভার করে সব ধরনের শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা। আছে স্পেশালাইজড ডাক্তার, নার্স। এদের বলে ভেট।

এই করোনাকালে অস্থির সময়ে কুকুরের মতো ভালো সঙ্গী আর হয় না। কুকুরের বুদ্ধিমত্তা একজন টডলার (১৮ মাস বয়সী শিশু) বুদ্ধিমত্তার সমান। তার আচার-আচরণও সে রকমই। যদি কেউ একবিন্দু ভালোবাসা দেয়, তার বিনিময়ে সে এক সাগর ভালোবাসা দেবে। আর থাকা-খাওয়ার পর মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তো ভালোবাসাই।

এই মহামারির সময় মৃত্যু ভয়, বিষণ্নতা, আবেগ, অনিশ্চয়তা—সবকিছু মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। এই মুহূর্তে মনের সজীবতার জন্য আবার প্রকৃতির কাছেই মানুষকে সমর্পণ করতে হবে।

প্রাণীপ্রেমীরা নিয়মিত প্রিয় প্রাণীর সঙ্গে হাঁটতে বের হন। ছবি: লেখক
প্রাণীপ্রেমীরা নিয়মিত প্রিয় প্রাণীর সঙ্গে হাঁটতে বের হন। ছবি: লেখক

পশু, পাখি, গাছপালা তারই অংশ। প্রকৃতিকে ভালোবেসেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রকৃতির যত্ন নিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে মানুষ। এখনই সময় এই প্রতিশ্রুতির। এসব দেশে শিশু এবং হার্টের রোগীদের জন্য কুকুরথেরাপি দেওয়া হয়। তারা কুকুরের সঙ্গে সময় কাটায়, তখন তাদের মনে আনন্দের সঞ্চার হয়, মানসিক প্রশান্তি তৈরি হয়, হাইপার দূর হয়। শিশুরা দায়িত্বশীল হয়, মানবিক হয়, প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যের প্রতি সহনশীল হয়।

দীর্ঘদিন মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চললে অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন মনস্তাত্বিকেরা। তাঁদের মতে, ‌‘ইতিবাচক স্পর্শে মানুষের শরীরে ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন নামের হরমন নিঃসরন বাড়ায় এবং করটিজল নিঃসরন কমায়, যার ফলে ইতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি হয়। যেমন অনুপ্রেরণা, সন্তুষ্টি, নিরাপত্তা, মানসিক চাপমুক্তি ইত্যাদি। দীর্ঘদিন সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে। শিশুর সম্মিলিত বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমাতে পারে এবং অতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে।

মানসিক চাপ দূর করতে বাগান করা এবং পোষা পশুপাখির আদর-যত্ন করার পরামর্শ দেন তাঁরা। নিয়মিত ঘুম, খাবার গ্রহণ, শরীরচর্চা, ভার্চ্যুয়ালি সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখা, সুস্থ বিনোদন যেমন নাচ, গান, সিনেমা দেখা, ছবি আঁকা, বাগান করা এমনকি রান্নাও মানসিক চাপ কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে৷’ সমকাল পত্রিকা থেকে নেওয়া।

অনেক বাংলাদেশি বলেন, বাংলাদেশে কত শিশু না খেয়ে থাকে, তাদেরকে না খাইয়ে কুকুর নিয়ে আদিখ্যেতা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? এই বিষয়ে আমার বক্তব্য মানুষের জন্য সেবা দেওয়া এক জিনিস আর পশুপাখিকে ভালোবাসা অন্য জিনিস। এখানে তুলনা চলে না। যার যেটি ভালো লাগে, সেটিই করবে। মানুষ তো ভালো লাগার জন্য কত কিছু করে। নিজের ভালো লাগার জন্য, মনের সুস্থতার জন্য এমন কিছু করা উচিত, যাতে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকে, আবার পরিবেশও দূষিত না হয়। পৃথিবীর তাবৎ প্রাণিকুলের প্রতি মানুষ মানবিক হোক। মানবিকতাই তো মানুষের ধর্ম।