সৃজনশীল কাজে, মুক্তি পাক হীনতা

করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা সবাই মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার অপেক্ষায় আমরা সবাই। করোনার ভয়াবহতা আমাদের জীবনযাত্রাকে যেমন ভীষণভাবে পাল্টে দিয়েছে, ঠিক তেমনই অনেক কিছু নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। এই মুহূর্তে অনেকটা সময়ই আমরা সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটাচ্ছি।

অনলাইনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হচ্ছে। এ ধরনের আয়োজন শিল্পী এবং দর্শক–শ্রোতাদের মন ভালো রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং অবশ্যই কিছু অনুষ্ঠান এতটাই তথ্যসমৃদ্ধ, যা আমাদের জ্ঞানভান্ডারকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করছে।
কিন্তু এর পাশাপাশি সৃজনশীল মানুষেরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটে যাওয়া কিছু বিরূপ ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

বহু মানুষের সৃজনশীলতা নানাভাবে প্রচারিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে মানুষটির মস্তিষ্কপ্রসূত এই সৃষ্টি তাঁকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করেই তার পোস্টটিকে প্রচার করা হচ্ছে এমনভাবে, যেন যিনি প্রচার করছেন এটি তাঁর সৃষ্টি। এ ধরনের ঘটনায় সৃষ্টিশীল মানুষ যেমন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন, ঠিক সে রকমই ভবিষ্যতে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে উৎসাহী হন না।

স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের ঘটনা আমাদের শিল্পীসত্তাকে অনেকাংশে আহত করছে বলে আমার বিশ্বাস। সর্বোপরি এই হীন মানসিকতার আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

‘সৃষ্টি’—তা সে যেমনই হোক, তার প্রশংসা কিংবা নিন্দা সৃষ্টিকর্তারই প্রাপ্য। অনেক সময় সঠিক সমালোচনা সৃজনশীলতাকে আরও বেশি পরিপক্ব করে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও সম্প্রতি এ ধরনের ঘটনার শিকার। আমার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ছায়ানট (কলকাতা) প্রস্তুত করেছে এক সুবৃহৎ ভিডিও তথ্যচিত্র ‘নজরুলের চুরুলিয়া’, যেটি ডিভিডি আকারে কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ড থেকে এই বছরের মে মাসে বিশ্বব্যাপী মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। বাঁশরীর (বাংলাদেশ) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত এই প্রকল্পে ভাষ্যপাঠে রয়েছেন কাজী নজরুল ইসলামের ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম ও সুবিখ্যাত বাচিকশিল্পী শ্রী দেবাশীষ বসু। স্বাগত গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃজন-নির্মাণে ডিভিডি ও ডিজিটাল আকারে প্রকাশিতব্য এই তথ্যচিত্রে নজরুলের জীবনের নানা সময়ের স্মৃতি-সংবলিত স্থানগুলোর বিষয়ে নানা জানা-অজানা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।

আশা করা যায়, সাম্প্রতিক এই করোনাকেন্দ্রিক পরিস্থিতি মিটে গেলে শিগগিরই মুক্তি পাবে ‘নজরুলের চুরুলিয়া’। ছায়ানট (কলকাতা) ও কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ডের তরফে এই তথ্যচিত্রটি সম্বন্ধে ফেসবুকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি, সঙ্গে একটি ৩ মিনিটের প্রোমো-ভিডিও প্রকাশ করা হয় কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ডের ইউটিউব চ্যানেলে।

এমতাবস্থায়, সম্প্রতি এই তথ্যচিত্রটির নিবেদক ছায়ানট (কলকাতা), পরিচালক শ্রীমতী সোমঋতা মল্লিক ও প্রকাশক/পরিবেশক কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ড—কারও সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ না করে এবং পরিচালকের মৌখিক অসম্মতি সত্ত্বেও বাঁশরীর (বাংলাদেশ) তরফে সম্পূর্ণ তথ্যচিত্রটির একটি ‘ড্রাফট কপি’ ইউটিউবে প্রকাশ করে দেওয়া হয় এবং ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ, প্রোফাইল ও পেজে সেই লিংকটি শেয়ার করা হয়। ভিডিওটিতে ‘ছায়ানট (কলকাতা) নিবেদিত’ থাকলেও ইচ্ছে করে এই ফেসবুক পোস্টগুলোতে বাঁশরী (বাংলাদেশ) নিজেদের নামটিই প্রথমে লেখে। সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে আপলোড করা এই ভিডিওটি মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কপিরাইট আইনের কারণে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ বাঁশরীর (বাংলাদেশ) চ্যানেল থেকে মুছে সরিয়ে দেন ও ছায়ানট (কলকাতা) ও প্রকাশক/পরিবেশক কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ডকে ই–মেইল করে বিষয়টি জানান।

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের দুই দেশেরই এক গর্বের জায়গা। তাঁকে নিয়ে দুই দেশেরই বেশ কিছু মানুষ বা সংস্থা নানা রকম সৃজনশীল কাজ করছেন ও করে চলেছেন। বিগত কয়েক বছরে ছায়ানট (কলকাতা) ও কোয়েস্ট ওয়ার্ল্ড বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক কাজ বিশ্বব্যাপী প্রকাশ করেছেন এবং আগামী দিনেও প্রকাশ করবেন। আপনাদের সবাইকে আমরা এসব গঠনমূলক কাজে আগের মতোই পাশে পাব এবং এ বিষয়ে যেকোনো বেআইনি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আপনারা রুখে দাঁড়াবেন—এ আশা করি।

পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই, আমাদের সবার উচিত শিল্পী ও তাঁর সৃষ্ট শিল্পকর্মের প্রতি যত্নবান হওয়া। কাজী নজরুল ইসলামের লেখা প্রবন্ধ ‘সংস্কৃতির চর্চা’তে তিনি স্পষ্টতই বলেছেন, ‘ফুল ফোটানোই আমার ধর্ম। তরবারি হয়ত আমার হাতে বোঝা, কিন্তু তাই বলে তাকে আমি ফেলেও দেইনি।

‘আমি গোধূলি বেলায় রাখাল ছেলের সাথে বাঁশি বাজাই, ফজরে মুয়াজ্জিনের সুরে সুর মিলি০য়ে আজান দেই, আবার দীপ্ত মধ্যাহ্নে খর তরবার নিয়ে রণভূমে ঝাঁপিয়ে পড়ি, তখন আমার খেলার বাঁশি হয়ে ওঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণশিঙ্গা। সুর আমার সুন্দরের জন্য, আর তরবারি সুন্দরের অবমাননা করে যে সেই অসুন্দরের জন্য।’

তাঁর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, প্রতিবাদী হওয়া আজ ভীষণ প্রয়োজন।

লেখক: সভাপতি, ছায়ানট (কলকাতা), ভারত।