এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে দেখা হয়েছে বেশ, মনে রইল কথার রেশ

অ্যান্ড্র কিশোর
অ্যান্ড্র কিশোর

আশির দশকের কথা বলছি। দেশে রাস্তায় বেরোলে কোথাও না কোথাও কানে ভেসে আসত ভারী কণ্ঠের মনজুড়ানো কিছু গান। সে গ্রামে বা শহরে যেখানেই বলি—সর্বত্র একই শব্দ। আর এমন সব ছিল গানের কথা, না চাইলেও ইচ্ছে–অনিচ্ছার বালাই শাট, মুখে চলে আসত গানের কথা। ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরালে ঠুস’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘আমার বুকের মধ্যি খানে’—আরও কত যে গান, বলে শেষ করা যাবে না। এমনকি রিকশায় চড়লে শুনতাম রিকশার মধ্যেও রেডিওতে বাজছে এন্ড্রু কিশোরের সেই গান।

এমন সময় ছিল যে খ্যাতিমান এই শিল্পীর গান শুনে নিজেরও ইচ্ছে হয়েছিল গান শেখার। তাই গান শিখতে ভর্তি হয়েছিলাম ওয়াইজঘাট বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। সেখানে প্রথম দিন টাকা দিয়ে গানের কোর্সে ভর্তি হতে গিয়ে যখন মনে হলো আমার গলা দিয়ে গানের স্বর বের হবে না, তখন গিটারের কোর্সে ভর্তি হই। ওই সময় বিটিভির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন দেখতাম শিল্পী তার শার্টের বুকের বোতাম খুলে গলায় বড় ক্রুশ ঝুলিয়ে হাত নেড়ে গান গাইছেন, তখন মন ভরে যেত তা দেখে। তাকে ফলো করতে একসময় গলায় আমিও ক্রুশ ঝোলাতাম।

এমনকি মুখে বড় দাড়িও রেখেছিলাম ছাত্রজীবনে। জাপানে এসেও তার ফলোয়ার হিসেবে মুখে চাপদাড়ি রেখেছি আমি। কেউ কেউ আমাকে দাঁড়িতে দেখে তখন বলতেন এন্ড্রু কিশোরের মতো দেখা যায়। যদিও তা শুনে মনে করতাম বিষয়টি সত্য নয়, তবুও শুনতে ভালো লাগত।

প্রথম এন্ড্রু কিশোরকে খুব কাছ থেকে দেখি, রমনা ক্যাথেড্রালে প্রাগ বড়দিন উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি। আলোচনা ও কেক কাটা অনুষ্ঠান শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেছিলেন প্রয়াত সমর দাস। এরপর বিটিভিতে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। সেই বয়সে তার সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে কথা বলার কারণ ছিল একটি বিশেষ কারণে এবং সেটি ছিল তার গলায় ক্রুশ ঝোলানো দেখে। এ ছাড়া কয়েকবার দেখা হয়েছে সদরঘাট ব্যাপ্টিস্ট চার্চে। যতটা মনে পড়ে, সেখানে সমর দাসের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছিলেন উনি। আমি সেখানে এক এনজিওর হয়ে আশপাশের বস্তিতে কিছু ঘর তৈরির কাজ করেছিলাম, যার বিল আনতে গিয়ে অফিসে তখনই দেখা হয়েছিল।

তাকে দেখলেই গুনগুন করে তার সেই সময়ের জনপ্রিয় গানের প্রথম কলিগুলো গাইতাম। একদিন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে এন্ড্রু কিশোর এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মিলে কথা বলছিলেন, তখন সামনে গিয়ে বলেছিলাম, আমি আপনার খুব ভক্ত। বলেই হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম হ্যান্ডশেক করতে। তিনি আমার হাত ধরে এমন জোরে চাপ দিলেন যে ব্যথায় বসে পড়লাম। এরপর টেনে তুলে দাঁত বের করে হাসলেন। তখন তো চাইলেই আর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার সুযোগ ছিল না যে স্মৃতি ধরে রাখব। তবে মনের ভেতর গেঁথে রেখেছি আজকের দিনে তাকে নিয়ে কিছু লেখার কথা ভেবে। পরে অবশ্য শুনেছিলাম সমর দাসের সঙ্গে তাঁর কোনো কারণে মনোমালিন্য ছিল সেই সময়। বিষয়টি জানা সত্ত্বেও তাঁর কাছে জানতে সাহস হয়নি তাঁর খ্যাতির উচ্চতার কথা জেনে।

ফার্মগেট এলাকার ছোট–বড় সব রাস্তায় তখন রিকশা চলত। মাঝেমধ্যে দেখেছি তেজগাঁও কলেজের আশপাশে রিকশায় কোথাও যেতে। তাঁকে দেখে হাত ওড়ালে চিনতে পারতেন, এটুকুই ছিল তখন আমার আনন্দ। এরপর জাপান আসার কয়েক বছর পর একটি গোষ্ঠীর আমন্ত্রণে এসেছিলেন সংগীত পরিবেশন করতে। যতটা জানি, সেই সময় আয়োজকদের বিরুদ্ধ গ্রুপ ইমিগ্রেশনে ইনফর্ম করেছিল যে তাদের সঙ্গে বাড়তি লোক আসছে, যাদের উদ্দেশ্য আর দেশে ফিরে যাবে না। এমন ইনফরমেশনের কারণে নারিতা এয়ারপোর্টে তাদের কিছুটা ঝামেলা হয়েছিল।

ইমিগ্রেশন থেকে আয়োজকদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা সেখানে গিয়ে অতিথিদের নিয়ে আসতে যেতে ভয় পেয়ে যায়নি বলে শুনেছিলাম। তবে পরে কীভাবে নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে এসেছিলেন জানি না। পরে তাঁর সঙ্গে আমার টোকিওতে দেখা হলে পরিচয় দিয়ে কথা বলার পর এন্ড্রু কিশোর আমার ওপর ভীষণ খেপে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, পৃথিবীর অন্যান্য বেশ কিছু দেশেও গিয়েছেন প্রোগ্রাম করতে কিন্তু জাপানের মতো খারাপ অভিজ্ঞতা তাঁর কোথাও আগে আর হয়নি। এমনকি বলেছিলেন, আয়োজকদের কেউ তাদের ঠিকমতো খোঁজখবর নিচ্ছে না। নাশতাপানির তো বালাই শাট।

এমনভাবে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, যেন আমিই অপরাধ করেছি। সব দোষ আমার, এ জন্য গালাগালি করছিলেন। অবস্থা দেখে ঘনিষ্ঠ একজন আমার পক্ষ নিয়ে বললেন, ওর কোনো দোষ নেই। ও আমাদের এখানে সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। শোনার পর শেষ একটা কথাই এন্ড্রু কিশোর বলেছিলেন যে বেঁচে থাকলে আর কখনো তিনি জাপান বাঙালিদের কোনো অনুষ্ঠানে আর আসবেন না। সেদিনের কথায় মনে হয়েছিল তিনি বোধ হয় খুব রাগী। কিন্তু তাঁর গান শুনে মনে হয় না যে তিনি এতটা রাগী।

যে সময় টোকিওতে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখন আমার দেশে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। নিজের হাতে ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বলেছিলেন দেশে গেলে যেন ফোন করে দেখা করি। কিন্তু তখন দেশে যাওয়ার মতো আমার এখানে কোনো বৈধ কাগজপত্র ছিল না, তাই লজ্জায় আর বলিনি আমার দেশে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমি দেশে যাওয়ার বৈধ কাগজপত্র হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে প্রথম জাপানি বধূকে দেশে নিয়ে যাই। তখন অবশ্য আমার বিচরণক্ষেত্রও ছিল ভিন্ন, যে কারণে দেশে যাওয়ার পর কখনো আর দেখা করার কথা ভাবিনি।

যখন জেনেছি, তিনি অসুস্থ এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে চিকিৎসা করানোর জন্য আর্থিক সহায়তা নিয়েছেন, তখন একবার ভেবেছিলাম জাপানে তাঁর জন্য কিছু করার কথা। পরে যখন দেখলাম আমেরিকা, কানাডা ও ফ্রান্সে আমার এবং শিল্পীর পরিচিত-শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ কেউ ফান্ড কালেকশনের চেষ্টা করছে, তখন আমি এ নিয়ে কিছু করার কথা বাদ দিলাম। তারপর তো উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হয় তাঁকে। ফিরে এলেও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম, বেশি দিন হয়তো বাঁচার সম্ভাবনা নেই তাঁর।

সত্যি সত্যি তিনি চলে গেলেন পৃথিবীর সব মায়া ত্যাগ করে। জাপান আর কখনো আসা হয়নি এ জীবনে গুণী শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের। একটি জরুরি কাজ করছিলাম, এমন সময় দেশের পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে চোখ রাখতেই দেখি এন্ড্রু কিশোরের না–ফেরার দেশে চলে যাওয়ার সংবাদ। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আমার ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিতে দিতে আমি শিল্পীর গান ইউটিউবে সার্চ দিয়ে বাজাতে শুরু করলাম, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস, দম ফুরালেই ঠুস’।

এরপর একের পর এক তাঁর গান বাজছিল, একসময় গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাঁর চলে যাওয়ায় দেশের সংগীতাঙ্গনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা সত্যি। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তাঁর আত্মার শান্তি ও স্বর্গে স্থান দেওয়ার জন্য। ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর। সেই প্রার্থনা করি।