আয়া সোফিয়ায় একদিন

তুরস্কে মেন্টর ইয়াসমিনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
তুরস্কে মেন্টর ইয়াসমিনের সঙ্গে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

গ্রিসের সঙ্গে তুরস্কের বৈরিতা চিরদিনের। সম্প্রতি আয়া সোফিয়া যেন তাদের এ বৈরিতায় আগুনে ঘি ঢালার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছোটবেলা থেকেই তুরস্ক আর ইস্তাম্বুল—দুটি জায়গার ওপর বিশেষ আগ্রহ কাজ করত। পাঠ্যপুস্তকে পড়েছিলাম বিভিন্ন সময়ে যে ইস্তাম্বুল হচ্ছে ইউরোপের প্রবেশদ্বার। অর্থাৎ এশিয়া থেকে ইউরোপে প্রবেশ করতে হলে কিংবা ইউরোপ থেকে এশিয়াতে প্রবেশ করতে হলে ইস্তাম্বুল হচ্ছে সবচেয়ে সহজতর যাতায়াত রুট। ফ্রান্সের ইতিহাস ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিও প্রবল আকর্ষণ ছিল। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, যিনি ফরাসি জাতীয়তাবাদের কান্ডারি হিসেবে সমাদৃত। তাঁর চোখে ইস্তাম্বুল ছিল পৃথিবীর সুন্দরতম নগরী। তিনি এ শহরের প্রেমে এতটাই মজেছিলেন যে তিনি নাকি মনেপ্রাণে সব সময় স্বপ্ন দেখতেন প্যারিস নয়, ইস্তাম্বুলকে তিনি ফরাসি সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে অধিষ্ঠিত করবেন। ওয়াটার লু যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজয়ের মতো এ ইস্তাম্বুলও তাঁর জীবনে ছিল অন্যতম এক ট্র্যাজেডি।

ইস্তাম্বুলকে পৃথিবীর রাজধানী বললেও ভুল হবে না। ২০১০ সালে ইউনেসকো ঘোষিত এ পৃথিবীর কালচারাল ক্যাপিটালের মর্যাদা লাভ করে ইস্তাম্বুল।

আনুমানিক ৬৫৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এ শহরের গোড়াপত্তন হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বরাবরই ইস্তাম্বুল ছিল বিভিন্ন শাসকের চোখের মণি। চতুর্থ শতাব্দীতে পূর্ব ও পশ্চিম—এ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়া রোমান সাম্রাজ্যের অংশ পূর্ব অংশ, যেটি পরবর্তী সময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য নামে পরিচিতি পায়, সে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানীও ছিলও ইস্তাম্বুল। তখন ইস্তাম্বুলকে কনস্টান্টিনোপোল বা দ্বিতীয় রোম নামে ডাকা হতো। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদের নেতৃত্বে এ অঞ্চলটি অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তখন এর নাম কনস্টান্টিনোপোল থেকে ইস্তাম্বুল করা হয়। সে থেকে ইস্তাম্বুল ওসমানী সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ভূমিকা পালন করছিল। একই সঙ্গে ইস্তাম্বুল হয়ে উঠেছিল মুসলিম বিশ্বের খেলাফতের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

সেই ২০১৭ সালের কথা, বাংলাদেশ থেকে প্রথম ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। টার্কিশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটের সুবাদে ইস্তাম্বুলে যাত্রাবিরতির সুযোগ হয়। ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে আমাদের ট্রানজিট ছিল প্রায় ছয় আট ঘণ্টার। ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশে ছেড়ে আসা ফ্লাইটটি ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিংয়ের জন্য অগ্রসর হয় অ্যারোপ্লেনের জানালার ভেতর দিয়ে ইস্তাম্বুলের যতটুকু রূপ অবলোকন করতে পেরেছিলাম, সেটাই যেন অন্তরে চিরজীবনের জন্য গেঁথে গিয়েছিল। কল্পনায় ঘুরেফিরে তাই বারবার ফিরে আসত ক্ষণিকের জন্য স্বাদ পাওয়া সেই সুন্দর মুহূর্তটির।

এরপর থেকে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। কবে ইস্তাম্বুল ভ্রমণ করতে পারব। বিমান থেকে সামান্য সময়ের জন্য ইস্তাম্বুলের যতটুকু চোখে ধরা দিয়েছিল বারবার যেন মনে হচ্ছিল সেটি ছিল জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ইউরোপের অনেক দেশ এবং অনেক নগর ঘুরলেও ইস্তাম্বুলের প্রতি ছিল আলাদা ক্ষুধা। অবশেষে সে সুযোগ আসে একদিন। ইরাসমাস প্লাস একচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় তুরস্কের কুথাইয়া ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটিতে এক সেমিস্টার পড়াশোনার সুযোগ আসে। যেহেতু অনেক দিন ধরেই তুরস্ক ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিলও তাই সে সুযোগটি লুফে নিতে ভুল করিনি।

আয়া সোফিয়ায় মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ক্যালিওগ্রাফিক নিদর্শন। ছবি: লেখক
আয়া সোফিয়ায় মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তম ক্যালিওগ্রাফিক নিদর্শন। ছবি: লেখক

অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্তটি দুয়ারে কড়া নাড়ে। ২০১৯ সালের মার্চের মাঝামাঝি কোনো এক সময়। স্বপ্নের শহর ইস্তাম্বুলে পদচারণের এক সুবর্ণ সুযোগ লাভ করি।

আয়া সোফিয়ার অবস্থান ইস্তাম্বুলের ইউরোপিয়ান অংশে। বস্তুতপক্ষে বলতে গেলে ইস্তাম্বুলের প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ইউরোপিয়ান অংশে পড়েছে। ইস্তাম্বুলের বেশির ভাগ দর্শনীয় স্থান, যেমন সুলতান আহমেদ মসজিদ, তোপকাপি প্যালেস, গ্র্যান্ড বাজার, ব্যাসিলিকা সিস্টার্ন—সব কটির অবস্থান আশপাশে।

আয়া সোফিয়া কোথায়

আয়া সোফিয়া বলতে গেলে সমগ্র ইস্তাম্বুলের এক টুকরো প্রতিচ্ছবি। শুধু আয়া সোফিয়াকে দিয়েই পুরো ইস্তাম্বুলসহ সম্পূর্ণ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও অটোমান সাম্রাজ্যকে ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। বসফরাস প্রণালির পশ্চিম তীরবর্তী ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় এর অবস্থান।

গ্রিক পুরাণে সোফিয়া হচ্ছেন জ্ঞানের দেবী। গ্রিক শব্দ আয়া সোফিয়াকে অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায় ‘হলি উইজডম’ বা পবিত্র জ্ঞান। বাইজেন্টাইন শাসক প্রথম জাস্টিনিয়ানের শাসন আমলে ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে আয়া সোফিয়ার নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় পাঁচ বছর ৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দের পর এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। সে সময় এটি ছিলও এ পৃথিবীর বৃহত্তম স্থাপনা। বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় চার্চ হিসেবে আয়া সোফিয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তবে এর পূর্বে একই স্থানে আরও দুটি চার্চ নির্মিত হয়েছিল। প্রথম চার্চটি নির্মিত হয় আনুমানিক ৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট কনস্টানটিনোসের শাসনামলে কিন্তু কিছু মতবিরোধের জের ধরে ৪০৪ খ্রিষ্টাব্দে এক দাঙ্গার জেরে চার্চটিকে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আনুমানিক ৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেনটাইন সম্রাট থিয়োডোসিস চার্চটির পুনর্নির্মাণ করেন। কিন্তু জাস্টিনিয়ানের ক্ষমতা গ্রহণের পাঁচ বছর পর এক দাঙ্গায় আবার এটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। জাস্টিনিয়ান আয়া সোফিয়াকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বৃহত্তম ক্যাথেড্রাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রায় ৯০০ বছর আয়া সোফিয়া ছিলও পূর্বাঞ্চলীয় অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটির প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এ ছাড়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজাদের অভিষেক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানের কাজেও আয়া সোফিয়া ব্যবহার করা হতো।

বাইজেনটাইন রাজাদের রাজমুকুট এখানে সংরক্ষিত ছিলও। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে একটি সংক্ষিপ্ত কাল পর্ব ছাড়া যখন চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা অভিযান চালিয়ে কনসটান্টিনোপল দখল করে নেন। তারা আয়া সোফিয়াকে ক্যাথলিক চার্চে রূপান্তর করে। ১৪৫৩ সালে অটোমান সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ কনসটান্টিনোপল জয় করেন। কনসটান্টিনোপলের নাম পরিবর্তন করে শহরটির নাম তিনি দেন ইস্তাম্বুল। চিরকালের মতো অবসান হয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের। বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ আয়া সোফিয়াতে প্রবেশ করেন এবং আয়া সোফিয়াকে তিনি সংস্কার করে মসজিদে রূপান্তর করার নির্দেশ দেন। অটোমান স্থপতিরা আয়া সোফিয়ার ভেতরের অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সব চিহ্ন সরিয়ে ফেলেন কিংবা একধরনের কালো কাপড় দ্বারা ঢেকে দেন। ভবনের বাইরের অংশে যোগ করা হয় উঁচু মিনার। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ এ ভবনের ভেতর জুমার নামাজের আয়োজন করেন। ১৯১৬ সালে ব্লু মস্ক বা সুলতান আহমেদ মসজিদ নির্মাণের আগ পর্যন্ত এটি ছিলও ইস্তাম্বুলের প্রধান মসজিদ। পরবর্তী সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে এর স্থাপত্যকলাকে অনুসরণ করে।

মারমারা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ওমর ফারুকের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখক
মারমারা ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ওমর ফারুকের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখক

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মোস্তফা কামাল আতার্তুক তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মনোনীত হন। তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন এবং তুরস্ককে একটি প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলেন। মোস্তফা কামাল ছিলেন সেক্যুলার মতাদর্শের একজন রাজনীতিবিদ। তিনি আয়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তর করেন এবং আয়া সোফিয়াতে নামাজসহ সব ধরনের ধর্মীয় আচারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৩৫ সালে একে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর বর্তমানে আয়া সোফিয়া তুরস্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থলে পরিণত হয়েছে। আয়া সোফিয়ার টিকিটের প্রবেশমূল্য ৬০ লিরা। বৃষ্টিস্নাত দিন হওয়ায় কোনো রকম লাইনে দাঁড়ানো ছাড়াই সহজে আয়া সোফিয়াতে প্রবেশ করতে সক্ষম হই।

আয়া সোফিয়ায় ঢুকতে না ঢুকতে আশ্চর্য এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি ভেতর থেকে জাগ্রত হতে শুরু করে। আয়া সোফিয়া মুসলিম ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম ক্যালিওগ্রাফির নিদর্শন আয়া সোফিয়াতে দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ (স.)সহ তাঁর প্রিয় দৌহিত্র হাসান ও হুসেইন এবং ইসলামের প্রধান চার খলিফার নাম খোদাই করা আছে। অন্যদিকে যিশু ও মাদার ভার্জিন মেরির সবচেয়ে বড় প্রতিকৃতি রয়েছে এ আয়া সোফিয়ায়। তাই খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেও আয়া সোফিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

বহুকাল থেকেই তুরস্কের ইসলামপন্থী গোষ্ঠী ও ধর্মভীরু মুসলমানরা চাইছেন আয়া সোফিয়াকে আবারও মসজিদে রূপান্তর করা হোক। অন্যদিকে তুরস্কে যারা সংস্কারপন্থী এবং নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করেন, তাদের মতে আয়া সোফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে রাখা হোক। তুরস্কের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিলও আয়া সোফিয়াকে পুনরায় নামাজের জন্য উন্মুক্ত করা। আদৌ আয়া সোফিয়াকে পুনরায় নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে কি না, এ বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে দেশটির আদালতের ওপর নির্ভর করছে। গ্রিস কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তর করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, ‘আয়া সোফিয়ায় কোনো পরিবর্তন আনা হলে তা এখন যেভাবে দুই ভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষের বিশ্বাস ও সংস্কৃতির সেতু হিসেবে কাজ করছে, তা বিনষ্ট হবে।’

গ্রিসের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী লিনা মেনদোনি বলেছেন, তুরস্ক উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তুলতে চাইছে। তাঁর মতে আয়া সোফিয়ার মতো একটি ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানে উক্ত প্রতিষ্ঠানের আন্তসরকার কমিটির অনুমোদন ছাড়া কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। প্রত্যুত্তরে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুভ কাভুসোগলু বলেছেন, যেহেতু আয়া সোফিয়ার অবস্থান তুরস্কে তাই এ ব্যাপারে গ্রিসের কোনো কিছু বলার থাকতে পারে না। তুরস্কের টেলিভিশন টোয়েন্টিফোরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশে আমাদের সম্পদ নিয়ে আমরা কী করব, সেটা একান্তভাবে আমাদের বিষয়।’

ইস্তাম্বুল ছিলও আমার জীবনে ভ্রমণ করা সেরা জায়গাগুলোর একটা। তাই অবচেতন মনে বারবার ইচ্ছা করে ইস্তাম্বুলে ফিরে যেতে। বিশেষত ইস্তাম্বুলে প্রবাসী বাংলাদেশি কয়েকজন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাদের আন্তরিক আপ্যায়নের জন্য ইস্তাম্বুল ভ্রমণকে সাত রঙে রাঙাতে পেরেছি।

ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি
তবে ইস্তাম্বুলকে ঘিরেও আমার জীবনে একটি বড় ট্র্যাজেডি রয়েছে। কুথাইয়া ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার সময়ে ইয়াসমিন নামের একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ইয়াসমিনকে ইউনিভার্সিটি থেকে আমার মেন্টর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আমার যাবতীয় বিষয় দেখাশোনা করত। যখন কোনো সমস্যা হতো, যেমন কোনো কোর্সে যদি কোনো সমস্যা হতো কিংবা ইমিগ্রেশন–সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা হলে ইয়াসমিন সেগুলো নিষ্পত্তির জন্য মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করত।

একটি কোর্সে পড়তে ইস্তাম্বুলে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
একটি কোর্সে পড়তে ইস্তাম্বুলে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

ইয়াসমিনের থেকে টার্কিশও শিখেছিলাম। রূপ–লাবণ্যের দিক থেকে বলতে গেলে বলিউড সিনেমার কোনো প্রতিথযশা নায়িকার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ইয়াসমিনকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ইয়াসমিন ছিলও ইস্তাম্বুলের বাসিন্দা। অভাগা যেদিকে যায় সেদিকে সাগর শুকিয়ে যায়।

আমার ভাগ্য সব সময় ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকার মতো। কপালের সঙ্গে চোকার শব্দটি একেবারে লেপ্টে গিয়েছে। তাই প্রতিবার যা আশা করি, শেষ মুহূর্তে তীরে এসে তরি ডুবে যাওয়ার মতো নিদারুণ বেদনা সইতে হয়। পূর্ব গগনে উষার আলো ফুটতে না ফুটতে যেভাবে শিশির বিন্দু ভোরের আলোয় মিলিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ইয়াসমিনও মিলিয়ে গিয়েছে জীবন থেকে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের ট্র্যাজিক হিরোখ্যাত রবার্তো বাজ্জিওর মতো ইয়াসমিনও আমার জীবনে এক ট্র্যাজেডি। সে গল্প আরেক দিনের জন্য তোলা থাক। এটাও ঠিক যে ইয়াসমিন না থাকলে ইস্তাম্বুল কিংবা তুরস্কের সত্যিকার স্বাদ অধরা থেকে যেত আমার জীবনে।

কী হবে আয়া সোফিয়ার ভাগ্যে
কী হতে চলেছে আয়া সোফিয়ার ভাগ্যে, সেটা জানতে হলে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে আরও বেশ কয়েক দিন। যেহেতু আয়া সোফিয়া তুরস্ক তথা ইউরেশিয়া অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। তাই সামনের দিন আদালতের রায় যা-ই হোক না কেন, তার ওপর আগামী দিনগুলোর অনেক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

*শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া