পেঁপেকথা

‘পাখি পাকা পেঁপে খায়’, কথাটি বারবার খুবই দ্রুত বলার অভ্যাস করলে তোতলামি কতটা সারে সেটা জানি না, তবে কথাটা যে আমাদের দেশের অধিকাংশ গাছপাকা পেঁপেবিক্রেতাই নীতি হিসেবে মেনে চলেন, সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। পেঁপে গাছে পাকলে সেটা পাখি খেয়ে নেয় বলেই হয়তো এরা সবাই কাঁচা পেঁপে গাছ থেকে পেড়ে কেমিক্যাল দিয়ে পাকিয়ে বাজারে বিক্রি করে!

ঢাকায় যতবার গাছপাকা পেঁপে কিনেছি, তার শতকরা ৮০ ভাগ সময়েই ধরা খেয়েছি। এ ক্ষেত্রে পয়সার মায়ার চেয়েও কাউকে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়াটাই বোধ হয় বেশি কষ্টের ছিল!

কবি বলেছেন, ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। আমারও ইদানীং পেঁপে কেনার দিন ফিরেছে, অর্থাৎ সেই সব ঠকে যাওয়ার কম্পেসেশন এখন পাচ্ছি। আর তাই সুদূর প্রবাসে বসে ১০ হাজার কিলোমিটার দূর ব্রাজিল থেকে আসা ফার্স্ট ক্লাস পেঁপে খেতে পাচ্ছি। তা–ও আবার সস্তাতেই বলা যায়।

পেঁপের জন্মস্থান মেক্সিকো ও দক্ষিণ আমেরিকা হলেও এটা ট্রপিক্যাল, সাবট্রপিক্যাল সব অঞ্চলেই পাওয়া যায়। তবে পেঁপের উৎপত্তি সম্পর্কে ফিলিপাইনের প্রচলিত উপকথাটা খুবই চমকপ্রদ, যার সারমর্ম এই (কমবেশি কিছু হতে পারে)।

অনেক দিন আগে ফিলিপাইনের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে বানতাওয়ান (Bantawan) ও পাপায় (Papay) নামের এক দম্পতি বাস করত। বানতাওয়ান গৃহকর্তা হলেও সে ছিল অকর্মার ঢেঁকি আর কুঁড়ের বাদশা। কোনো কাজকর্মই সে করত না, শুধু খাওয়া আর ঘুম, ঘুম আর খাওয়া। অন্যদিকে পাপায় ছিল কঠোর পরিশ্রমী, যাকে মাঠের কৃষিকাজ থেকে শুরু করে ঘরের সবই করতে হতো। এভাবেই তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল। একসময় সংসারে এক শিশুরও জন্ম হয়। একদিকে পাপায় সদ্যোজাত শিশুকে ঘরে রেখে মাঠে কাজ করতে যেতে পারছে না, অন্যদিকে ঘরেও কোনো খাবার নেই। পাপায় কথাটা বানতাওয়ানকে জানিয়ে তাকে মাঠে কাজ করতে যেতে বলে। কুঁড়ের বাদশা বানতাওয়ান কথাটা শুনেও পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে!

শেষে বাধ্য হয়েই ঘরে দুগ্ধপোষ্য শিশু রেখে পাপায় মাঠে কাজ করতে যায়। সারা দিন পর সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেও পাপায় ঘরে ফিরে আসে না, তখন উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীরা খোঁজাখুঁজি শুরু করে। কোথাও পাপায়কে খুঁজে পাওয়া যায় না। খুঁজতে খুঁজতে এক প্রতিবেশী ক্লান্ত হয়ে মাঠের পাশে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য পাথরে হেলান দিয়ে বসে পড়ে ও একসময় ঘুমিয়েও পড়ে। ঘুমিয়ে সে মাঠের পাশে অদ্ভুতদর্শন এক গাছের স্বপ্ন দেখে, যে গাছ সে আগে কখনো দেখেনি। গাছটা তাকে ডেকে বলে, আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া পাপায়, যে কিনা এখন গাছ হয়ে এই মাঠের মধ্যখানে আছি। তুমি দয়া করে আমার বুকের ফলগুলো নিয়ে আমার সন্তানকে খাইয়ে তাকে বাঁচাও।

ঘুম ভেঙে সেই প্রতিবেশী মাঠের কাছে গিয়ে স্বপ্নে দেখা গাছটা খুঁজে পায়। সেটা থেকেই ফল নিয়ে এসে বাচ্চাকে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে। আর সেই গাছ থেকেই আজকের পেঁপেগাছ, যা খেয়ে অন্য মানুষও বেঁচেবর্তে থাকছে। পাপায়ের নাম থেকেই এর নাম পাপায়া, অর্থাৎ পেঁপে।

উপকথাটি কারও বিশ্বাস না হলেও ক্ষতি নেই, তবে পেঁপের স্বাদ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করা আসলে নিজেরই ক্ষতি। কথা ঠিক কিনা?