কন্যার চিঠি

মা,

চমকে উঠলে বুঝি? ভাবছ, এমন করে হঠাৎ কে ডাকছে তোমায়? আমি তোমার গর্ভে বেড়ে ওঠা ছোট্ট তুমি যে, আমায় তুমি চিনতে পারছ না আজ? কেন মা? রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো চাঁপাগাছে চাঁপা হয়ে ফুটিনি বলে? আমি খোকা নই, খুকু! সেটাই কি আমার দোষ? এক্স–ওয়াই ক্রোমোজোম যদি পেতাম বাবার কাছ থেকে, এক্স এক্স না পেয়ে? তবে ত আমি ছেলে হয়েই জন্মাতাম, তাই না মা, বলো? তা হলেও কি তোমরা ছুড়ে ফেলে দিতে আমায়? বলো না মা!

দাদির অনেক শখ ছিল, তাঁর ‘পোলার ঘরে দুই নাতি’ হবে এবং তাদের হতে হবে তাঁর পোলার মতোই ফরসা, পুতের বউয়ের মতো পাতিলের তলার কালি হলে চলবে না! মাগো, তোমার মতো কালো হয়ে জন্মেছিলাম, সেটাই কি আমার পাপ ছিল, মা বলো?

রাজমিস্ত্রি বাবার ঘরে কন্যা মানে বাড়তি বোঝা! তুমি যেদিন প্রথম আমার প্রাণের স্পন্দন টের পেলে নিজের শরীরে, সেদিন থেকে বাবাও দাদির মতোই ‘পোলা চাই পোলা চাই’ করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছিলেন তোমার! কেন মা? মেয়ে কি মানুষ না? তুমিও তো মেয়ে মা, আমার দাদিও তো কোনো বাড়ির কন্যা ছিলেন, তবে?

মা, তুমি তো তোমার না–বলা কত কথা বলতে আমার সঙ্গে, তোমার পেটের ভেতর থেকে আমি সব শুনতে পেতাম মা, জানো? মনে হতো, পৃথিবীটা সত্যি কত সুন্দর। তুমি আমার একটা নামও ঠিক করেছিলে, না, মা?

সময়ের কিছু আগে জন্মেছিলাম আমি। বাবার তোমাকে হাসপাতালে পাঠানোর মতো টাকা বা ইচ্ছা কোনোটাই ছিল না। দাদি কড়া গলায় শুনিয়েছিলেন তোমাদের, ‘আমাগে বাড়ির মেয়ে বউরা ওই ব্যাটা ছেলে ডাক্তারগে হাসপাতালে যায় না! শরম হায়া নাই?’

হায় রে শরম হায়া রে! আচ্ছা মা, আমি পেটে থাকতে দাদি যখন তোমায় কম কম খাবার দিতেন, কেন প্রতিবাদ করতে না, মা? খিদে পেত না তোমার? কেন শেষের দিকে ভারী শরীর নিয়েও তোমায় বাড়ির সব কাজ করতে হতো? শাশুড়ির কটু কথা কেন এতই ভয় পেতে তুমি?

‘কম খালি বাচ্চা ছোট হবি! ছোট বাচ্চা সহজে প্রসব হয়।’ দাদির এই যুক্তির কাছে হার মেনে দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে থেকেছ তুমি...। কেন বলতে পারনি তোমার কষ্টের কথা? কেন পারনি?

আমার জন্মের সময় যখন তোমার জটিলতা দেখা দিল, বাবার সঙ্গে করে আনা দাই মা তখন কিচ্ছু বুঝতে পারছিলেন না। জবাই করে মাটিতে ফেলা মুরগির মতো ছট ফট করছিলে তুমি। কারও মায়া হয়নি তোমার জন্য তখন, কারও না!

তখন তোমার প্রয়োজন ছিল সিজার অপারেশনের। কিন্তু ওই যে শরম হায়া! দাদি যেতে দিলেন না তোমায় হাসপাতালে।

জন্মের পর মাত্র ঘণ্টাতিনেক তোমার বুকে ঠাঁই পেয়েছিলাম। তবে এমনি পোড়া কপাল আমার, এক ফোঁটা দুধও জুটল না। তবু কিছুক্ষণ তোমার বুকে ঘুমানো, আহারে কি শান্তি!

তবে আমার অপর দয়া করেই আজরাইল হয়তো আল্লাহর কাছে উড়িয়ে নিয়ে এসেছেন আমায়। তোমাকে আনতে গিয়ে ও আনেনি, কেন জানো মা? আমার একটা বড় ভাই আছে যে! দাদির বংশের বাতি! তার জন্য তোমায় বাঁচতে হবে, মা।

আমার কথা ভেব না মা, জীবনের এ পারে, আমি বেশ আছি। তবে আমি তোমার অপেক্ষায় আছি তো মা!

ইতি,

তোমার কন্যা।