প্রবাসীর রথের মেলার স্মৃতি

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

রথযাত্রার দিন কুষ্টিয়া শহরে সবচেয়ে বড় মেলা বসে। সেখানে গৃহস্থালি সবকিছু অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি, যেমন বাতাসা, চিনির ছাঁচ, কদমা, খাগড়াই, খই আরও কত কি? এ ছাড়া অনেক রকমের খেলনার সম্ভার বসে তবে আমাদের সবচেয়ে পছন্দের খেলনা ছিল একটা পোড়া মাটির বাটির ওপরে একটা কাগজ আটকে তার ওপরে দুটি কাঠি ঢাকের কাঠির মতো এসে পড়ত সেটা। তার মাথায় পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত। সেটা ধরে হাঁটলে কাঠি দুটি সেই কাগজের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকের মতো শব্দ হতো। যে যত জোরে হাঁটবে বা দৌড়াবে, তার গাড়িতে তত ঘনঘন কাঠি পড়বে এবং বাজনা বেজে উঠবে। এটা নিয়েও আমাদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা কাজ করত। কার গাড়ি থেকে কত জোরে শব্দ আসছে।

আমরা ছোটরা সারাটা বছর অপেক্ষায় থাকতাম কবে রথের দিনটা আসবে, তাহলে আব্বার হাতের আঙুল ধরে মেলায় যেতে পারব আর বিভিন্ন রকমের খেলনার বায়না ধরতে পারব।

গৃহস্থালির যন্ত্রপাতির মধ্যে দা, কাস্তে, নারকেল কুরানি, রুটি বেলার পিঁড়ি আর বেলন, বিভিন্ন রকমের পাতিল, ঢাকনা—সবই পাওয়া যায়। এ ছাড়া দৈনন্দিন নিত্যব্যবহার্য পণ্য তো আছেই। ছেলেদের লুঙ্গি, মেয়েদের শাড়ি, ছোটদের পোশাক—সবই পাওয়া যায়। সোজা কথায় একটি কমপ্লিট মেলা, যেখানে জীবনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যায়। অন্য মেলাগুলো বিভিন্ন উপলক্ষে হয় এবং সেগুলোতে শুধু সেই রিলেটেড জিনিসপত্র পাওয়া যায়; কিন্তু রথের মেলাই একমাত্র মেলা, যেখানে বিনোদনের উপকরণ থেকে শুরু করে সবকিছুই পাওয়া যায়।

আমাদের প্রতিবেশী আলম চাচা রথের মেলাকে সামনে রেখে প্রায় কয়েক মাস আগে থেকে দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি বাড়তি দা, বঁটি বানিয়ে জমানো শুরু করতেন। তারপর রথের দিন সকাল সকাল গিয়ে কুষ্টিয়ার প্রধান রাস্তা নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়কের পাশে একটা জায়গা নিয়ে বসে পড়তেন। কুষ্টিয়া ছোট শহর। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সড়ক কুষ্টিয়া শহরকে দ্বিখণ্ডিত করে বড় বাজার থেকে পৌরসভায় গিয়ে শেষ হয়েছে। তার মধ্যেই রয়েছে চার রাস্তার মোড় আবার কখনো পাঁচ রাস্তার মোড়। মিলনস্থলের রাস্তার সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে এমন নামকরণ। অবশ্য এখন মোড়গুলোতে ভাস্কর্য তৈরি করাতে সবাই সেটার নামেই মোড়গুলোকে চেনে।

মজমপুর রেলগেটের কাছে ভ্যান থেকে নেমে হাঁটা শুরু করতাম আমরা। যখন একেবারে ছোট ছিলাম, তখন আব্বা কাঁধে তুলে নিতেন। একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর আব্বার আঙুলই ছিল ভরসা। আর আমার আবার কোনো কিছু দেখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যাওয়ার বাতিক ছিল। একবার এমন একটা জিনিস দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তাই এরপর থেকে আর আমাকে হাতছাড়া করতেন না। হাঁটার পাশাপাশি চলত কেনাকাটা। শুরুতেই কোনো একটা খাবার কিনে আব্বা সেই ঠোঙাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন, যেন আর ঘ্যানঘ্যান না করি। এরপর একে একে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা শুরু করতেন। আর আমাদের জন্য কোনো কিছু কেনা হলে সেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন।

মোট দুই দিন রথের মেলা বসত। একটা হলো সোজা রথের মেলা আর অন্যটা হচ্ছে উল্টোরথের মেলা। আজ আর মনে নেই এই দুই মেলার মধ্যে কত দিনের পার্থক্য থাকে। যদি কখনো মেলায় যেতে না পারতাম, তখন দাদির কাছে থেকে জানতে পারতাম মেলায় কখন কী ঘটছে। দুপুরের পরপরই রথ টানা শুরু হতো, তাই বাইরে কোনো কাপড়চোপড় শুকাতে দেওয়া থাকলে দাদি তাড়াতাড়ি সেগুলো ঘরে নিয়ে আসার তাগাদা দিতেন। কারণ, রথের দড়িতে টান পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি নামবে। জানি না এর ব্যাখ্যা কী। কিন্তু সব সময় তেমনই ঘটত। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে থেমে যেত।

সিডনিতে এসেও সেই সব স্মৃতি এখনো চির জাগরূক। এবারের রথের দিন সকালে অফিসে আসার পথে ট্রেনে উঠতেই বৃষ্টি শুরু হলো। তেমন জোরে হচ্ছিল না। এরপর ট্রেন থেকে নেমে বাসে উঠলাম। তখনো থেমে থেমে ইলশে গুঁড়ির আকারে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। তাই অফিসে ঢোকার আগেই কফিশপে ঢুকে এক কাপ কফি নিয়ে নিলাম। কফিতে চুমুক দিয়ে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টি দেখছিলাম। অস্ট্রেলিয়ার বৃষ্টি আমাদের জন্য আনন্দের না, বরং ভয়ের। কারণ, বৃষ্টি হয় ঠান্ডার তীব্রতাকে বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। ইতিমধ্যেই আমার গলা বসে গেছে। তাই মনে মনে বিরক্তই হচ্ছিলাম। সিগন্যালে দাঁড়িয়ে কোনো কাজ নেই, তাই বৃষ্টির একটা কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও করে ফেললাম এবং অফিসে এসে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দিলাম। এরপর দেখি হিন্দুধর্মালম্বী বন্ধুরা আমাকে রথের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তখন একসঙ্গে অনেক কিছুই মনে পড়ে গেল।

শেষবার কবে রথের মেলায় গিয়েছি, আজ আর মনে করতে পারি না। চাইলেই লালনের আখড়ায় সাধুসঙ্গেও যোগ দিতে পারি না আর। ইচ্ছা থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে শিলাইদহে যেতে পারি না। আমরা কুষ্টিয়ার মানুষ আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান যে এমন এমন মহাপুরুষ কুষ্টিয়াতে তাঁদের চরণধূলি দিয়েছেন, তাই কুষ্টিয়ার মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধটা খুবই প্রকট। যার যার ধর্ম পালন করার পাশাপাশি মানুষ এখানে শত শত বছর ধরে শান্তি এবং সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে। আশা করি ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে। আর আমিও হয়তো কোনো একদিন রথের মেলায় গিয়ে হাজির হব। আর আমার হাতের আঙুল ধরে থাকবে তাহিয়া অথবা রায়ান।