করোনা মহামারিতে ইয়েমেন ভ্রমণ

ইয়েমেনে লেখক। ছবি: সেলফি
ইয়েমেনে লেখক। ছবি: সেলফি

কোভিড-১৯–এ সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারির ক্রান্তিলগ্নে একটা খবর মাঝেমধ্যে হেডলাইনে আসে ‘ইয়েমেন সংকট’। যুদ্ধ, দারিদ্র্যতা, অপুষ্টি ও কলেরার কারণে আগে থেকেই বিশ্বের অন্যতম তীব্র মানবিক সংকটে রয়েছে ইয়েমেনিরা, নতুন করে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারি! অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক সহিংসতার ফলে রাজনৈতিক, সামরিক এবং মানবিক সংকটে থাকা যুদ্ধবিধস্ত এই দেশটি করোনাযুদ্ধের জন্য কতটা প্রস্তুত? এই প্রশ্ন এখন মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সব গণমাধ্যমের। মধ্যপ্রাচ্যের আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পাহাড়, মরু ও সমুদ্রঘেরা দেশটির কয়েকটি বন্দরে সাম্প্রতিক সময়ে গিয়েছিলাম জাহাজ নিয়ে। অনেকটা বিস্তৃতভাবে না হলেও আংশিকভাবে খুব কাছ থেকে দেখেছি ইয়েমেনিদের জীবন। করোনা মহামারির এই বৈশ্বিক ক্রান্তিকালে সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছু স্মৃতিচারণা।

ভৌগোলিকভাবে ইয়েমেনের পশ্চিমে লোহিত সাগর এবং দক্ষিণে এডেন উপসাগর। এটি আফ্রিকা মহাদেশ থেকে বাব-এল-মান্দেব প্রণালির মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন। ইয়েমেনের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান। লোহিত সাগরের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত পেরিম দ্বীপ এবং এডেন উপসাগরে অবস্থিত সোকোত্রা দ্বীপকে গণনায় ধরে ইয়েমেনের মোট আয়তন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৭০ বর্গকিলোমিটার। সাংবিধানিকভাবে রাজধানী শহর সানা, যেটি ইয়েমেনের উত্তর অংশে অবস্থিত।

লোহিত সাগর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রস্তাবিত ট্রানজিট করিডর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, গন্তব্য ইয়েমেনের বাণিজ্যিক রাজধানী এডেন। যেটি দক্ষিণ ইয়েমেনের প্রাণকেন্দ্র। এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর প্রাচীনকাল থেকেই ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে সমুদ্রপথের একমাত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এডেন উপসাগরের অপর পাড়ে রয়েছে সোমালিয়ান জলদস্যুদের উৎপাত। আমাদের সঙ্গে থেকে থেকে দেখা মিলছে আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ ও জাপান নেভির হেলিকপ্টার, টহল দিচ্ছে আর রেডিও বার্তা দিয়ে সতর্ক করছে আশপাশের সব জাহাজকে। আমাদের জাহাজেও রয়েছে সশস্ত্র তিনজন নিরাপত্তারক্ষী, সঙ্গে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক সব প্রস্তুতি। যথারীতি বহির্নোঙর থেকে পাইলট নিয়ে বন্দরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সুমুদ্র থেকে বন্দরের দিকে যেতে চোখে পড়ল কিছু পরিত্যক্ত যুদ্ধজাহাজ ও বাণিজ্যিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। কোনোটা অর্ধনিমজ্জিত, কোনটা তীরে ভিড়ানো। দূর থেকে বাইনোকুলারে সমুদ্রতীরে উঁচু পাহাড়বেষ্টিত এই জনপদের স্থাপত্য ও নান্দনিক নির্মাণশৈলী চোখে পড়ার মতো। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর ইয়েমেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন থাকলেও দক্ষিণ ইয়েমেন ব্রিটিশ রাজশাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯০ সালে ইয়েমেন আরব প্রজাতন্ত্র (উত্তর ইয়েমেন) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী ইয়েমেন (দক্ষিণ ইয়েমেন) দুই অংশকে একত্র করে ইয়েমেন প্রজাতন্ত্র গঠনের আগেই ব্রিটিশদের শাসন আমলেই গড়ে ওঠে এসব স্থাপনা।

পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এডেন। ছবি: লেখক
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এডেন। ছবি: লেখক

সবাই খাত পাতা চিবোচ্ছেন সারাক্ষণ

পোর্টে জাহাজ ভিড়তেই ইমিগ্রেশন, কাস্টম, পোর্ট হেলথের প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পেয়ে বেরিয়ে পড়লাম অনেক ইতিহাসের সাক্ষী, প্রাচীন, যুদ্ধবিদ্ধস্ত এই শহর দেখতে। স্থানীয় এজেন্টের গাড়ি ধরে চলে এলাম বন্দর থেকে মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রে। আসার সময় থেকে থেকে চোখে পড়ল বেশ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেনাসদস্যদের আনাগোনা। মাঝেমধ্যে হেলিকপ্টার বা বিমান নিশানা করা যাবে, এ রকম কামানবাহী সামরিক গাড়ি। প্রতি ২–৩ কিলোমিটার পরপর চেকপোস্ট। আর আমার মতো ভিনদেশি, হাতে বড় একটা ক্যামেরাওয়ালা মানুষ দেখে তাঁদের চেক করার প্রবণতা ও উৎসাহ অনেক বেড়ে গেল।

এডেন–এর কেন্দ্রীয় একটি শপিং মলে ঢুকলাম। নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া হাতে গোনা দু–চারজন মানুষের সঙ্গে দেখা হলো মাত্র। অনেকটা ভুতুড়ে পরিবেশ। বেশির ভাগ দোকানে তালা, অনেকগুলো পড়ে আছে লুটপাট হয়ে যাওয়া অবস্থায়। দেরি না করে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। পথের পাশে জমে উঠেছে পথ বাজার। এই শহরের মানুষের ভেতরে এক অদ্ভুত অভ্যাস দেখলাম। বেশির ভাগ মানুষ হাঁটতে, বসতে, কথা বলতে, চলতে এমনকি কাজ করার সময় খাত নামের সবুজ একপ্রকার পাতা চিবিয়ে চলেছেন সারাক্ষণ, অনেকটা নেশার মতো। আমাদের ড্রাইভারকেও দেখলাম চিবাতে, এটা নাকি সারা দিন তাঁকে সতেজ রাখে। খাত বেচাকেনার পথের পাশের বাজারগুলোও বেশ জমজমাট। মানুষের ভিড়ে এগিয়ে চলা কঠিন। বেশি কালক্ষেপণ না করে ফিরে এলাম গাড়িতে। গাড়িতে বসেই দেখতে হলো বাকি শহরটা। দারিদ্র্যতা আর অস্থিতিশীল জীবনের ছাপ সাধারণ মানুষের চোখে–মুখে ফুটে উঠেছে। পথঘাট, সরকারি অফিস, ব্যাংক, শপিং মলগুলো দেখলে মনে হবে কোনো হলিউডের ভয়ানক রহস্য চলচ্চিত্রের মাঝে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। থেকে থেকে সামরিক গাড়িগুলো জোরালো সাইরেন বাজিয়ে টহল দিচ্ছে।

ইয়েমেনের আরেকটি বন্দর আল মুকাল্লা। ছবি: লেখক
ইয়েমেনের আরেকটি বন্দর আল মুকাল্লা। ছবি: লেখক

কীভাবে শুরু এই যুদ্ধের

২০১১ সালে বেকারত্বতা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের সূত্র ধরে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। যার ফলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সালেহকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। তার সহকারী আল-হাদী হন নতুন প্রেসিডেন্ট। এরপর ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে হাউথি (শিয়া জঙ্গিরা ইরানের সমর্থিত বলে দাবি করে) বিরোধী আরেকটি দল রাজধানী সানা দখল করে নিয়েছিল। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিপরিষদ পদত্যাগ করে। এরপর রাষ্ট্রপতি তাঁর পদত্যাগ প্রত্যাহার করে এডেনকে ‘অর্থনৈতিক এবং অস্থায়ী রাজধানী’ হিসেবে ঘোষণা করেন, তবে সানা হাউথিদের নিয়ন্ত্রণে থেকে যায়। মার্চ ২০১৫ সালের শেষ দিকে রাষ্ট্রপতির অনুরোধের জবাবে সৌদি আরবের নেতৃত্বে এবং জর্ডান, মিসর, মরক্কো ও সুদানসহ একটি জোট হাউথিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করেছিল। যার ফলে এই গৃহযুদ্ধ। যদিও চলতি বছরের মার্চের দিকে করোনভাইরাস মহামারির কারণে সৌদি আরব একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল, তবে হাউথিরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

আনুমানিক দুই মিলিয়ন শিশু মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে আক্রান্ত, স্বাস্থ্যসেবা নেই বললেই চলে। এরই মাঝে ২০১৬ সালে কলেরা মহামারি আকার ধারণ করেছিল এখানে। নেই সুপেয় খাবার পানি। সমসাময়িক সময়ে গিয়েছিলাম ইয়েমেনের আরেকটি বন্দর আল মুকাল্লায়। যুদ্ধের ছাপ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন এই শহরগুলো। পরিত্যক্ত বাড়িগুলো বিমান হামলায় ছিদ্র ছিদ্র চালা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়ে আছে অনেক পরিত্যক্ত খাদ্যগুদাম, চিকিৎসাকেন্দ্র। দূর থেকে বাইনোকুলারে দেখা নান্দনিক স্থাপনাগুলোর বুকে এত ক্ষত লুকিয়ে আছে, কাছ থেকে না দেখলে সেটা বোঝার উপায় নেই।

গৃহযুদ্ধের সঙ্গে করোনাযুদ্ধ যুক্ত হলে ইয়েমেন সংকট যে চরম পর্যায়ে পৌঁছাবে, তা বলা বাহুল্য।


*মার্চেন্ট নেভি অফিসার, লোহিত সাগর।