ব্রেভহার্ট-উইলিয়াম ওয়ালেসের দেশে

শীতের সকালের এডিনবরা। ছবি: লেখক
শীতের সকালের এডিনবরা। ছবি: লেখক

সেই বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে হলে বসে মেল গিবসনের ‘ব্রেভহার্ট’ মুভির মাধ্যমে স্কটল্যান্ডের প্রেমে পড়া। ত্রয়োদশ শতকে উইলিয়াম ওয়ালেসের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই হার না মানা লড়াই, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে রুপালি পর্দার প্রতিটি ফ্রেমে ফুটিয়ে তোলা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য মনের মধ্যে স্কটল্যান্ডের প্রতি এক অপার আগ্রহ তৈরি করে।

জানুয়ারিতে সেমিস্টার বিরতিতে আমরা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সরকারি বৃত্তির আওতায় ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহামে পড়তে আসা কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা স্কটল্যান্ড ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা। বার্মিংহাম থেকে এডিনবরা বাসে প্রায় ১০ ঘণ্টার জার্নি। ট্রেনে সময় কম লাগে কিন্তু ইংল্যান্ডে বাসের তুলনায় ট্রেন ভাড়া অনেক বেশি। তাই আমরা বাসে করে এডিনবরার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি।

বর্তমানে স্কটল্যান্ড ইউনাইটেড কিংডমের একটি অংশ, যদিও স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট হয়েছিল কিন্ত অর্ধেকের বেশি অংশের মানুষ যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে বলে এখনো স্বাধীনতা পায়নি। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিষয়টি বড় নিয়ামক। ব্রিটেনের শক্তিশালী অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারলে স্কটল্যান্ডের অর্থনীতির বুনিয়াদ অনেক শক্তপোক্ত থাকবে এ ভাবনা থেকেই অনেক মানুষ স্বাধীনতা চায়নি! সাধে কি আর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অর্থসংক্রান্ত পুরো বিপরীতমুখী মূল্যবোধ দেখা যায়। প্রাচ্যে বলা হয়, অর্থই অনর্থের মূল, অন্যদিকে পাশ্চাত্যে বলা হয় Money is second God!

স্যার ওয়াল্টার স্কটের আবক্ষ মূর্তি। ছবি: লেখক
স্যার ওয়াল্টার স্কটের আবক্ষ মূর্তি। ছবি: লেখক

সারা রাত জার্নির পর আমরা এডিনবরা বাসস্টেশনে নামি। ইউকেতে আসার পর জার্নির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি ভালো লেগেছে সেটি হলো বাসস্টেশনে সকালে নেমে ৩০ পেনি দিয়ে প্রাতঃকাজ সেরে ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে ভ্রমণের উদ্দেশে বের হওয়া যায়। এদের বাস এবং ট্রেনস্টেশনে টয়লেট সুবিধা অতি উন্নত মানের। ওরা ফ্রিতে দেয় না বলেই মনে হয় এত উন্নত সেবা দিতে পারে। বাসস্টেশন থেকে বের হওয়ার পর তীব্র ঠান্ডা বাতাস আমাদের স্বাগত জানাল। স্কটল্যান্ড ইংল্যান্ডের উত্তর দিকে অবস্থিত হওয়ায় এখানে ইংল্যান্ডের তুলনায় শীতের প্রকোপ বেশি।

প্রথম দর্শনে এডিনবরাকে কেমন যেন একটা পৌরাণিক শহর বলে মনে হলো। রাজপথগুলো লন্ডন শহরের মতো অতটা প্রশস্ত নয়, তবে পরিপাটির ছাপ স্পষ্ট। বাসস্টেশন পেরিয়ে একটু সামনে এগোতেই পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা পুরোনো ঢঙের বাড়িঘর, শীতের সকালের স্নিগ্ধ হালকা রোদের মিষ্টি আভা এবং কেমন যেন ধোঁয়া ওঠা কুয়াশাঘেরা শীতের সকালের বিশেষ আবহ প্রথম দর্শনেই ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরা এডিনবরার প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে।

অ্যাডাম স্মিথের আবক্ষ মূর্তির সামনে লেখক। আবক্ষ মূর্তির পাদদেশে একজন গৃহহীন মানুষ।
অ্যাডাম স্মিথের আবক্ষ মূর্তির সামনে লেখক। আবক্ষ মূর্তির পাদদেশে একজন গৃহহীন মানুষ।

মূল রাস্তা পার হতেই আমরা দেখতে পেলাম স্কটল্যান্ডের প্রখ্যাত সাহিত্যিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের আবক্ষ মূর্তি। চার্চের চূড়ার মতো করে একটি স্থাপনা তার মাঝেই চুপটি করে বসে আছেন স্যার ওয়াল্টার স্কট। দেখে মনে হবে রাজপথের কোলাহলের মধ্যেই ধ্যানমগ্ন একজন সৃষ্টিশীল লেখক তাঁর পরবর্তী উপন্যাসের প্লট নিয়ে ভাবছেন কিংবা নতুন কোনো কবিতার সুর তাল লয় খুঁজে চলেছেন। স্যার ওয়াল্টার স্কট স্কটল্যান্ডের এক অন্যতম জনপ্রিয় লেখক, যার সৃষ্টিশীল ভাবনা এখনো স্কটিশদের উদ্বুদ্ধ করে। বিশেষত তাঁর ঐতিহাসিক এবং স্বদেশপ্রেমের লেখাগুলো এখনো মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। My Native Land কবিতায় কবি কী অসাধারণভাবে দেশ স্কটল্যান্ডকে চিত্রিত করেছেন
Breathes there the man, with soul so dead,
Who never to himself hath said,
This is my own, my native land!
Whose heart hath ne'er within him burn'd,
As home his footsteps he hath turn'd
From wandering on a foreign strand!
If such there breathe, go, mark him well;
For him no Minstrel raptures swell;
High though his titles, proud his name,
Boundless his wealth as wish can claim;
Despite those titles, power, and pelf,
The wretch, concentred all in self,
Living, shall forfeit fair renown,
And, doubly dying, shall go down
To the vile dust, from whence he sprung,
Unwept, unhonour'd, and unsung.

ওখান থেকে আমরা একেকজন ১৫ পাউন্ড দিয়ে ছাদখোলা বাসের টিকিট কাটলাম। এই ট্যুরিস্ট বাস ঘুরে ঘুরে শহরের প্রধান আকর্ষণগুলো দেখিয়ে থাকে। স্কটল্যান্ডকে বলা হয় দুর্গের দেশ। স্কটল্যান্ডজুড়ে তিন হাজারের বেশি ক্যাসেল আছে। স্কটল্যান্ডে আরেকটি বিষয় খুব মজার, এখানেই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাল চুলের মানুষের বসবাস। স্কটিশদের চেহারার সঙ্গে ব্রিটিশদের চেহারার মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্য। স্কটিশরা মনে হলো একটু বেশি লম্বা এবং পেটানো শরীর। সৌন্দর্যেও ওরা ব্রিটিশদের থেকে এগিয়ে মনে হলো। যা–ই হোক ছাদখোলা বাসে চড়ে তীব্র বাতাসের মধ্যে আমরা এডিনবরার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। রাস্তার দুপাশজুড়ে পুরোনো এবং নতুন বাড়ির সমাহার। পুরোনো বাড়িগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য খুব করে চোখে পড়ল সেটি হলো ঘরজুড়ে ছোট ছোট জানালার আধিক্য। এত বেশি পরিমাণ জানালা দেখে মাঝেমধ্যে বাবুই পাখির বাসার মতো লাগছিল। শীতের কারণে এদের বাড়ির জানালা বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে, ফলে বাড়িতে মানুষের দেখা মেলে না বলাই চলে। ফলে এক অদ্ভুত সুনসান নীরবতার মোড়কে ঢাকা থাকে।

নর্থ সির অপার সৌন্দর্য। ছবি: লেখক
নর্থ সির অপার সৌন্দর্য। ছবি: লেখক

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি, রাস্তার দুপাশজুড়ে মাঝেমধ্যে গাছের সারি, কখনো সাজানো পার্কের পরিপাটি অবস্থান এডিনবরার সৌন্দর্যের নান্দনিকতায় এক অন্য মাত্রা যোগ করে। তবে জানুয়ারির শীতের বিষণ্ণতায় গাছগুলো কেমন যেন ধূসর, মলিন, সজীবতার কোনো অনুরণন নেই, সবুজের আবাহন নেই। এই নিরস প্রকৃতির মধ্যে ট্যুরিস্ট বাসে থাকা আমাদের ট্যুর গাইডের হাসিমাখা মুখে খাঁটি স্কটিশ উচ্চারণে মাইক হাতে অবিরত এডিনবরার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের গুণকীর্তন পর্যটকদের মুখপল্লবে হাসি এনে দিতে বাধ্য। ট্যুরিস্ট বাসে ধারা বর্ণনাকারী গাইডের ওর দেশ, ওর শহর সম্পর্কে আবেগি ভাষায় বর্ণনার সময় ওর শরীরী ভাষা এবং চোখেমুখের অভিব্যক্তি দেখে অবাক হয়েছিলাম, ওর শরীর থেকে যেন দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি এক পরম মমতা এবং গর্ব ঠিকরে বের হচ্ছিল। এই যে ছোট ছোট কিছু আবেগ-অনুভূতি এগোলোই বোধ হয় দেশপ্রেমের এক বিস্ময়কর উপাদান।

এভাবে গাইডের সরস বর্ণনায় সিক্ত হতে হতে এডিনবরার সবচেয়ে বড় ক্যাসেলের সামনে হাজির হই। উঁচু পাহাড়কে বশে এনে দুর্গটি গড়ে তোলা। দুর্গের সামনে থেকে পুরো শহরকে চমৎকারভাবে উপলব্ধি করা যায়। চারদিকে পাহাড়ের হাতছানি, তার মধ্যে মানুষের তৈরি শহর। প্রকৃতি আর মানুষের সৃষ্টিশীলতার এ অপূর্ব মেলবন্ধন যেকোনো পর্যটককে মুগ্ধ করবে। ক্যাসেল থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার মধ্যে অর্থনীতিশাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথের আবক্ষ মূর্তি দেখতে পেলাম। অ্যাডাম স্মিথের আবক্ষ মূর্তির নিচে একজন গৃহহীন মানুষ কম্বল জড়িয়ে বসে আছেন, সামনে একটি পাত্র রাখা, দু–একজন যা সাহায্য করছে, তাই দিয়েই তাঁর পেট চলবে। এই তীব্র ঠান্ডার মধ্যে মানুষটি রাস্তার ধারে কিংবা ব্রিজের নিচে তাঁবু টাঙিয়ে রাত কাটাবেন ভাবতেই মন খারাপ হয়ে যায়। অ্যাডাম স্মিথ অর্থনীতির ধারণা দিয়ে গেছেন কিন্তু সমাজে এখনো বৈষম্য টিকে আছে এবং তাঁর আবক্ষ মূর্তির পাদদেশে একজন গৃহহীন মানুষের সকরুণ উপস্থিতি যেন চিৎকার করে বলতে চাইছিল, অর্থনীতিশাস্ত্র ভোগ, চাহিদা, জোগান, উপযোগ নিয়ে নানা রকমের তত্ত্ব নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে, তবে এখনো মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির কোনো সঠিক দিশার সন্ধান এখনো দিতে পারেনি। তাই তো এই একুশ শতকে এসে তীব্র শীতের মাঝে ঝাঁ চকচকে ইউরোপের বুকে একটা কম্বল জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে একজন মানুষ রাস্তার পাশে রাত কাটাতে বাধ্য হয়।

অ্যাডাম স্মিথের আবক্ষ মূর্তি পেরিয়ে ছাদখোলা বাসে করে আমরা স্কটিশ পার্লামেন্টের সামনে হাজির হই। পার্লামেন্টটি মূলত ছোট একটি স্থাপনা কিন্তু চমৎকার তার অবয়ব। পার্লামেন্টের সামনে থাকা চমৎকার পাহাড়ের সৌন্দর্য পার্লামেন্ট সদস্যদের মনে সজীব অনুরণন এনে দেয় কি না জানা নেই। তবে পার্লামেন্টের আশপাশে কোনো নিরাপত্তাবলয় না থাকায়, পার্লামেন্টের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে বলে মনে হয়নি। পার্লামেন্ট থেকে এগিয়ে এসে আমরা একটু উঁচু পাহাড়ে উঠি। ওখান থেকে একটু নিচেই নর্থ সির নীলাভ স্বচ্ছ স্ফটিক জল আমাদেরকে স্বাগত জানাল। সাগরের তীর ঘেঁষে পাতাঝরা গাছের সারি এক অন্য রকম অনুভূতি এনে দেয়। নর্থ সির উল্টো দিকে থাকা দূর পাহাড়ের চূড়ায় সাদা স্ফটিক বরফের আস্তরণ মন ভালো করে দিতে বাধ্য।

সেন্ট এন্ড্রুজে পৃথিবীর প্রাচীনতম গলফ কোর্স। ছবি: লেখক
সেন্ট এন্ড্রুজে পৃথিবীর প্রাচীনতম গলফ কোর্স। ছবি: লেখক

পাহাড়ের পাদদেশে থাকতেই সন্ধ্যা আসন্ন। আমরা তড়িঘড়ি করে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। ক্যাম্পাসটি একটু ছড়ানো–ছিটানো মনে হলো। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের সামনে যেতেই চার্লস ডারইউনের কথা মনে পড়ে গেল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চার্লস ডারউইন ডাক্তারি পড়তে এসেছিলেন। এরপর তো সেই বিগল জাহাজে করে সাগরে ঘুরে বেড়ান, নানান দ্বীপ থেকে পশুপাখি, উদ্ভিদের নমুনা সংগ্রহ করে দেশে ফিরে বিবর্তনবাদ তত্ত্ব নিয়ে হাজির হলেন, মানুষের শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মনে করার অহংকারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে নিতান্তই সাধারণ একটি প্রাণী হিসেবে ঘোষণা দিলেন। সঙ্গে বললেন, Survival of the fittest অর্থাৎ প্রকৃতিতে চলতে থাকা নিয়ত যুদ্ধে যোগ্যরাই টিকে থাকবে। যেটি সত্যি বলতে কি এই করোনাকালে বেশি করে উপলব্ধি হচ্ছে।

জানুয়ারিতে ইউরোপের সন্ধ্যা অতি দ্রুত ঘনিয়ে আসে, এডিনবরাও তার ব্যতিক্রম নয়। তীব্র শীতের মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে রাজপথ ধরে হেঁটে চলেছি। এবার আমাদের গন্তব্য সেই বিখ্যাত The Elefant House যেখানে বসে যে কে রাউলিং সৃষ্টি করেছিলেন হ্যারি পটারের সেই জাদুর জগৎ। ১৯৯৩ সালে পর্তুগিজ স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর জে কে রাউলিং এডিনবরায় তাঁর বোনের কাছে উঠেছিলেন। এরপর শুরু হলো তাঁর সেই রূপকথা সৃষ্টির অধ্যায়। আসলে রাউলিং এডিনবরার বিভিন্ন ক্যাফেতে বসে হ্যারি পটারের জাদুর জগৎ সৃষ্টি করতেন। তাঁর মধ্যে The Elefant House নামক ক্যাফেতে বসেই বেশি লিখতেন। জমজমাট ক্যাফেতে এক কোনায় একটি টেবিলে বসে আপন মনে লিখতে থাকতেন, ভিড় বেড়ে গেলে সেখান থেকে উঠে আবার আরেক ক্যাফেতে বসে লিখতেন। এভাবে নির্জনতাকে এড়িয়ে জনাকীর্ণ ক্যাফেতে বসে একের পর এক হ্যারি পটারের জাদুর সিরিজ লিখে গেছেন, যা এককথায় অবিশ্বাস্য। আর তাই ভ্রমণপিপাসু মানুষ এডিনবরায় গেলে The Elefant House–এ একটু ঢুঁ দিয়ে আসে।

রাজপথের নিয়ন আলোতে আমরা হেঁটে চলেছি আমাদের রাতের থাকার আস্তানায়। নর্থ সির তীর ঘেঁষে আমাদের হোটেল। উত্তাল সাগর থেকে তীব্র বাতাস এসে আমাদের উড়িয়ে নিতে চাইছে, তার মধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছটা শীতের প্রকোপ আরও বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের এডিনবরার প্রকৃতি যেন হ্যারি পটারের সেই জাদুর জগতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাইছে! হোটেলে উঠে আমাদের দ্রুত ঘুমানোর তাড়া। কারণ, আমাদের পরের দিনের গন্তব্য সেন্ট এন্ড্রুজ।

সেন্ট এন্ড্রুজকে বলা হয় স্কটল্যান্ডের অন্যতম পুরোনো শহর। এই শহরেই গলফ খেলার গোড়াপত্তন হয়েছে। সাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট্ট পরিচ্ছন্ন গোছানো এই শহরে স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় ‘সেন্ট এন্ড্রুজ’–এর দেখা মেলে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেলে গড়ে ওঠা চমৎকার পরিপাটি এক ক্যাম্পাস। প্রিন্সেস ডায়ানার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম সেন্ট এন্ড্রুজে পড়ার সময় কেট মিডিলটনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন যেটি পরে প্রণয়ে রূপ নেয়। এই শহরে একেবারে সাগরের তীর ঘেঁষে কয়েকটি ক্যাসেলের অস্তিত্ব দেখা মেলে এবং সাগর আর পাহাড়ের মধ্যে মখমলের মতো সবুজ পৃথিবীর প্রথম গলফ কোর্স আপন মহিমায় উদ্ভাসিত।

দুপুরের উদর পূর্তির জন্য হোটেল খুঁজতে খুঁজতে আমরা এক ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁর দেখা পেয়ে ভেতরে গেলাম। আমাদের দুজনের মুখে বাংলা কথা শুনে হোটেলের মালিক তাঁর চেয়ার ছেড়ে হাসিমুখে আমাদের কাছে এগিয়ে এসে আমরা কোন দেশ থেকে এসেছি সেটি জানতে চাইলেন। বাংলাদেশ থেকে এসেছি বলার পর লোকটির মুখপল্লবে যে হাসির আভা দেখেছিলাম, সেটি ভোলার নয়। একেই বোধ হয় বলে স্বজাতির প্রতি এক অমোঘ টান। মানুষটি আমাদের এত চমৎকারভাবে আপ্যায়ন করলেন, যেটি না বললেই নয়। বিকিকিনির সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ বুঝে উনি আমাদের সঙ্গে দেশের ফেলে আসা গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসলেন। উনি আমরা যা অর্ডার করেছিলাম তাঁর দ্বিগুণ খাওয়ালেন, কিন্তু সেই অতিরিক্ত খাবারের বিল নিলেন না। বিলের কথা বলতেই বললেন, স্কটল্যান্ডের এই সুপ্রাচীন শহরে কোনো বাঙালির দেখাই মেলে না। আপনাদের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হচ্ছে অনেক দিন পর আমার প্রিয় বাংলাদেশের দেখা পেলাম। এই কথার পর খাবারের বিল নিয়ে আর জোরাজুরি চলে না।

দুপুরের পরেই আমরা সেন্ট এন্ড্রুজ থেকে এডিনবরার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেন্ট এন্ড্রুজ থেকে ফেরার সময় রাস্তার দুপাশে পাহাড়ি ঘেরা মায়াবী পরিবেশ ভ্রমণটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। উঁচু পাহাড়ের সারি, সবুজ কিংবা হলুদ ঘাসের আবরণে ছোট ছোট ঘরের উপস্থিতি, মাঝেমধ্যে বেড়াঘেরা পাহাড়ি সবুজ প্রান্তরে ভেড়ার উপস্থিতি, পাহাড়ের ওপর দিয়ে ভেসে চলা মেঘের সারি স্কটল্যান্ডের এক অন্য রকম সৌন্দর্যের ধরা দেয়। আমাদের বাস ড্রাইভার ছেলেটাকেও অতিমাত্রায় দেশপ্রেমী মনে হলো। সে ড্রাইভ করার সঙ্গে সঙ্গে অবিরত স্কটল্যান্ডের শৌর্যবীর্যের বীরত্বগাথা বর্ণনা করতে থাকে। শেষের দিকে সে স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত লোকগান:
Should auld acquaintance be forgot,
And never brought to mind?
Should auld acquaintance be forgot,
And days O lang syne!
প্লে করতেই সুরটা আমাদের কাছে কেমন যেন অতি পরিচিত মনে হলো। আসলে রবিঠাকুর এই স্কটিশ লোকগানের সুরেই অনুপ্রাণিত হয়ে সৃষ্টি করেন কালজয়ী সেই বাংলা গান। যেটি আজ স্কটল্যান্ড ভ্রমণের ছয় মাস পেরিয়ে আমার ভ্রমণ সহযাত্রীদের উদ্দেশে কবিগুরুর গানের মতো করে বলতে ইচ্ছা করছে
পুরানো সেই দিনের কথা
ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা,
সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা,
প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব,
প্রাণ জুড়াবে তায়।


*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান (ওএসডি), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা। মাস্টার্সে অধ্যয়নরত, ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য। [email protected]