জর্জ ফ্লয়েড, ওশিন, আর আমার দাদি

এ বছরের ২৫ মে যখন মিনেসোটায় তারা জর্জ ফ্লয়েডকে মেরে ফেলল তার গলায় পাড়া দিয়ে আর মরার সময়ে ফ্লয়েড বলছিলেন, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, ও মা, আমার মাগো, আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।’ তখন আমি চিন্তা করছিলাম, এই দুনিয়ায় এত ঘৃণা, এত অন্যায়–নিপীড়ন–অত্যাচার কেন। হঠাৎ করেই ওশিনের কথা মনে হয়ে গেল। কীভাবে এই ছোট্ট মেয়েটা তার জীবনের একেবারে ছোট থেকে প্রচণ্ড কষ্ট করে বড় হলো, কীভাবে তার পরিবার জাপানের খুব বড়লোক আর সম্ভ্রান্ত পরিবারে পরিণত হলো, সেই কাহিনি নিয়ে জাপানের এই অসাধারণ টিভি সিরিজ আশির দশকের শেষের দিকে আর নব্বইয়ের দশকের শুরুতে বিটিভিতে দেখানো হয়েছিল।

আমার দাদি ওশিন অসম্ভব পছন্দ করত। ওশিন যেদিন দেখাত, ওই দিন তার ঈদ। ওই দিন আগের থেকে সে তার খাওয়াদাওয়া শেষ করে, জায়নামাজ সেলাইয়ের সব জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলে রেখে ফুলার রোডের বাসার বসার ঘরে কাঠের সোফা চেয়ারের সামনে পা তুলে রাখার মোড়া জায়গামতো রেখে, একদম তৈরি হয়ে বসে যেত। ওই সময়ে দাদিকে কেউ কোনোভাবেই বিরক্ত করতে পারত না। ওইটা তার ‘ওশিন টাইম’। আমরা সবাই দেখতাম ওশিন, ভীষণ মনোযোগ দিয়ে। আর দাদি? ওশিনের বিভিন্ন দুঃখের জায়গাগুলাতে কাঁদতে থাকত। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, কীভাবে জাপানের কোন যুগের একটা গরিব মেয়ের কষ্টের টিভি সিরিজের কাহিনি, তা–ও আবার জাপানি ভাষায় আর ইংরেজি সাবটাইটেল করা—কিন্তু দাদির বুঝতে কোনোই কষ্ট হতো না—ওশিনের দুঃখে আকুল হয়ে কাঁদত।

ওশিন যখন ধানের খেতের ভেতরেই তার প্রথম সন্তান জন্ম দিল, দাদির সেই রাতে কী কান্না। দাদির ১৩ জন সন্তান হয়েছিল। একজন জন্মের পর মারা যায়। আমার বাবারা ছয় ভাই, ছয় বোন। আমরা ছোটবেলায় বলতাম, পুরা ফুটবল টিম, একজন এক্সট্রা। আমার দাদির বিয়ে ঠিক হয় যখন তার ৯ বছর বয়স। ফ্রক পরা ফুটফুটে ধবধবে ফরসা একটা মেয়ে খেলছে, সেটা দেখেই নাকি দাদা তাকে পছন্দ করেন। দাদি ফরিদপুরের অনেক খানদানি জমিদার পরিবারের মেয়ে। ১৩ বছর বয়সে স্বামীর সংসারে আসতে হয়। দাদা ছিলেন স্টেশনমাস্টার, সরকারি চাকরি, বেতন বেশি না, এতগুলো সন্তানের সংসার। জমিদারের মেয়ে কী রকম সংসারের দায়িত্বে এসে পড়ল! ওশিনের গরিবি হাল আর দুঃখ আমার দাদি বুঝবে না তো বুঝবে কে?

ঢাকায় তখন নতুন নতুন টিস্যু আর টয়লেট পেপার দোকানে কিনতে পাওয়া যেত। তার জন্য আমরা আগের থেকেই টিস্যুর বাক্স জায়গামতো রেডি করে রেখে দিতাম। দাদি তার প্রিয় ওশিনের দুঃখ দেখে কেঁদেকেটে আকুল হবে আর তারপর টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছবে। এইটা সেই রকম কান্না, যা মানুষের মনকে ভালো করে দেয়। দাদি ওশিনের কষ্টে যতই কাঁদত, তার মন ততই ভালো হতো।

এটা ওশিন সিরিজের সার্থকতা। তার মতো সারা দুনিয়ার যত মানুষ সেই সিরিজ দেখে চোখের পানি ফেলেছে, তারা ওই টিভি সিরিজের অভিনয় করা দুঃখের সঙ্গে তাদের নিজেদের জীবনের ব্যক্তিগত দুঃখকে এক করে নিতে পেরেছে। তাদের চোখের পানি এই দুনিয়ার সব অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কোথাও কেউ স্লোগান দেয়নি, কোথাও কেউ মিছিল করেনি, কোথাও কেউ ভাঙচুর করেনি, কোথাও কেউ চিৎকার করেনি। কিন্তু যিনি তোমাকে–আমাকে এই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, তিনি দেখে নিয়েছেন কার অন্তর থেকে মানুষের জন্য ভালোবাসার যেই অমূল্য অশ্রুবিন্দু বরফগলা নদীর মতো বের হয়ে এসেছে। সেটাই তাদের অন্তরের ভেতরে সেই অবিচারের আগুনকে মুহূর্তের জন্য হলেও নিভিয়ে দিতে পেরেছে। তাদের এই দুনিয়ার শত হাজারো অন্যায়ের ভেতরেও মুহূর্তের জন্য হলেও বেহেশতের ভালোবাসার স্বাদ দিয়েছে। যাকে আমরা চিনি না, জানি না, হাতের কাছের কেউ নয়, এমনকি কোনো বাস্তব চরিত্রও নয়, তার দুঃখে যে প্রাণ খুলে আকুল হয়ে কাঁদতে পারে, সে কেমন মানুষ? সে বেহেশতি মানুষ। তার ঠিকানা বেহেশত। তার ধর্ম ভালোবাসা। তার ভাষা ভালোবাসা। তার জাত ভালোবাসা। তার পরিচয় ভালোবাসা। তার কি অন্য কিছু প্রয়োজন আছে? তোমরাই বলো?

সেটাই আমার দাদি। তাকে আমরা সবাই অনেক ভালোবাসি। আজকে এই মুহূর্তে সে আমাদের সবার দাদি। ওই পাড়ে সে আবার আমাদের দাদি হবে। ওই পাড়ে প্রতি সপ্তাহে সে ওশিন দেখছে আর প্রাণভরে কাঁদছে। সে আমাদের কাছ থেকে কিছুই চায় না। সে শুধু চায় আমরা যাতে ওই ভালোবাসাটাকে আমাদের বুকের ভেতরে অমূল্য সম্পদ করে রেখে দিই, যা কোটি কোটি টাকা, হিরে, দুবাইয়ের স্বর্ণের চায়ে অনেক অনেক বেশি দামি। এই দুনিয়ার কোনো অন্যায়, কোনো অবিচার, ছোট বা বড়, কোনো কিছুই পয়সা, সম্পদ, আইন আর থানা–পুলিশ দিয়ে থামানো সম্ভব নয়। শুধু ভালোবাসাই পারে এই দুনিয়ার বুকে বেহেশত তৈরি করতে।

সারা দুনিয়ার সবাই যদি বুঝত তাদের একমাত্র সত্যিকারের ভাষা কী, সত্যিকারের ধর্ম কী, সত্যিকারের জাত কী, তাহলে তারা তাদের ইবলিশি ব্যবহার ছেড়ে সত্যিকারের মানুষের মতো ব্যবহার করা শুরু করত। অন্যের গলায় পাড়া দিয়ে তারা কারোর নিশ্বাস বন্ধ করে দিত না। অন্যায়, অবিচার, মিথ্যা দিয়ে বছরের পর বছর কাউকে জোর করে শাসন করে, যা ইচ্ছা তা–ই করে‌ একটা পরিবার, একটা এলাকা, একটা শহর, একটা গ্রাম, একটা সমাজ, একটা দেশ, একটা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিত না।

কিন্তু মানুষ তাদের এত বুদ্ধি, মেধা, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও কখনোই শিখবে না কীভাবে নিজেকে সম্মান করতে হয়। কীভাবে অন্যের অধিকারের মর্যাদা দিয়ে নিজে বড় হতে হয়। এটা জানতে পড়াশোনা লাগে না। নিজের নামের শেষে টাইটেল লাগে না। সেটা ওশিন জানত আর জানত আমার দাদি। তারা দুজনেই কিন্তু তাদের সন্তানদের বড় করেছিল, অনেক অনেক বড়। তারা সবাই অনেক পড়াশোনা করেছে, অনেক বেশি পেয়েছে তাদের জীবনে, যা কোনো দিন আমার দাদিও পায়নি, ওশিনও পায়নি। ওশিন যে রকম শেষমেশ প্রতিবাদ করে তার নিজের সংসার ফেলে নীরবে চলে গিয়েছিল, আমরাও একে একে সে রকমভাবে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছি, অনেক কষ্ট বুকে চেপে, অনেক প্রতিবাদ মনে ধরে।

এত দিন, এত বছর পরে প্রতিদিনের সব খবর, পোস্টে আমরা তাই শুধু ওশিনকে দেখেই যাচ্ছি। লক্ষ কোটি ওশিন আজকে বাংলাদেশে, মিনেসোটায়, সারা দুনিয়ায় কেঁদেকেটে আকুল হচ্ছে। দিনদুপুরে, রাস্তাঘাটে। আর আমার বোকা দাদি তাদের দুঃখে কেবল কেঁদেই চলেছে। সে কি জানে যে ওই পাড়ে বসে সে এইখানে এই মুহূর্তে আমাকে কাঁদিয়ে আকুল করে দিচ্ছে? সে–ই আমার ওশিন। তার কথা মনে করে আমি যতই কাঁদি, আমার মন ততই ভালো হয়। ভালোবাসার শক্তি এমনটাই হয়। তোমরা কেউ পারবে না এই শক্তিকে মাপতে। কত গিগাওয়াট তার পাওয়ার, কত কিলোটন তার ওজন? এক মুহূর্তে সেই ভালোবাসার সমুদ্রের মাত্র একটা বিন্দু এই দুনিয়ার সব সুনামিকে থামিয়ে দিতে পারে। হ্যাঁ, আমাদের কল্পনারও বাইরে সেই ভালোবাসা।

আহা, মানুষ যদি একটু সেই ভালোবাসার স্বাদ বুঝত। ইশ্‌, তারা যদি একবারের জন্য হলেও আমার দাদির সেই ওশিনকে চিনতে পারত!

*লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, পদার্থ বিভাগ, ফ্লোরিডা এ অ্যান্ড এম ইউনির্ভাসিটি, যুক্তরাষ্ট্র