ব্যাক টু বেসিক

লন্ডনে বসে অনলাইনের পত্রিকায় দেখছিলাম, ঢাকা শহরের কয়েক লাখ মানুষ তাদের পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে গেছে কোভিডকালে। বাড়িভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই। কাজ নেই। অনেকে হা–হুতাশ করছে। বাংলাদেশের অনেকেই কাজের জন্য, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার জন্য ঢাকাতে থাকে। একটা অংশ এখন ফিরে যাচ্ছে গ্রামে।

এটার বেশ কতগুলো পজিটিভ দিক আছে। গ্রামের স্কুল খারাপ না। শহরের বাচ্চারা পড়তে গেলে এর মান উন্নত হবে। জায়গা–জমি থাকলে চাষবাস করা যায়। গ্রাম থেকে পড়ে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে মানুষ কাজ করছে। যাদের চাষের জমি নেই, লিজ নিয়ে কৃষির প্রজেক্ট করা সম্ভব। রোজগার কমলে, খরচও কমবে। ছেলেমেয়েরা খেলার মাঠ, ফরমালিনমুক্ত তাজা সবজি খেতে পারবে। সবকিছু মাইন্ড সেট। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়লে এবং প্রমিত ভাষায় খেয়েছি, গিয়েছি বলে কথা বললে, ইংলিশ নিয়মকানুন রপ্ত করলেই মানুষ স্মার্ট হয় না, মানুষ হয় না। মানুষ, আত্মীয়ের সঙ্গে শিশুদের ভালো বন্ডিং হবে। তাদের সামাজিক স্কিল বাড়বে। মানুষের প্রতি, প্রকৃতি–পরিবেশের প্রতি সহানুভূতি বাড়বে।

ঢাকা শহরে টাকা আছে, আত্মা আছে বাংলাদেশের গ্রামে। বাচ্চাদের এটা অনুভব করানোর এখনই সময়। আমার জীবন নতুন করে শুরু করার সুযোগ থাকলে আমি দেশের গ্রামে থাকতাম, অবস্থাপন্ন চাষিকে বিয়ে করতাম। শহরের স্মার্টনেসের, সাসেক্সের যে সংজ্ঞা, তার বায়বীয় বুদবুদকে মিলিয়ে দিতাম। গ্রামে ফিরে চলো। শহরের ওপর প্রচণ্ড চাপ। মধ্যবিত্তরাও তাদের সব সঞ্চয় খোয়াতে চায় না বহুদিন কাজহীন থেকে। গ্রাম তাদের আদি আশ্রয়। মধ্যপ্রাচ্যে, মালয়েশিয়ায় শ্রমনির্ভর কাজ, শিল্প–কারখানা, করপোরেটের কাজনির্ভর জীবন—এই বলয় থেকে বেরোতে হবে। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ, ছোটবেলায় পড়তাম। শ্রমিকের রেমিট্যান্স, পোশাক, গ্যাস, সিরামিক, টাইলস, চামড়াসহ কতিপয় শিল্পের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের অর্থনীতি।

এখন বিশ্বজুড়ে অর্গানিক খাদ্যের বিপুল চাহিদা। কোভিডকালে মানুষ কাপড় কেনেনি, কিন্তু খাদ্য তাদের কিনতে হয়েছে। মৌলিক চাহিদার প্রথম ও প্রধান হলো খাদ্য। মানুষ খাবেই যেকোনো পরিস্থিতিতে। এই খাদ্য আমরা দুনিয়ার জন্য উৎপাদন, রপ্তানি করতে পারি বিপুল পরিমাণে। অন্তরালে আস্তে–ধীরে যে কৃষিবিপ্লব শুরু হয়েছে দেশে, তার এক ধামাকা মাশরুম বিস্ফোরণ দরকার। বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে পঞ্চম। ড্রাই ফিশ বা শুঁটকি মেশিনে প্রসেস করে, ক্ষতিকর ডিডিটি না মিশিয়ে রপ্তানি করা যায় বিপুলভাবে। রপ্তানি হচ্ছে, তবে কম। গরু আমাদের কয়েক বছর ভারত থেকে আমদানি করতে হয় না, নিজেদের দেশের গরু দেশবাসীর চাহিদা পূরণ করছে। আপেল, মাল্টা, স্ট্রবেরি, দেশি ফল ও চাল উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকারের কিছু অসাধু মানুষ দুর্নীতি করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না বলে চাল আমদানি করে।

ইরান, কাশ্মীরের রয়েছে ভালো জাফরানের বাজার। বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যিকভাবে জাফরানের ফুলের চাষ শুরু করেছে। সরকারের সহায়তা পেলে ইরান, কাশ্মীরের সঙ্গে জাফরানের গ্লোবাল মার্কেট দখল করতে পারবে। কৃষিকে হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিতে রূপান্তর করা উচিত। এই ইন্ডাস্ট্রিতে শুধু কৃষক নয়, সাপ্লায়ার্স, সায়েন্টিস্ট, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিপুল পরিমাণ লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। রপ্তানিতে শুধু পোশাকের ওপর ভরসা করে থাকলে বিপদ। এর বিশ্ববাজার মন্দা। এর ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের ওপর পড়ার সময়ের ব্যাপার মাত্র। কৃষিতে সিন্ডিকেটগুলো নষ্টের গোড়া। ফারাক্কার অসম পানি বণ্টনের সমাধান দরকার। এর কারণে জমির ফসল নষ্ট হয় অতি বন্যা হয়ে। নতজানু সরকার দিয়ে হবে না। গণতন্ত্র এই জন্য দরকার। প্রতিবেশীর শক্তিকে নিজ ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ব্যবহার না করে দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। কৃষকের মজুরি পোশাকশ্রমিকের মজুরির সমমানের দিতে হবে। সেটা সম্ভব খাদ্যবাজার গ্লোবাল মার্কেট পাকড়াও করে। সরকারের পলিসিতে কৃষি ইন্ডাস্ট্রিতে জায়ান্ট রূপে দেখার বাসনা থাকতে হবে।

সেদিন পড়ছিলাম একটা আর্টিকেল। ছোট নেদারল্যান্ডস পুরো দুনিয়ার খাদ্য সরবরাহ করে। সেটা তাদের ছোট জমি এবং গ্রিনহাউস থেকে। পরবর্তী চার দশকে কৃষকেরা শস্য উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে আগের সব রেকর্ড ভেঙে। কারণ, ২০৫০ সালের মধ্যে দুনিয়ার ১০ বিলিয়ন জনসংখ্যার খাদ্য জোগাড় সহজ নয়। আমি সব সময় একটা কথা ভাবি এবং বলি, ব্যাক টু বেসিক। মৌলিক চাহিদা পূরণে আগে সক্রিয় হতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েদের ভালো স্বাস্থ্য, সুস্থতা অর্গানিক খাদ্যে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব ১ নম্বরে থাকা উচিত।