প্রথম প্রেমের দিনগুলো

ক্লাসে শুনে আসা প্রেম মানে তো আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তাকে বলে কাম/ কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম। আবার গানে গানে কখনো ভালোবাসা মানে আর্চিস গ্যালারি/ ভালোবাসা মানে এলো চুল মাতোয়ারা। প্রেম, ভালোবাসা, ভালো লাগা অনেক রকম পরত, অনেক রকম ভাবনা। এক অধ্যাপক বলেছিলেন, প্রেমে সবাই পড়ে কেন?/ কেউ ওঠে না? হ্যাঁ, ওঠেও। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, নিন্দে সমলোচনার ভয় সব কিছুই উঠে যায়। আর প্রথম প্রেম সে প্রেমের অভিঘাত এতটাই হয় অনেক সময় আজীবন সে প্রেমের মানদণ্ডেই বাকি সব প্রেমের হিসাব চলে।

প্রথম সবকিছুই এ জীবনে আলাদা একটা দাগ রেখে দেয়। প্রথম প্রেমও আসে ঠিক সেভাবেই। সে প্রেম পরিণতি পাক না পাক আসে ফল্গুধারার মতো। কেউ ভালোবাসে ফেলে নিঝুম দুপুরে ক্লান্ত ঘুঘুর ডাক, কেউ তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতের আকাশ, কারও প্রেম হয় পুকুরজুড়ে জলের আলপনা দেখার, কারোর বা সাইকেলে দু-হাত ছেড়ে চালানো বিকেল। মফস্বলের মাঠে গোলপোস্ট ঘেঁষে ঢুকে যাওয়া বল থেকে সন্ধ্যায় লোডশেডিং হলে হ্যারিকেনের আলোয় দেয়ালে হাতের ছায়ায় বানানো হৃদয়-প্রেম আসে নানা রকম ভাবে। কে বলেছে প্রেম শুধু মানুষই পারে?

যে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে মনে হয় এই বিরাট বিশালতার কাছে আমি ক্ষুদ্র মাত্র সেখানেই আচমকাই একলা কোন তারার দিকে তাকিয়ে দেখলে মনে হবে আমি অভিমানী। ভিড়ের মধ্যে একা। সে তারার দিকে তাকিয়ে থাকলে সেও যেন মিটিমিটি করে হাসে। আর নিয়ম করে ওই সময় এলে প্রতিদিন ঠিক দেখা দেবে। মেঘ করার জন্য দেখতে না পাওয়া তো প্রতিকূলতা। বাবার বকুনির মতো। কিছুতেই বাড়ির বাইরে বেরোনো যাবে না। আহ্নিক হয়ে বার্ষিক গতিতে সে তারা যখন দৃষ্টির বাইরে, তখন সে যেন বিরহে থাকা যক্ষপ্রিয়ার মতোই। আপেক্ষা বছর ঘোরার।

বিকেলের মাঠে রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসে তলোয়ারের মতো ক্রিকেট ব্যাটটা এক একটা শট নিত, যা মারার পর নিজেরই মনে হতো এগোলো তো টিভিতে দেখায়। পুরোনো শীতের সকালের টেস্ট ম্যাচ দেখতে দেখতে বা কিংবদন্তি ক্রিকেটারের গল্প পড়তে পড়তে অজান্তেই হাতের টানে চলে আসে প্রিয় ক্রিকেট ব্যাটটা। ম্যাচের আগে ব্যাটটাকে জড়িয়েই ফিসফিস কথা চলে।

যা ছেড়ে চলে যাবে, তার সঙ্গে মুহূর্তযাপনের তীব্রতা বেশি। ফুরিয়ে যাওয়া বয়েস, পেরিয়ে যাওয়া হিমেল রোদ্দুর, পাহাড়ের ওপর সূর্যোদয়, পা ভেজানো সমুদ্রের জল—এই জীবনে একই রকমভাবে একই সময় একটিবার আসে। ঠিক সেভাবেই প্রেমে পড়ার প্রথমবার, প্রথম চোখে চোখ পড়ে যাওয়া একবারই হয়।

সেসব দিন ছিল সাইকেলের ওপর সাইকেল। চটির ওপর চটি। পড়তে যাওয়া! টেস্টের পর শীত নামছে। মন খারাপ। কিন্তু পড়তে এসে সামনে যে মুখটার খোঁজাখুঁজি চলছিল, তাকে দেখে ফেললেই আবার হৃদযন্ত্রে হুলুস্থুলু। পাতার পর পাতা রাত জাগা লেখা, গিটার হাতে সুর তুলে অনেকবার ইমপ্রেস করার চেষ্টা কিছুই বাদ যায়নি। সে এলে ক্লাস নাইনে মনে হতো স্যারের পড়ার ঘরটা বাগান হয়ে গেছে। একবার তাকালে মনে হতো খরার পর বৃষ্টি। পরিপাটি রোদ্দুর যেন আলতো হাতে ওম দিয়ে যাচ্ছে। তারপর জীবন যায় নদীর নিয়মে। দুই ধারে অনেক কিছু ত্যাগ করতে করতে। অনেক পরে আচমকা ফেসবুকে ট্যাগ। ফসিল হয়ে যাওয়া যুগের কোনো পিকনিকের ছবি কেউ ট্যাগ করেছে। স্মৃতির গলি হাতড়ে পাহাড়ে খুঁজে ফেরা সেই প্রথম প্রেম। ঘোর সংসারি এখন।

কিছু প্রেম আছে প্রথম প্রেমের দিন থেকেই শুরু হয় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। অন্যজন দুবার মুচকি হেসেছে তো নিজেদের জন্য কোথায় ফ্লাট হবে, সকালে কে আগে উঠবে, পর্দার রং কী হবে, সেসব কিছুই ফাইনাল করে নেয়। পরে গঙ্গার ওপাড় দিয়ে প্রেম তো ভো-কাট্টা। কাঁদে আর বলে আমার প্রথম প্রেম ভুলতে পারি না আজও। এদের জীবনে প্রথম প্রেম আসে আজীবনের জন্য।

আর যা কিছু হই বা না হই/ পরের জন্মে তিতাস হব। দোল মঞ্চে আবীর হব। শিউলিতলার দুর্বো হবো, শরৎকালের আকাশ দেখার, অনন্তনীল সকাল হবো,/ এসব কিছুই হই বা না হই। তোমার প্রথম পুরুষ হবো-মনে থাকবে?

পরজন্ম আদৌ সেসব কিছুই হয় কি না কে জানে কিন্তু এ জন্মের প্রথম প্রেম আসে মেঘ সব পেয়েছিস দেশ হয়েই। যেখানে এ জন্মের সবকিছু মিটিয়ে ফেলার আশ থাকে।

প্রথম প্রেমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে স্মৃতি। প্রথম প্রেমের আঁজলা ভরা সকাল আসে ভীষণ একা কোনো রাতঘুমেতে। প্রথম প্রেম আসে খুব মায়াবী ছোঁয়ায় ঘুমভাঙানিয়া হয়ে।

তারাগুলো ছাদের ওপর টিপটাপ খসে পড়ে/ বাতাস ধাক্কা মারে পাঁজর বরাবর/ আকাশ-কার্নিশ থেকে রোজ শরীরে ঝরে/ মাঝরাত্তিরে যেই কেঁপে ওঠে বুকের ভিতর। তখনই আমি উঠি কালের কফিন থেকে বারবার। একলা হাতে হতে আবার নতুন করে শুরু। প্রথম প্রেম না হয় ব্যর্থ। কার ভুল, কার ঠিক সে সবের বাইরে গিয়ে এক একজন বলতে পারে—ব্যর্থ ছিল প্রথমটা/ দোপাট্টা হোক দ্বিতীয়/ পরিস্থিতি যা ইচ্ছা, আমার তুমি জিতিও। প্রথম প্রেমে অভিঘাত যেমন তীব্র একইভাবে হীরক চূর্ণের মতো একে একে শিখিয়ে দিয়ে যায় নিজের ঠিক ভুল আর নিজের ভাবনার জায়গাগুলোকে। অচিরেই প্রথম প্রেম হয়ে যায় সব খুঁজে পাওয়ার দিক।

একলা বিকেলে কর্মব্যস্ত কোনো শহরে যেভাবে কাজ সেরে ফেরার পথে প্রবাসী কেউ তার প্রথম প্রেমের কথা মনে করবে হাজার রাগ-ঘৃণাসংবলিত হয়েও তার মুখের কোনায় হালকা হাসি আসবেই। এটাই প্রথম প্রেমের প্রাপ্তি। সেই ফেলে আসা কোনকালের দুপুরগুলোর আলপনা ছড়িয়ে রঙিন করতে করতে কারা যেন ভরিয়ে দেবে আলোর পর আলো দিয়ে ফেলে আসা জীবনের অনেকগুলো খোপকে। সামনের সময়ের ডাক। তবু যদি মাঝেমধ্যে স্মৃতির ঘরে হানা দিয়ে ঘেঁটে দেখতে ইচ্ছা করে পুরোনো প্রেম তাহলে বরং একবার নতজানু হয়ে চাই, একবার/ সহস্র সূর্যের সামনে কক্ষপথ থেকে পৃথিবীকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, সময়ের ঘেরাটোপ পরোয়া না করে/ একবার নতজানু হতে চাই। যে প্রেম নতজানু হতে শেখায় সেইসব প্রেম সর্বদাই প্রথম প্রেম।