করোটির কথামালা

আব্বা পরপারে চলে গেছেন বেশ কিছুদিন হলো, আর কয়েক দিন পরে মাস গড়াবে। এরপর বছর, যুগ -কিন্তু আব্বা যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, এই অনুভূতি নাকি কোনো দিনও যাবে না, এটা নাকি রয়ে যাবে এই জীবনের সঙ্গে চিরতরে। সারাক্ষণ/ সব সময় এটা শিকড় গেড়ে থাকবে বাকি জীবনের সঙ্গে। কথাটা আমার এক প্রবাসী বন্ধু বলেছে বিদেশে বসে নিজের বাবাকে হারিয়েছে। শেষবারের মতো বাবাকে দেখতে যেতে পারেনি। বাবা–মা হারানোর অভিজ্ঞতা এই প্রথম। মা বেঁচে আছেন কিন্তু বাবা চলে গেলে কেমন লাগে, এটা জানা ছিল না।

জীবনের সব অনুভূতি নাকি মানুষ নিজের জিবে টেস্ট করে দেখতে চায়। তাই মানুষই নাকি একমাত্র প্রাণী, যাকে কোনো ভালো উপদেশ বুঝিয়ে/শুনিয়ে গেলানো খুব কঠিন। প্রত্যেক মানুষ নাকি তাই নিজের জীবন দিয়ে শিখবে, এটাই প্রমাণিত। আরও একজন বলে লুনা, আমি বাবাকে তেমন ফিল করি না কারণ আমি খুব ছোট ছিলাম। তোরা তো একটা পূর্ণ জীবন খালুজানকে পেয়েছিস, সেদিক থেকে তোরা ভীষণভাবেই আশীর্বাদপ্রাপ্ত। হ্যাঁ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা বাবাকে একটা পূর্ণ জীবন ধরে পেয়েছি। ৮৬ বছরে বাবা মাত্র তিন দিন কষ্ট করে চলে গেছেন। অনেকে বলেছেন। তোমাদের চার বোনের উৎসব করা উচিত। আমরাও তা–ই মনে করি। কিন্তু তবু চোখ ভিজে আসে কেন?

বিদেশে আমরা যারা আছি, হুট করে দেশে যেতে পারি না, তাঁদের কিন্তু একান্ত একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। বিশেষ করে বয়স্ক মা–বাবাদের নিয়ে ‘তাঁরা চলে যাবেন’, ‘আমরা দেখতে যেতে পারব না’।

২০১৬ সালে আমাদের চার বোনের সেজ বোন কণা একবার দেশে গিয়েছিল নিজ দায়িত্বে। চাকরি, পড়াশোনা, মেধা, সব দিক থেকে কণা আমাদের বোনেদের ভেতরে সবচেয়ে এগিয়ে। দায়িত্বও কণা সবচেয়ে বেশি নিতে পারে। সেই চার বছর আগে কণা একবার বলল, মেজ পা, আব্বা এখনো হাঁটাচলা করতে পারে। আব্বা এখনো ভালো আছে। আম্মা, ভালো আছে। আমি এখন গিয়ে আব্বা–আম্মার কাছে এক মাস থেকে আসব। একদম শেষ সময়ে যখন বাবা–মা হসপিটালে স্যালাইন/নল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করবে, তখনই কেন বিদেশ থেকে যেতে হবে? বরং আমি এখন গিয়ে কিছুদিন আব্বা–আম্মার কাছে গিয়ে থাকব। তাদের সঙ্গে সময় কাটাব। অনেক কষ্ট করে আমাকে আব্বা–আম্মা বড় করছে। আমার পেছনে তাদের অনেক বিনিয়োগ আছে। তারা সুস্থ থাকতেই আনন্দময় সময় পার করবে, এটা পাওনা তাদের তাই না? যে কথা সেই কাজ, কণা সেই সময় চলে গেছিল দেশে আব্বা–আম্মার সঙ্গে সময় কাটাতে। গত ১৬ বছর প্রবাসজীবনে আমি সবচেয়ে কম দেশে গেছি আব্বা–আম্মার সঙ্গে সবচেয়ে কম সময় পার করেছি, কিন্তু কেন? আমি কি ইচ্ছে করলে যেতে পারতাম না? অফকোর্স পারতাম, কিন্তু কেন যাইনি?

কানাডাতে গত রাত ছিল কানাডা নাইট, সারা দিন বাসাতেই ছিলাম, কোথাও যাইনি। পরের দিন অফিস, বাইরে গরম, এমন নানা অজুহাতে বাসা থেকে বের হয়নি। গত রাতে মানে রাত সাড়ে ১০টার দিকে যখন আদুরে শীতের বাতাস ছাড়ল, তখন অ্যাপার্টমেন্টের একচিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে আতশবাজির খেলা দেখছিলাম—ভীষণ রংবেরঙের আতশবাজি দিয়ে আকাশ ভরে উঠছিল বারবার। সেই আকাশ আলো করা উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গের দিকে তাকিয়ে আব্বার কথা মনে পড়ল ভীষণ। কী ভীষণ মনে পড়ল আব্বার মুখটা। বুক ভেঙে যায়, যখন দেখতে পাই কোভিড আক্রান্ত আব্বার নিথর শরীরটা ঢাকা মেডিকেলের মর্গে অসহায় হয়ে পড়ে ছিল, আমি সেই ছবিটা দেখেছিলাম, কেন দেখেছিলাম আব্বার সেই মুখটা? ছোট বোন শাহিন অনেকবার না করেছিল, মেজপা দেখো না, দেখো না, অসহায় দুই বোন তখন পাশাপাশি বসা, বাবা চলে গেছেন আরও তিন ঘণ্টা আগে, ভীষণ উদ্বিগ্নতায় আমরা কাঁদিনি একবারও।

ঢাকা থেকে ভিডিও কলে নিজেকে রুখতে পারিনি—মনে হলো আব্বাকে দেখে নেই একবার। আহ হা, আমার বাবা। বাবার মুখ, যিনি কোনো দিন কাউকে অবহেলা করেননি তিনি পড়ে আছেন অসহায়, নির্বিকার। করোনা আক্রান্ত বলে প্রাণহীন বাবার শরীরটা একা, মুখে নল লাগানো। কেউ একটা কাপড় টেনে দেয়নি বাবাকে। আমি ভাবতে পারি না এখোনো। এই দৃশ্য বয়ে বেড়াতে হবে শেষ নিশ্বাস অবধি। করোনাকাল স্থায়ী হবে যাবে আমাদের চার বোন, মায়ের জীবনে।

আমার বাবাকে দেখতে পারিনি আমরা। এমনকি আমার মা দেখতে পারেননি বাবার মুখ শেষবারের মতো। জীবন তো নিঃসঙ্গ যাত্রা বটেই। জীবনের দায় যদি কার কাছে শোধ করার ব্যাপার থাকে, সেটা হলো মা, যার জীবন থেকে একটা জীবন পাই আমরা। এরপরই আসেন বাবা।

আমাদের বাবাকে যাঁরা চেনেন, জানেন, তাঁরা তো জানেন আব্বা কোনো দিন নিজের জন্য মাত্র ১০০ টাকা খরচ করেননি, কোনো দিন না। আব্বা জানতেন না নিজের জন্য টাকা কী করে খরচ করতে হয়। নিজেকে কী করে দিতে হয় আব্বা জানতেন না সেটা, হাজারো উদাহরণ আছে। শেষ ৩০ বছর বড়পা/কনা/শাহিন আব্বাকে যা যা দিত, আব্বা সেগুলো তুলে রাখতেন পরম যত্নে। বলতেন পরে পরবেন, প্রতি ঈদে আব্বার তোলা পাঞ্জাবি বের হতো চার–পাঁচটা করে। আব্বা পরেননি সেসব রেখে দিয়েছেন পরে পরবেন বলে যে কোনো জিনিসের সর্বোচ্চ ব্যবহার জানতেন আব্বা, আমি আব্বার সেসব গুণ পেয়েছি ভীষণভাবে।

এই পরম ভালোবাসার জীবনমাত্র একটাই পাই আমরা। তাই আব্বা জীবনের বোঝা বাড়ানোর দিকে ঝুঁকে ছিলেন না, বরং বোঝা কমাতে চাইতেন। দেনা /পাওনার হিসাব জলের মতো পরিষ্কার রাখতেন। কাউকে কস্ট দেওয়া, কাউকে ঝামেলা করে বেঁচে থাকতে চাইতেন না। একজন বলছিলেন, খুব বেশি উপার্জন নেই, তাতে কী? তবু একটা দামী জাগুয়ার কিনবেন নিজের মেয়ের জন্য, মেয়েকে নাকি বলেছেনে এই জীবন আর আসবে না তোমাকে জাগুয়ার কিনে দেব। সারা রাত ভেবেছি আমি নিশ্চয় এই একটাই জীবন আমাদের জীবন যাপনের চেহারা এত বেশি বিচিত্র বলেই তো জীবনের জন্য এত মায়া আর ভালোবাসা বয়ে বেড়াই আমরা সবাই।

এই পরম পাওয়া জীবনকে ভালোবাসি বলেই না বাবা জীবনকে খুব হিসাব করে খরচ করতেন। ভীষণ বাচতে চাইতেন বলেই কাজ ভালোবাসতেন। আমার সেই বাবা চলে গেছে। কানাডা ডে–তে হাজারো আতশবাজির উজ্জ্বল আলোয় বাবার মুখ ভেসে আসে। শেল্টার সার্ভিসে কাজ করতে গিয়ে কোভিড আক্রান্ত রোগীদের দিকে আরও মনোযোগী হই। বাবা কোভিডে চলে গেছেন। কিন্তু অন্য কেউ যেন সামান্য অবহেলা নিয়ে চলে না যায়। কোভিড বাবাকে নিয়ে গেছে কিন্তু আমাদের দিয়ে গেছে এক বিস্ময়কর নির্মোহ বোধ, কোভিড কালে যদি বেঁচেও থাকি তবু কোভিড থেকে যাবে আমাদের শূন্যতাজুড়ে।