প্রহসনের চিত্রিত আঁধার
'Fifteen minutes of fame'
বিয়ের লাল টুকটুকে শাড়িতে মেয়েটিকে
সত্যি রাজকন্যার মতো লাগছে।
পারসোনা থেকে রূপসজ্জা
ভাসাবি থেকে বিয়ের শাড়ি
জড়োয়া থেকে গহনা
তারপর ফুলের তত্ত্ব
মেহেদির ম–ম গন্ধ
আর হঠাৎ করে পাওয়া একটু অতিরিক্ত
আদরে ভালোবাসায়
মেয়েটি সত্যি সত্যি ভাবলো
আমিই তো সেই রাজকন্যা,
যার জন্য রাজকুমারেরা ঘোড়ায় চড়ে আসে!
চারিদিকে আলোয় আলো
রঙের মেলা, হাসি গান
কত আনন্দ তাথৈ তাথৈ,
শুধু তাকে ঘিরে।
আর এই মহার্ঘ্য সময়ের সকল চিত্র
প্রীত রেজার হাত ধরে রয়ে যাবে স্মৃতির অ্যালবামে
দেয়ালে দেয়ালে, মেঘে মেঘে।
ক্লিক ক্লিক শাটারের মোহময় শব্দ
নতুন বরের চোখে চোখ রেখে মেয়ে
খোঁজে উত্তম,
কোমরে হাত সুচিত্রার মোহময় শরীরের বাঁক।
আর চোখে দেখে তার সাথে ছবি তোলার
অপেক্ষমাণ মানুষের উৎসুক সারি।
ঠোঁটের কোণের ঈষৎ হাসিটি
পুরু মেকআপে ঢাকা পরে থাকে।
‘দৃষ্টি আরো গভীর হবে, হাতটি তার কাঁধে রাখুন’
প্রীত রেজা বলছে মেয়েটির বরকে।
মেয়েটির হঠাৎ মনে পরে গেল
হলুদ রং খসে পড়া মধ্যবিত্ত দেয়ালে
মা–বাবার বিয়ের একমাত্র ছবিটি, একটি মাত্র স্মৃতিচিহ্ন,
মা ঘোমটা দিয়ে জড়সড় বসে আছে বাবার পাশে।
বাবা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, কেতাদুরস্ত বিদেশি কোম্পানির চাকুরে।
পাশে জড়সড় মুখ গুঁজে বসে থাকা তার ম্যাট্রিক পাস মা।
‘ভাগ্যিস যুগ পালটে গেছে!’ ভাবে মেয়ে,
‘অমন ঘাড় গুঁজে বসে থাকতে হয় না’
কি করে হবে, স্বামীর চেয়ে সেই বা কম কিসে!
শিক্ষায় কর্মে, আধুনিকতায় সমানে সমান!
ক্লিক ক্লিক
সুখময় সব স্মৃতি জমা থাকবে
ছবির অ্যালবামে, মেঘে মেঘে, দেয়ালে দেয়ালে।
বর তাকে ছবি তোলার ছলে
আর একটু কাছে টেনে নেয়।
ইউফরিয়ার গন্ধে মহুয়া মাখানো বুঝি,
চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
ক্লিক ক্লিক
সবকিছু সবকিছু জমা থাকবে।
ছবির পরতে পরতে।
বিদায়ের ঘণ্টা বাজে
আলোঝলমল রাওয়া ক্লাবের সামনে
এসে দাঁড়ায় গোলাপ আর রজনীগন্ধায় সাজানো কালো লিমুজিন।
মায়ের চোখে জল,
বাবার দুটি হাত অপরাধীর মতো বুকের কাছে ধরা।
মেয়ে ভাবে এই রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়েই কি
বাসর সাজানো হয়েছে?
ছবি কিন্তু বেশ আসবে!
মা কান্নায় ভেঙে পড়ে,
বাবা মেয়েটির হাত তার বরের হাতে দিয়ে বলে,
‘আমার মেয়েটিকে তোমার হাতে তুলে দিলাম’…
মেয়েটি ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে।
শুধু শুনতে পায় বাবার কণ্ঠ
‘তোমার হাতে তুলে দিলাম’!
‘তোমার হাতে তুলে দিলাম’!
ক্লিক ক্লিক ছবিতে জমা থাকে দায়িত্ব বদল।
‘তোমার হাতে তুলে দিলাম’!
রাতে নতুন বর
আরও একটু স্বামী হয়ে ওঠেন
তার চুল নিয়ে খেলতে খেলতে
আদুরে গলায় বলেন, ‘তুমি তোমার অফিসে
রেজিগনেশন পাঠিয়ে দাও।
হানিমুন থেকে ফিরে আর জয়েন করতে হবে না ”
মেয়েটি রজনীগন্ধা আর গোলাপের গন্ধ খোঁজে।
আজকাল ফুলেও তেমন গন্ধ নেই।
দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়
‘তোমার হাতে তুলে দিলাম’!
সে রাতে আর ঘুম হয় না
রাতে স্বামী ঘুমিয়ে পড়লে মেয়েটি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়।
একটি একটি করে গহনা খুলে রাখে।
বাবার দেয়া সীতাহার, বাজুবন্ধ, ঝুমকা, নোলক।
লাল টুকটুকে শাড়িতে কি দারুণ লাগছে তাকে
আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে মেয়েটি
এই মুহূর্তটুকু আর একটু থাকুক।
আরও একটু...
প্রহসনের দিনটির চিত্রিত আঁধার।