সুইজারল্যান্ডের আকর্ষণীয় বেতন এবং সামাজিক কড়চা

সুইস স্কি রিসোর্ট। ছবি: লেখক
সুইস স্কি রিসোর্ট। ছবি: লেখক

একজন ব্যাংকার বা একজন সুইস কূটনীতিক অথবা সুইজারল্যান্ডে কোনো প্রতিষ্ঠানের বিদেশি সিইও হলে আপনার সম্ভাবনা আছে দশমিকের আগে ছয় থেকে সাত ডিজিটের বেতন নিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আরাম–আয়েশে জীবন যাপন করার।

অবাক হওয়ার কিছু নেই, গড়ে প্রতি মাসে ৬ হাজার ৫৩৮ সুইস ফ্রাঁ বা ৬ হাজার ৭৫০ ডলার, যা কিনা টাকায় ৫ লাখ ৫০ হাজার (১ সুইস ফ্রাঁ সমান ৯০ টাকার বেশি) সমপরিমাণের বেতন সুইজারল্যান্ডে উপরোক্ত পদে মিলবে। আর তাই বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় সুইজার‌ল্যান্ড অনেক বেশি আকর্ষণীয় স্থান।

সুইজারল্যান্ডের একজন প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক ৪ হাজার ৯০০ সুইস ফ্রাঁ আয় করেন, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ৪০০, বাংলাদেশি টাকায় যথাক্রমে ৪ লাখ ৪০ হাজার এবং ২ লাখ ১৬ হাজার। একজন বিক্রয়কর্মী গড়ে ৪ হাজার ৪০০ সুইস ফ্রাঁ এবং একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রশিক্ষিত নির্মাণকর্মী গড়ে ৫ হাজার ৫০০ সুইস ফ্রাঁ আয় করেন, যা বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। অন্যান্য দেশে বসবাসকারী লোকজনের পক্ষে সুইজারল্যান্ডের বেতন বেশি মনে হতে পারে, তবে সুইস বাসিন্দাদের যে ব্যয় হয় তার দিকে যদি নজর দেওয়া হয়, সেটা অন্য রকম একটা গল্প বলবে।

সুইস ফ্রাঁ। ছবি: সংগৃহীত
সুইস ফ্রাঁ। ছবি: সংগৃহীত

এখানে অন্যান্য উন্নত অনেক দেশের মতো নয়, ট্যাক্স এবং স্বাস্থ্যবিমা সুইজারল্যান্ডের বেতন বা মজুরি থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাটা হয় না। তবে পেনশন, বেকারত্ব বিমা ও অন্যান্য বাধ্যতামূলক কর বেতন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেওয়া হয়। বাড়িভাড়া এবং অন্যান্য খরচপাতির জন্য মোট আয়ের ২০ শতাংশ এবং পরিবহন ব্যয়, যা গড়ে মোট ৮ শতাংশ যদি বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সুইস বেতন আকর্ষণীয় মনে হবে না। খাদ্য, পানীয়, সন্তানসন্ততিদের দেখাশোনা, অবসরকালীন ছুটির খরচের সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবার খরচ যোগ করলে মনে হবে সুইজারল্যান্ড একটা উচ্চ মূল্যের দ্বীপ। যাঁদের মাসিক আয় ৫ হাজার সুইস ফ্রাঁর নিচে, সেই পরিবারগুলো সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে কোনো অর্থ সঞ্চয় করতে পারে না। ৮ লাখ ৬৫ হাজার জনসংখ্যার এই আলপাইন দেশে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার নিম্ন বেতনের শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হয়।

সুইস পাহাড়ের বুকে স্বচ্ছ লেক। ছবি: লেখক
সুইস পাহাড়ের বুকে স্বচ্ছ লেক। ছবি: লেখক

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়তে থাকায় এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বের সঙ্গে এখানেও স্থবিরতা চলছে, যা নিম্ন বেতনের শ্রমিকদের জন্য মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রায়ই নারী, অভিবাসী বা বিদেশি বাসিন্দাদের স্বল্প বেতনের চাকরিতে দেখা যায়। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সব স্বল্প বেতনের চাকরির অর্ধেক বিদেশি বাসিন্দারা করেন। ৫০ জন বা তারও কম কর্মচারী–সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা বেশি। স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম এবং বাড়িভাড়া বাড়ছে, যখন মজুরি কেবল মাঝারিভাবে বাড়ছে। সুইস নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য সময় কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। সুইজারল্যান্ডের মতো ধনী দেশে, স্বল্প আয়ের লোকেরা প্রায়ই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয় করতে বাধ্য হয় বিভিন্ন কারণে।

একটি সুইস গ্রাম। ছবি: লেখক
একটি সুইস গ্রাম। ছবি: লেখক

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক বৈষম্য, গবেষণা, মিডিয়া, রাজনীতি মানুষের প্রতিদিনের কথোপকথনের জনপ্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে সুইজারল্যান্ডকে তার উচ্চ স্তরের সম্পদ বণ্টনের জন্য প্রশংসা করেছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়া দেশগুলোর চেয়ে সুইজারল্যান্ড কম সমাজতান্ত্রিক, তবে বেশ সফল বলে নিউইয়র্ক টাইমসের দাবি। তবে মানতেই হবে, সুইজারল্যান্ডের আয়করসহ অন্যান্য করব্যবস্থা, রাষ্ট্রের কল্যাণব্যবস্থার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং সামাজিক সাম্যকে প্রভাবিত করে এক অভাবনীয় সাম্য অবস্থা বজায় রেখেছে।