পাড়ার মাস্তান থেকে ক্লাইভ হয়ে ওঠার গল্প

রবার্ট ক্লাইভ। ছবি: সংগৃহীত
রবার্ট ক্লাইভ। ছবি: সংগৃহীত

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে চাকরি নিয়ে যাঁরা বিলেত থেকে ভারত এসেছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বিলেতের নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। বিলেতে ভালো কোনো কাজ জোটাতে না পেরে বা সে যোগ্যতা তাঁদের ছিল না বলেই এই শ্রেণির চোখ থাকত ভারতের সম্পদের দিকে। কীভাবে ভারতে গিয়ে দুটো টাকার মুখ দেখা যায় এবং রাতারাতি পয়সাকড়ির মালিক হওয়া যায়—এই ছিল তাঁদের আজন্মলালিত স্বপ্ন।

পলাশীর ষড়যন্ত্রের নায়ক রবার্ট ক্লাইভের কথাই ধরা যাক। তিনি ১৭৪৩ সালে ভারত এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানির চাকরি বাগিয়ে। পরবর্তী সময়ে ১৪ বছরের ব্যবধানে ১৭৫৭ সালে তিনি বাংলার নবাব সিরাজউদদৌলাকে হারিয়ে ভারতের প্রভু বনে গিয়েছিলেন। অথচ রবার্ট ক্লাইভের পেছনের জীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পড়াশোনা ছিল না। পাড়ার মাস্তান হিসেবে তাঁর বেশ নাম-ডাক ছিল। ক্লাইভের বাবার মেজাজ অনেক গরম ছিল, যা উত্তরাধিকার সূত্রে ক্লাইভও পেয়ে যান। কিশোর বয়স থেকেই ক্লাইভ মারামারি পছন্দ করতেন।

পাড়ার ছেলেদের নিয়ে গ্যাং বানিয়ে মানুষকে উত্ত্যক্ত, দোকানপাট ভাঙচুর করতেন ক্লাইভ। কম বয়সে ক্লাইভ অনেক নির্ভীক প্রকৃতির ছিলেন। তিনি প্রায়ই চার্চের উঁচু টাওয়ারে উঠে লোকজনকে ভয় দেখাতেন। ক্লাইভের খারাপ ব্যবহারের জন্য তাঁকে স্কুল থেকে কয়েকবার বের করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্কুলের তাড়া খেয়ে কোনো রকম স্কুল শিক্ষাতেই শিক্ষিত ছিলেন ক্লাইভ। এই ‘অপদার্থ’ ছেলের একটা গতি করতেই বাবা রিচার্ড ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ছেলের জন্য একটা চাকরি জোগাড় করতে সমর্থ হন। সেই অপদার্থ কিন্তু চতুর ছেলেটি মাত্র ১৯ বছর বয়সে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ভারতে পা রাখেন।

প্রথম দুই বছর বিক্রয় সহকারী হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি কোম্পানির বিভিন্ন সরবরাহকারীদের সঙ্গে দরদাম করা, হিসাব রাখা, পণ্যের মান পরীক্ষা করা ইত্যাদি কাজ করতেন। সেই সময়ে তিনি একটু একটু বই পড়া আর লেখালখিতে মনোযোগ দেন। ১৭৪৬ সালে মাদ্রাজে প্রথম কার্ণাটিক যুদ্ধে ফরাসিরা ইংরেজদের পরাজিত করে এবং সব বন্দীকে শপথ করায় যে তারা আর কখনো ফরাসিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে পারবে না। সেই বন্দীদের মধ্যে ক্লাইভসহ আরও কয়েকজন এর বিরোধিতা করেন এবং ফরাসি বাহিনীর বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে প্রায় ৫০ মাইল দক্ষিণে ইংরেজ দুর্গ সেন্ট ডেভিসে চলে আসেন। ক্লাইভের এই বীরত্ব মেজর স্ট্রিঙ্গার লরেন্সের নজরে আসে এবং ক্লাইভকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দিয়ে কমিশন দেওয়া হয়। সেই থেকে ক্লাইভের শুরু।

অসংখ্য যুদ্ধ জয়, কূটনৈতিক চাল এবং লিডারশিপ ক্লাইভকে কামান্ডার ইন চিফ অব ইন্ডিয়া বানিয়ে দেয়। মেজর জেনারেল ক্লাইভ বাংলা জয় করে বনে যান ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া। ক্লাইভ ব্রিটিশ সামরিক ইতিহাসের এক বিতর্কিত ব্যক্তি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে লাভবান করা, রানির ভান্ডার সম্পদে ভরে দেওয়াসহ ভারতে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের সূচনাকারী হিসেবে ক্লাইভ ইতিহাসের পাতা দখল করে আছেন। ক্লাইভ ভারত থেকে তিন লাখ পাউন্ডের সম্পত্তির মালিক হয়ে মাঝখানে বিলাতে ফিরে আসেন। বিলাতে এসে রাজনীতি শুরু করেন এবং ১৭৬১ সালে মেম্বার অব পার্লামেন্ট নির্বাচিত হন। ১৭৬২-৬৩ সালে শ্রিউসবারি এলাকার মেয়রও ছিলেন। ক্লাইভের পড়াশোনার ঝুলিতে কোনো ডিগ্রি না থাকলেও ১৯৬০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টর অব সিভিল ল–এর ডিগ্রি প্রদান করে।

পলাশীর যুদ্ধ শেষে রবার্ট ক্লাইভের সাথে মীর জাফর। ছবি: সংগৃহীত
পলাশীর যুদ্ধ শেষে রবার্ট ক্লাইভের সাথে মীর জাফর। ছবি: সংগৃহীত

তৃতীয়বার ভারত সফরের পর ১৭৬৭ সালে পুরোপুরি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ১৭৬৯ থেকে ১৭৭৩ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক–তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়, যার পেছনে ক্লাইভের অসামঞ্জস্য বাণিজ্য আর কর আরোপের প্রভাব ছিল। এ জন্য ক্লাইভকে দায়ী করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনাও হয়েছিল।

মাত্র ৪৯ বয়সেই ক্লাইভ মারা যান। ক্লাইভের মৃত্যুতে কোনো তদন্ত হয়নি এবং ধারণা করা হয়, তিনি নিজের গলা কেটে আত্মহত্যা করেন, আবার কেউ কেউ বলেন অতিরিক্ত আফিম সেবনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। লেখক জন ওয়াটনি তাঁর ‘ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছিলেন যে ‘ক্লাইভ অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।’

রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি, যা সরিয়ে ফেলার জন্য আন্দোলন চলছে। ছবি: সংগৃহীত
রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি, যা সরিয়ে ফেলার জন্য আন্দোলন চলছে। ছবি: সংগৃহীত

আরেক ইংলিশ লেখক উইলিয়াম ডেলরিম্পল ‘দ্য এনার্কি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘ক্লাইভের নিজ কৃতকর্ম এবং তার বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে যে সম্পদ আর খ্যাতি আহরণ করেছিলেন, সেই অপরাধবোধ তাঁকে ভেতরে ভেতরে তাড়া করে বেড়ায়, যার দরুন তিনি গলা কেটে নিজেকে শেষ করে দেন।’ তিনি আরও লেখেন, ‘ক্লাইভ এমনই বর্ণবাদী আর সমাজপতি ছিলেন, যাঁকে ভারত ও ইংল্যান্ড উভয় জায়গার মানুষ ঘৃণা করত। ক্লাইভ মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ হত্যার মূল হোতা ছিলেন। তাই তো আঠারো শ শতাব্দীতে কেউই ইংল্যান্ডে রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি বানানোর কথা চিন্তা করেনি বা স্বপ্নেও ভাবেনি। উনিশ দশকের গোড়ার দিকে এসে ক্লাইভের মূর্তি তৈরি হয় তাঁর জন্মস্থান শ্রিউসবারি শহরে।’

আজ আড়াই শ বছর পরেও ইতিহাসের কাঠগড়ায় রবার্ট ক্লাইভ। আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর বিশ্বব্যাপী যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার দাবানলে ক্লাইভকেও পুড়তে হচ্ছে। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণবাদী, আদম ব্যবসায়ী, অত্যাচারী, নির্যাতক ও নিপীড়নকারীদের শত শত বছর পুরোনো মূর্তি ভাঙার হিড়িক পড়েছে। মানুষ রাস্তায় নেমে কিছু মুর্তি নিজেরা ভেঙে দিয়েছে এবং বাকি মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলতে অথবা সরিয়ে ফেলার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে ক্লাইভের মূর্তিও আছে।