টেলিমেডিসিন ও কিছু প্রশ্ন

এই বছরের শুরু থেকে কিছু টেলিমেডিসিন করি করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবার পার্ট হিসেবে। সবাই অনেক ভালোভাবে নিয়েছেন এ উদ্যোগ। কিছু মজার ঘটনা তবু শেয়ার করতে ইচ্ছা করছে। একা একা আর কত হাসাহাসি করা যায়।

তো একদিন একটি ছেলে কথা বলতে চাইল। মনে হলো খুব আর্জেন্ট কিছু। দিলাম সময় কাজের পরে। সে যেন তার জীবনের গল্প শোনাতেই আগ্রহী। জেনে গেলাম ছোট্ট থেকেই ডিভোর্সি বাবা-মায়ের নতুন সংসার গোছানোর গল্প। তার বোর্ডিং স্কুলে একা একা বেড়ে ওঠার কাহিনি। চমৎকার গিটার বাজিয়ে গান গাওয়ার ক্ষমতা। আমি সাইকোলজিস্ট না বলে এ পর্যায়ে ইতি টানতে হলো কথোপকথনের। দোয়া এবং শুভকামনা করে আপাতত অপেক্ষায় থাকলাম তার ভবিষ্যৎ ঝলমলে জীবনের। কোনো মেডিসিনবিষয়ক উপদেশ সে চায়নি। শুধু শুধু কথা বলছি না দেখে সে মহা বিরক্ত।

একজনকে করোনাবিষয়ক কিছু উপদেশ দিলাম। তারপর আরও কিছু প্রয়োজনীয় উপদেশ। এরপর বিশাল বিশাল মেইল। বিষয় পয়সা ছাড়া উপদেশ দিলে মানুষ শোনে না জাতীয়। বোঝালাম এটা স্বেচ্ছাসেবা। জীবিকার জন্য কাজ করছি এবং আলহামদুলিল্লাহ বেতন পাচ্ছি এ দেশে। সুতরাং বিনা পয়সায় দেশের কেউ উপদেশ না শুনলে আমার কী ক্ষতি হবে? যদি একজনেরও কিছু উপকার হয়, যদি একজনও শোনে। অতঃপর ১৫ কোটি মেসেজ আপাতত বুড়ো বয়সে পড়ার জন্য সংগ্রহে রেখে দিয়েছি।

নাইট ডিউটি করে এসে দিলাম ঘুম এক সকালে। উঠে দেখি মেসেজ, ‘অতি সত্বর উত্তর দিন সমস্যাগুলোর অথবা ফোন নম্বর দিন।’ দিলাম উত্তর। একদিন দেরি হওয়াতে ডিসলাইক পেলাম উত্তরে। ফোন নম্বর না দিলে টেলিমেডিসিন করে লাভ কী জাতীয় উত্তর পেলাম। বললাম, আসলে হাসপাতালে কাজ করি তো। কোভিড রোগীর রুমে ঢোকা এবং বের হওয়ার জন্য প্রচুর সময় যায়। তাই ওই সময়ে নার্সদের কলও নিতে পারি না। অতঃপর বললেন ফেসবুকে এড করতে। বললাম, ফেসবুকে তো রিলাক্সিং সব ছবি থাকে, দেখে বিরক্ত হবেন না। টেক্সটের উত্তর না দিয়ে ছবি আপলোড করছি কেন? অতঃপর আরও এতটা ডিসলাইক, সঙ্গে দুঃখী ইমোজি পেয়ে মাথাব্যথার ওষুধ খেয়ে চা হাতে উদাস নয়নে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

কিছু উপদেশ পেলাম একজনের কাছ থেকে দেশের এ মহাবিপদে দেশে গিয়ে সেবা করার। বললাম, আমি তো এ দেশে কাজ করি জীবিকার প্রয়োজনে। পৈতৃক জান বিপন্ন করে যদি কোনো প্লেনে দেশে যাইও, দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থেকে এ দেশে এসে আবার দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থেকে কী সেবা করতে পারব? আর যদি মরেই যাই, আমার বাচ্চাগুলোর কী হবে? অতঃপর বিশাল বিশাল মেইল পেলাম আমার নিজের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা বিষয়ে। একটা টাইলেনল উইথ ক্যাফিন চেয়ে এবং উনি দেশসেবার জন্য কী কী করছেন লিস্ট চেয়েছিলাম দেখে আপাতত তিনি বন্ধ করেছেন উপদেশ–সংবলিত মেইল।

লেখক। ছবি: সংগৃহীত
লেখক। ছবি: সংগৃহীত

জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের ঘৃণ্য কাজকর্ম দেখে থ হয়ে গেছি আমি। মহামারিতে যেখানে দুনিয়ার সবাই আতঙ্কিত আগামীকালের ভোর দেখবে কি না, সেখানে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে টাকা নেওয়া বা বাইরের দেশে নিজের দেশের লোককে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে হয়রানি করার মতো ধৃষ্টতা মানুষের কীভাবে হয়, আমি বুঝতে পারি না। এর মধ্যে ডা. সাদিয়ার ২০টি ছবি পেলাম ইনবক্সে, সঙ্গে প্রশ্ন কী নীচ এ ডাক্তার। ‘আপনারই তো পেশার। আপনার মন্তব্য কী?’ বললাম, উনি যা করেছেন সেটা এ পেশার পুরোপুরি উল্টো এবং ক্রিমিনাল লেভেলের কাজ। আমাদের পেশায় সরাসরি রুগী দেখার আগেই শেখানো হয়, ভালো কিছু করতে না পারলে হার্ম করতে পারব না। তারপরও আমি কেন কিছু করছি না জাতীয় মেইল পড়ে হাসলাম। বললাম, এত গর্হিত অপরাধের ভার উপরওয়ালাকে দিয়েছি, দেশের আইন আদালতের ওপর আস্থা রেখেছি। সবাই যে যাঁর জায়গায় থেকে প্রতিবাদ করুন।

একজন ডিপ্রেশনে ভুগছেন বলে কিছু প্রশ্ন করলেন। মেডিসিনের ডাক্তার হিসেবে যতটুকু উপদেশ সম্ভব দিলাম আর প্রথিতযশা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে উপদেশ নিতে বললাম। উনি বললেন, পরকীয়ায় জড়িয়েছেন বিষণ্নতা থেকে। বলে দিলাম, বিষণ্নতা একটা রোগ, পরকীয়ার মতো এত জঘন্য অপরাধকে এর সঙ্গে জড়াবেন না। সবাইকে সব অপরাধের হিসাব দিতে হবে মরার আগে–পরে। বলে দিলেন, ‘সায়েন্সের লোক, অবৈজ্ঞানিক কথা কেন বলেন?’ ভাই, এ ধরনের বিজ্ঞান এ ক্ষুদ্র জীবনে আর না শিখি। অসুখ আর অপরাধের পার্থক্য বিজ্ঞান আমাকে শিখিয়েছে।

মেটে আলু নামে একজন মহাবিরক্ত করছেন ইদানীং। ক্রমাগত হাই–হ্যালো এবং বন্ধুত্বের আমন্ত্রণ। বললাম, এ বয়সে নতুন করে বন্ধু বানানোর কোনো ইচ্ছা আমার নেই। হাই–হ্যালো কম বুঝি। ডাক্তারিবিষয়ক প্রশ্ন থাকলে করুন। পরপর প্রশ্ন এল, ডাক্তার হয়ে লেখালেখি করি কেন, গান গাই কেন, নতুন বন্ধু বানাতে অনাগ্রহ মানে এত অমিশুক কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। টেলিমেডিসিনে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর শেখায়নি। কমন পড়েনি দেখে বলে দিলাম, দেশ–বিদেশে সব পেশার লোকের অনেক কিছু করার আছে পাশের মানুষটার জন্য। আপাতত মহামারি সবাই মিলে পুরো দুনিয়ায় সামলে উঠি, তারপর দেখব কী করা যায়।