মা পাগলের মতো বড় ভাইকে খুঁজছিলেন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় যুদ্ধ শেষে আমরা বাড়ি ফিরি। ঘরের পোড়া টিন দিয়ে তৈরি করা ছাপরা ঘরে সন্ধ্যা নামতেই সবাই হারিকেন জ্বালিয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দিতাম। বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু (এলাকায় তাঁকে ফেরু মাতবর বলে সবাই জানতেন) বাবার কাছে এলেন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে। এসে একই ঘরে আমাদের মাথার কাছে হারিকেনের আলো কমিয়ে আলো-আঁধার পরিবেশ করে কথা বলছিলেন। বাবার বন্ধুকে আমরা জ্যাঠা ডাকতাম।

যুদ্ধের সময় এই জ্যাঠার পরিবার আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। পরে আমাদের সঙ্গেই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আবার আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই এক বাড়িতে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন। যতটা জেনেছি সেই জ্যাঠা আর বাবা এক চাদরে ছিলেন। যেকোনো কাজে তাঁদের একসঙ্গে যেতে বা কোনো বড় সমস্যায় দুজন আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দিতেন, এ জন্য এলাকার মানুষ তাঁদের একচাদরে ডাকতেন।

রাত একটু গভীর হলে একদল যুবক বাড়িতে এসে ঘরের বেড়া ধাক্কাছিল। ভেতর থেকে বিজয়ের আনন্দ হয়ে যাওয়ার মতো করে মা ভয় কাতুরের মতো করে প্রশ্ন করল—কে? বাইরে থেকে যেভাবে একাধিক ভারী গলায় উত্তর দিয়েছিল—আমরা দরজা খুলুন। এমন অসময়ে ভারী গলায় ঘরের বাইরে একাধিক লোকের কণ্ঠ শুনে বাবা সাহস দেখিয়ে উঠে দাঁড়ালে, ফেরু জ্যাঠা দরজা খুলতে বারণ করছিলেন। তখন মা উঠে গিয়ে টানা দরজা খুলে বাইরের দিকে ঠেলে দিলে হুড়মুড়িয়ে ছয়–সাতজন লোক চাদর গায়ে মুখ ঢেকে ভেতরে ঢুকে পড়ল। এ দেখে ঘরের সবাই ভয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম সে সময়। সবার কাছে অস্ত্র। বোনেরা তখন মুখ লুকায় ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে।

কেউ কোনো টু শব্দ করতে সাহস করেনি তখন। একসময় ফেরু জ্যাঠারই এক ছেলে চিৎকার করে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাদের প্রথম কাউকেই আলাদা করে চেনার উপায় ছিল না। বাবা এবং ফেরু জ্যাঠা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। এরপর তাদের সবাই একে একে নিজেদের পরিচয় দিলে মা জ্যাঠাকে দেখিয়ে বলেছিল, এখানে তো তোমার বাবা রয়েছে। ওই তো তোমার বাবা। বললেও তারা সবাই মাকে জড়িয়ে ধরেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল।

মা শান্ত না হয়ে জানতে চেয়েছিল, বড় ভাই কোথায়? হারিকেন নিয়ে বাবা সবার মুখের কাছে ধরে নিজের ছেলের মুখ দেখার চেষ্টা করলেন। তারা তখন কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, আপনারা দেখেন তো দাদাকে চিনতে পারেন কি না? মায়ের মন, কোনোভাবে শান্ত হচ্ছিল না। আমি বালিশের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে চুপি চুপি দেখছিলাম। বাবা আর জ্যাঠাকে যখন আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতে দেখি, তখন আমার ভয় কাটে। বিছানার সবাই উঠে দাঁড়ালে আমি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াই বিছানা থেকে।

আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে সবাই উঠে তাদের ঘিরে দাঁড়াই। সেদিন সন্ধ্যা রাতে আমাদের ঘরপোড়া ভিটায় ছাপরা ঘরের ভেতর আনন্দ প্রকাশের এক ভিন্ন দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছিল। সবাই কাঁদছে। পরে অবশ্য মাকে সবাই শান্ত করে বুঝিয়ে বলেছিল, বড় ভাই সুস্থ আছেন। তার বাড়ি ফিরে আসতে কিছুটা সময় দেরি হবে। কারণ, তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া এবং কিছু করণীয় কাজ বাকি রয়েছে, যে কারণে তাদের সবার সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসতে পারেনি।

বাবা-মা মারা যাওয়ার আগে এদের নিয়ে কথা বলেছি। বাবা-মা এই যোদ্ধাদের সম্পর্কে এমন সব তথ্য বলেছেন যা শুনে আমার নিজের ভেতরই কেঁপে উঠেছে। এসব সত্য আমার কখনো বলা সম্ভব হবে কি না আমাদের এই স্বাধীন দেশে, জানি না। বাংলাদেশে এখনো আমাদের সম্প্রদায়কে অনেকেই ভালো চোখে দেখে। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের এই সম্প্রদায় তথা সম্প্রদায়ের লোকগুলো যে ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা নয়। তারাও স্রোতে গা ভাসিয়েছে। যদিও তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। অনেকেই বেঁচে নেই। তারপরও বলব, এমন কাউকে এগিয়ে এসে সত্য ইতিহাস রচনা করার দায়িত্ব নিতে হবে যে। মা আমাকে সেই কথাটিই বলেছিল। মা যখন দেখেছে আমি লেখালেখি করছি, বইও প্রকাশ করছি বেশ, তখন এই কথাটিই বলেছিল শক্তভাবে অনুরোধ করে যেন বাবার বলা গল্প মনে রাখি এবং পরে লিখি। মা অবশ্য এটা বলেছিল যে এসব লিখলে তোর শত্রু বেড়ে যাবে তবু পারলে সত্য কথাগুলো লিখে যাইস।

আমি পারব কি না মায়ের এমন ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে, জানি না। তবে মনে লালন করছি আমাদের এলাকার সেসব মুক্তিযোদ্ধার কারও কারও জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের কথা। তাঁরাই যে সম্প্রদায়ের কর্তাব্যক্তিদের কাছে অনেক গুরুত্ব এবং সম্মান নিয়ে বেঁচে ছিল এবং আছে। চলবে...