ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার এক দিন

২০০৯ সাল। সবে ক্লাস ফাইভে। মাঝেমধ্যে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার একটা অভ্যাস ছিল। যে ক্লাসের পড়া ভালো লাগত না, সেটা করতে চাইতাম না। এটা শুধু যে আমি, তা নয়! বন্ধুবান্ধব সবাই এমন ছিল। তবে দু–চারজন ছিল একটু অন্য রকম। তারা কখনো ক্লাস ফাঁকি দিত না। তো আমরা বন্ধুরা কী করতাম, স্যার ক্লাসে আসার আগে বেরিয়ে পড়তাম। কারণ, স্যার ক্লাসে আসার পর আর বের হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু হ্যাঁ, কিছু আছে ১ নম্বর ২ নম্বরের কথা বলে আর আসত না। ১ নম্বর ২ নম্বর কী, সেটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।

মাদ্রাসার সামনে দিয়ে বের হওয়ার উপায় ছিল না। তাই পেছন দিয়ে বের হওয়া লাগত। তা–ও অনেক ভয়ে ভয়ে। কেউ কেউ ক্লাসের পাশের উঁচু দেয়াল টপকে বের হতো। কিন্তু আমার ভয় লাগত। তাই আমি অন্যভাবে বের হতাম। অনেক দূর ঘুরে তারপর তারকাঁটার ওপর দিয়ে লাফ দিতাম। আহা কত স্মৃতি!

আমাদের মাদ্রাসা থেকে একটু দূরে কিন্তু একটা বড় চর এলাকা রয়েছে। সেখানে খালপাড়ে আড্ডা দেওয়া অনেকটা নিরাপদ। মানুষের আনাগোনা কম ওখানে। মাদ্রাসায় অভিযোগ দেওয়ার মতো এলাকায় তেমন কেউ নেই। বন্ধুরা মিলে সব সময় ওই জায়গায় ক্লাস ফাঁকি দিতাম। আবার কখনো মাদ্রাসার আশপাশে দাঁড়িয়ে সময় কাটিয়ে দিতাম। চিন্তা করতাম, কখন ক্লাসের ৪০ মিনিট পার হবে। তবে সেটা ভয়ে ভয়ে থাকতাম। মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক যদি দেখে ফেলেন, তখন তো অধ্যক্ষের কাছে বিচার দেবেন। আর স্যার খুব রাগী মানুষ। একবার যদি জানতে পারেন তো খবর আছে। যখনই ৪০ মিনিট হয়ে যেত, তাড়াতাড়ি আবার ক্লাসে চলে যেতাম পরের শিক্ষক আসার আগে। ক্লাসের অনেকে বুঝে যেত ব্যাপারটা। তাই তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসত। কিন্তু স্যার বুঝতেন না। অনেক সময় আবার মাদ্রাসা কোনো কারণে ছুটি দিয়ে দিলে আমরা জানতামও না। তখন আমাদের বইগুলো দপ্তরি শিক্ষক মিলনায়তনে একটা আলমারিতে রেখে দিতেন। এসে দেখতাম বই ক্লাসে নেই। এবার তো আরেক ঝামেলা। দপ্তরিকে অনেক অনুরোধ করে বইগুলো নিতে হতো।

গ্রামে কোথাও আসা-যাওয়ার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বাইসাইকেল। যাদের বাড়ি দূরে, তারা মাদ্রাসায় সাইকেলে আসা-যাওয়া করে। আমারও একটা ছিল। যেটা এখনো বাড়িতে আছে। বাড়িতে থাকলে ওটা চালাই। তো মাদ্রাসায় ওটা দিয়ে আসা-যাওয়া করতাম। এক দিন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে চার বন্ধু মিলে ঘুরতে বের হলাম। সঙ্গে আমার সাইকেলটাও ছিল। তো চারজনের মধ্যে দুজন করে আলাদা হয়ে গেলাম। ওরা দুজন একদিকে আর আমরা দুজন অন্যদিকে গেলাম। আমার সঙ্গে যে ছিল ও সাইকেল চালানো শুরু করল আর আমি পেছনে বসা ছিলাম। ও এমন দ্রুতগতিতে সাইকেল চালাতে শুরু করল, ভয়ে আমার হাত–পা থরথর করে কাঁপছে তখন। ওরে বললাম ধীরে ধীরে চালাতে, কিন্তু ও কথা শুনল না। একপর্যায়ে আমাদের ওই দুই বন্ধুর সঙ্গে আবার দেখা। তখন সাইকেলের গতি অনেক বেশি ছিল। আর রাস্তায় ছোট ছোট পাথর দিয়ে ভরা।

ওরা কি করল! চলন্ত অবস্থায় সাইকেলটা টেনে ধরল। টেনে ধরার কারণে সাইকেল পড়ে গেলে মাটিতে। আমরাও সাইকেল থেকে পড়ে গেলাম। আমার যে বন্ধু চালাচ্ছিল, সে ব্যথায় কাঁদছে। তাই বাকি দুজন ওরে নিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এদিকে যে আমার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, সেদিকে কারও খেয়াল নেই। তখন আমি ওদের ডাক দিয়ে দেখালাম। পাশে একটা বাড়ি ছিল। ওই বাড়ি থেকে ওরা আমাকে পানি খাইয়ে দিল। যে বাড়িতে পানি খেলাম, ওটা ছিল আমাদের এক প্রভাষকের বাড়ি। পানি খাওয়ার পরও রক্ত কমছে না, অনবরত বের হচ্ছে।

যেখানে এই অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, ওখান থেকে হাসপাতাল বেশি দূরে নয়। সবাই মিলে গেলাম হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন সেলাই করতে হবে। যেহেতু সরকারি হাসপাতাল, সেহেতু টাকাপয়সার চিন্তা নেই। তো সেলাইয়ের জন্য ব্লেডের প্রয়োজন। কারণ, যেখানে ফেটে গেছে ওখান থেকে চুল ফেলে দিতে হবে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে ব্লেড নেই। ডাক্তার বললেন, দোকান থেকে ব্লেড আনেন। চারজনের কাছে একটা কানাকড়িও ছিল না তখন। অথচ একটা ব্লেডের দাম মাত্র দুই টাকা। পরিচিত কাউকে পাচ্ছি না যে দুই টাকা নেব তার কাছ থেকে। অনেকক্ষণ কেটে গেল। মাথার রক্ত থামছে না। তখন বুঝতে পারলাম, মাঝেমধ্যে দুই টাকারও মূল্য অনেক। অবশেষে পরিচিত একটা বড় ভাইকে দেখতে পেলাম হাসপাতালের বারান্দায়। উনার থেকে দুই টাকা নিয়ে এক বন্ধু ব্লেড আনল। ডাক্তার সেলাই করা শুরু করলেন। তার আগে কী যে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলেন, সেলাই করার সময় বুঝতেও পারিনি। তারপরও একটু একটু ব্যথা অনুভব হয়েছে। সেলাই শেষে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন আমাকে। এর আগেও একই জায়গায় আমার মাথা আরেকবার সেলাই করতে হয়েছে। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে রিকশায় করে বাড়ি ফিরলাম। মনে মনে ভাবছি, ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার ফল এটা। আর জীবনেও ফাঁকি দেওয়া যাবে না। কিন্তু সবাইকে কী বলব সেই চিন্তায় আছি আমি। ক্লাসে পড়ে থাকা বইগুলো আমার আরেক বন্ধু গিয়ে নিয়ে এল।

বাড়িতে সবাই অবাক! পুরো মাথা আমার ব্যান্ডেজ করা। যদিও ক্ষতটা সামান্য হয়েছে। কিন্তু মাথায় আঘাত পাওয়ায় পুরো মাথা ব্যান্ডেজ করা লেগেছে। আমি খাটে শুয়ে থাকলাম। সবাই একে একে আমাকে দেখতে আসছে। ব্যান্ডেজ দেখে ভাবছে, বেশি আঘাত পেয়েছি। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো এ অবস্থা কীভাবে? কিন্তু আমি পুরো ঘটনা খুলে বলিনি। আমার বন্ধুদেরও না করে দিয়েছি যেন না বলে। বলছি, সাইকেল চালানোর সময় সাইকেল থেকে পড়ে মাথা ফেটে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে ক্লাস ফাঁকি দিতে গিয়ে যে এ অবস্থা, সেটা বলতে গেলে বকা খাব। মা আমাকে ওটা–সেটা তৈরি করে এনে খেতে দিচ্ছে বারবার। আমার তো এ অবস্থাই খাওয়ার ইচ্ছা নেই। তবু কষ্ট করে কিছু খেলাম। এবার আমার ভাইয়া এলেন দেখতে। উনি দেখতে এসে আরেক মহাকাণ্ড ঘটে গেল। আমার পুরো মাথা ব্যান্ডেজ দেখে উনি সহ্য করতে পারেননি। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে পড়ে গেছেন। বিপদের মধ্যে মহা বিপদ। আমাকে দেখবে নাকি উনাকে নিয়ে টানাটানি করবে। সবাই উনাকে ধরে খাটে শুইয়ে দিল। উনার হার্ট যে এত দুর্বল, তখন বুঝতে পারলাম। আমার হার্টও যে অনেক শক্ত, তা নয়! আমিও কারও কষ্ট দেখলে সহ্য করতে পারি না। তাই হাসপাতালের নাম শুনলে আমার কম্পন সৃষ্টি হয়ে যায়। এত বড় হয়ে গেছি, কিন্তু ভয়টা এখনো আছে। না যাওয়ার চেষ্টা করি সব সময়।

কিছুক্ষণ পর ভাইয়ার জ্ঞান ফিরল। একসঙ্গে দুই ভাই রোগী হয়ে গেলাম। আমাকে দেখবে নাকি উনাকে! আমার সুস্থ হতে অনেকটা সময় লেগেছে। কিন্তু ভয়টা থেকে গেছে। তাই এরপর থেকে নিজেও সাইকেল দ্রুতগতিতে চালাতাম না কখনো। অনেক দিন পর মাদ্রাসায় ফিরলাম। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। সবাই ইতিমধ্যে এ ঘটনা শুনে গেছে। আমার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইছে। আমিও তখন মোটামুটি সুস্থ। খুব বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছি, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া। কারণ, যে জায়গায় পড়েছি, ওখানে সব পাথর ছিল। এরপর থেকে ক্লাস ফাঁকি দিলেও দূরে কোথাও যেতাম না। আশপাশে থাকতাম। কিন্তু একা কখনো বের হতাম না। কারণ, বন্ধুদের ছাড়া একা ক্লাস ফাঁকি দেওয়াতে মজা নেই।

এভাবে কত যে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দিয়েছি, তার শেষ নেই। ক্লাস ছুটি হলে কী যে আনন্দ করে বাড়ি ফিরতাম। এক দিন বন্ধ হলেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেতাম। অপেক্ষা করতাম যাতে এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টা আগে ছুটি দিয়ে দেয়। দুই ক্লাস ওপরে ওঠার পর ফোরকান স্যারকে পেলাম। ফোরকান স্যারের হাতে মার খায়নি এমন ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না। স্যার একটু মারতেন বেশি। তাই উনার ক্লাস তো এক দিন না হলে সবাই খুশি হয়ে যেত। মনে মনে দোয়া করত যাতে স্যার না আসে কিংবা কোনো কারণে মাদ্রাসা ছুটি হয়ে যায়। তবে উনার ক্লাস কেউ ফাঁকি দিতে পারত না। উনি সবাইকে চেক করতেন। কাউকে উনার ক্লাসে অনুপস্থিত পেলে হাজিরা খাতা নিয়ে এসে মার্ক করে দিতেন। পরদিন যখন তাকে পেতেন, মারের কথা ভুলতেন না। বেত সব সময় ক্লাসে রেডি রাখতে হতো উনার জন্য। তবে খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন।

ক্লাসে বসে বাড়ির পড়া শেখা, স্যার না এলে সবাই মিলে গল্প করা, পাশের পুকুরপাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, কোথাও ঘুরতে যাওয়া, একসঙ্গে মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া করা, বাড়ি ফিরে পুকুরে সাঁতার কাটা, বিকেলে স্কুল মাঠে খেলাধুলায় মেতে ওঠা—গ্রামীণ পরিবেশগুলো সত্যি অন্য রকম। যারা শহরে বেড়ে ওঠে, তারা কখনো গ্রামের মর্ম বুঝবে না। কত দুষ্টুমি সেই শৈশবে করলাম, যা এখন শুধু স্মৃতির পাতায় পড়ে আছে। চাইলেও সেই সময়ে আর কখনো ফিরতে পারব না। এরপর ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেলাম। একটা সময় পাড়ি দিলাম প্রবাসে। কিন্তু মাঝেমাঝে যখন মনে পড়ে, তখন মন চায় সেই শৈশবে আবার ফিরে যাই; যেখানে জীবনসংগ্রামের জন্য লড়াই করতে হয় না।