গন্ডারের চামড়া আসলে কত মোটা

প্রচলিত আছে, গন্ডারকে কাতুকুতু দিলে নাকি সাত দিন পর সে টের পায়। জানি না কথাটার সত্যতা কতখানি। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সত্যি হতেও পারে। কারণ, গন্ডারের চামড়া অনেক মোটা বা পুরু। চামড়া মোটা হওয়ার কারণেই হয়তোবা এই কথাটা প্রচলিত। যাহোক, মানবসমাজে চামড়া মোটা হওয়ার অনেক সুবিধা আছে। আর এমন মোটা চামড়ার মানুষকে আবার আমরা গন্ডার বলে সম্বোধন করতেও ছাড়ি না।

মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় হচ্ছে চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক। ছোটবেলায় প্রাথমিকে ভর্তির আগে আমাদের সাধারণ কিছু প্রশ্ন করা হতো। এর মধ্যে একটা প্রশ্ন ছিল, মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের নাম বলো। আমাদের মা–বাবা প্রতিবেশী মিলে সেটা মুখস্থ করিয়ে দিত। এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েই মানুষ তার আশপাশের পরিবেশ–পরিস্থিতি বিচার করে আর বিবেক প্রয়োগ করে সিদ্ধান্ত নেয়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি আশপাশের পরিবেশ–পরিস্থিতির ঠিক কতটা গায়ে মাখবেন আর কী কী আমলে নেবেন? এটা একটা মানুষের একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং মানুষে মানুষে এর ভিন্নতাও পরিলক্ষিত হয়। কারণ, প্রত্যেক মানুষই এক একটা আলাদা সত্তা এবং তাদের জীবনপ্রণালিও একেবারেই ভিন্ন। অবশ্য কিছু বিষয় একেবারে সর্বজনীন যেমন, মানুষ যেহেতু জীব, তাই তার মৌলিক চাহিদা থাকবেই; আর সেগুলোর কতটুকু পূরণ হলো বা হলো না, তার ওপর নির্ভর করে মানুষের মনে আক্ষেপও থাকবে। তবে কে কতটুকুতে সন্তুষ্ট হবে, সেটাও আবার মানুষে মানুষে ভিন্ন। সন্তুষ্টি নির্ভর করে সেই মানুষটার বিচার–বিবেচনার ওপর। একই মানুষ তার নিজের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট না–ও থাকতে পারে, কিন্তু যদি সে তার আশপাশে তাকায়, তাহলে দেখবে তার চেয়ে অনেক কম নিয়েও বহু মানুষ শান্তিতে দিনাতিপাত করছে। আবার অনেকেই কোনো কিছু না পেয়েও শান্তির ঘুম দিচ্ছে। কারণ, জীব হিসেবে জীবনের ভাষা একটাই, সেটা হচ্ছে বেঁচে থাকা।

একটা রম্য রচনা লিখব বলে বসেছিলাম। কিন্তু বিষয়বস্তু সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে বাস্তবতার কাছে ফিরে আসার চেষ্টা করা যাক। আমার চামড়া ঠিক কতখানি মোটা, সেই বিষয়ের ফয়সালাটা আজ করতেই হবে। ছোটবেলায় আমরা সবাই কমবেশি ফোড়ন কাটার শিকার হয়, যেটাকে বিদেশিরা বলেন, বুলিয়িং। আমি আসলেই বুঝতাম না যে এগুলো বুলিয়িং, কারণ আমি এগুলো সত্যিকার অর্থেই উপভোগ করতাম এবং এখনো করি। আমার চেহারা, গাত্র বর্ণ, বংশপরিচয় নিয়ে বহু ফোড়ন কাটার শিকার হয়েছি এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, যেহেতু সেগুলো গায়ে মাখিনি, তাই ভুলেও গেছি। এখন যখন সেই সব গল্প অন্যদের কাছে বলি, তারা বলে আমি কেন প্রতিবাদ করিনি। কারণ, এগুলোই নাকি বুলিয়িং। আমার কথা হচ্ছে, আমি তো সেগুলোর কারণে জীবনে থেমে যায়নি, বরং নিজেকে শুধরে নিয়ে আরও বেশি বেগে আগুয়ান হয়েছি। তাই ওই কথাগুলো আমার জন্য আসলে শাপেবর হয়েছিল।

জীবনে চলার পথে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তেই আপনি বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন এবং আপনাকে সেগুলোর মোকাবিলা করেই অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, ঠিক কোনগুলোকে প্রাধান্য দেবেন। আর একটা ব্যাপার খেয়াল করবেন, সেটা হলো প্রতিটি ঘটনারই দুটি পক্ষ থাকে, একটা আপনি আর অন্যপক্ষে আরেকজন। যে ঘটনাটা আপনার কাছে বিরূপ মনে হচ্ছে, সেই একই ঘটনা অন্য পক্ষের কাছে সমপরিমাণ বিরূপ না–ও হতে পারে বা গুরুত্ব পেতে পারে। তাই সহজ উপায় হচ্ছে, সবকিছুকেই সহজভাবে নেওয়া। আর এই সহজভাবে নেওয়ার মাত্রাটা আবার ব্যক্তিভেদে ভিন্ন। কারণ, এক একজনের অভিজ্ঞতা ও মানসিকতা ভিন্ন। আর এগুলোকে মোকাবিলা করে সাময়িক আত্মতুষ্টি পেলেও পরমুহূর্তেই মনে হতে পারে হয়তোবা আপনি এতটা সিরিয়াস না হলেও পারতেন। তাই তখনো আবার আপনার মন খারাপ হবে। তাই সবচেয়ে ভালো হয়, ঘটনাটা যদি আপনি সহ্য করে নিতে পারেন। আর এই সহ্য করার ক্ষমতাটাই আসলে আপনার মোটা চামড়ার বা মোটা অনুভূতির প্রকাশ।

নিজের চেহারা, গাত্র বর্ণ ও বংশপরিচয়ের কথা আগেই বলেছি। এবার আসি সাজ–পোশাকের বিষয়ে। পোশাক আমার কাছে নিতান্তই একটা লজ্জা নিবারণের বস্তু, আর সেটা পরিষ্কার হলেই আমি খুশি। কিন্তু আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পোশাকের বাহার দিয়েই কিন্তু মানুষের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ করা হয়। সমাজে, অফিসে, স্কুলে, আদালতে পরিপাটি হোক বা না হোক, দামি পোশাক পরিহিত মানুষকে সবাই সমীহ করে চলে। আবার এই পোশাক কিনতেও আপনি যখন আবার কোনো দোকানে যাবেন, সেখানেও দোকানি আপনার পরিহিত পোশাক বিবেচনায় রেখেই কিন্তু আপনাকে নতুন পোশাকগুলো দেখাবেন। আপনার পরনে যদি কেতাদুরস্ত পোশাক না থাকে, তাহলে ভালো পোশাকের খবর নিতে না যাওয়ায় ভালো। আমি একবার এক দোকানে গিয়ে ঠিকই এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। আমি অবশ্য মোটেও অবাক হইনি, কারণ আমি ছোটবেলা থেকেই এগুলোর মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। তাই এগুলো আমার কাছে অনেকটা ডালভাতের মতো। ডালের মধ্যে ভাত চটকিয়ে থালার কিনারায় মুখ লাগিয়ে দাও একটা চুমুক। খাবার একেবারে সরাসরি পাকস্থলীতে গিয়ে হাজির হবে, চাবানোর বা গেলার কোনো বাড়তি ঝামেলা নেই। আমার ধারণা, খাবারগুলো পাকস্থলীতে গিয়ে নিশ্চয় মনে মনে ভাবে, বেটা তো বহুত বজ্জাত; আমাদের আরও একটু মুখের মধ্যে রেখে দুটি চাবান দিয়ে দুনিয়ার বাতাস খাওয়ালে কী–ই বা এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত। যাহোক, এ যাত্রা গিন্নি আমার সঙ্গে থাকায় মুশকিলে পড়লাম। গিন্নি দোকান থেকে বের হয়ে দেখি ওড়নার আঁচলে মুখ ঢাকছে। আমি বললাম, ধুর পাগলি মেয়ে, এগুলোতে কেউ মন খারাপ করে। আমার সম্মান আমার কাছে। বাইরের লোকের কান কথায় তাতে কী আসে যায়। আর ছোটবেলা থেকে এগুলো মোকাবিলা করতে করতে আমার চামড়া গন্ডারের মতো মোটা হয়ে গেছে।

বর্তমানে আমাদের সমাজব্যবস্থাটা একটা অদ্ভুত পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই নীতিবাক্য আউড়ায়, আমরা সবাই সুন্দর, সৎ, আদর্শ সমাজের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আদতে সেটা অর্জন করার জন্য যে কাজগুলো করা দরকার, আমরা মোটেও সেগুলো করি না। আর যারা সেগুলো নিজেদের বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, তাদের আবার আমরা বলি বোকা বা বলদ। সবাই শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন চাই, কিন্তু অন্যদিকে সবাই আবার তাদের বাচ্চাদের একাধিক কোচিংয়ে পাঠাই। সবাই শিশুদের সুন্দর শৈশবের কথা বলে, কিন্তু তাদের এমন কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত করে না, যাতে করে তাদের মনে একটা সুন্দর শৈশবস্মৃতি তৈরি হতে পারে। বিখ্যাত লোকগুলোর ক্ষেত্রে মনে হয় এগুলো আরও বেশি সত্যি। একজন লেখক সমাজ বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখান তাঁর লেখার মাধ্যমে, কিন্তু সমাজে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন আসবে এমন কোনো কাজ না করে সুযোগ বুঝে চাটুকারিতা করে নিজের স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারে মত্ত থাকেন। আমি যে যৎকিঞ্চিৎ লেখালেখি করি, তার প্রায় ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ আমাদের জীবনপ্রণালির গল্প। এতে করে জীবনাচার অনেকটা খোলা বইয়ের মতো হয়ে গেছে। আমাদের ফেসবুকের পাতায় চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, আমাদের জীবনটা আসলে কেমন। এটা নিয়েও মুশকিলে পড়তে হয়। আমার কার্যক্রমগুলোর বেশির ভাগই বর্তমান বাস্তবতার আলোকে পাগলামি মনে হতে পারে। কিন্তু সেই কথাগুলো মানুষ আমাকে বলে না, কারণ তারা জানে এগুলো আমি গায়ে মাখি না। তাই তারা এগুলো বলেন আমার গিন্নিকে। তখন গিন্নি বাসায় ফিরে সেই রাগ ঝাড়েন আমার আর ছেলেমেয়ের ওপরে। কারণ, ছেলেমেয়ে দুটি আমার সব পাগলামির অংশ। আমি তখন গিন্নিকে বলি, তুমি যেহেতু সহ্য করতে পারো না, তাহলে তুমি এগুলো শুনতে যাও কেন? সে উত্তর দেয়, সে আসলে শুনতে যায়নি, তাকেই এসে বলেছে। আমি তখন বলি, তুমি এগুলো গায়ে মাখো কেন। গিন্নি উত্তরে বলে, আমার তো আপনার মতো গন্ডারের চামড়া না। তাই আমার গায়ে লাগে। শুনে আমি মিটিমিটি হাসি।

বর্তমান দুনিয়ায় চারদিকেই প্রতিযোগিতা। এমন কোনো বিষয় নেই, যেটা নিয়ে মানুষ প্রতিযোগিতা করছে না। আর এখন প্রতিযোগিতা বেড়ে গিয়েছে হাজার, লক্ষগুণ বেশি। কারণ, আগে শুধু মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো, এখন মানুষের পাশাপাশি যন্ত্রের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতায় মুনাফার স্কেলে সবকিছুই বিচার করা হয় আর সেটা করতে গিয়ে আমরা যন্ত্রের সাহায্য নিচ্ছি উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য। এর ফলে অনেক মানুষ কর্ম হারাচ্ছে। মুষ্টিমেয় মানুষকে রাখা হচ্ছে সেই যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। শুধু উটপাখির মতো ঝড়ের সময় বালুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে থাকলেই এই প্রতিযোগিতা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা তো অনেক কঠিন। আপনি চোখ খুললেই নিজেকে আবিষ্কার করবেন একটা চরম প্রতিযোগিতার মধ্যে। আর এটা করতে গিয়ে বিষণ্ণতা, একাকিত্বের মতো সব জীবননাশী অসুখের যেগুলোর আসলে কোনো চিকিৎসা নেই, কারণ ছোটবেলা থেকেই আমরা এগুলো নিয়ে বড় হয়েছি। বড় হতে হতে একসময় ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি। এখনই তাই উপযুক্ত সময় নিজের চামড়াটাকে গন্ডারের চামড়ার মতো মোটা করার, যাতে করে আশপাশের মানুষের প্রতিযোগিতার আঁচে আপনার শরীর সহজেই ঝলসে না যায় বা আপনি সেগুলো নিয়ে বিচলিত না হয়ে নিজের মনের মতো করে জীবনটাকে পরিচালিত করতে পারেন।