এমাজউদ্দীন স্যার বাসায় যেতে বলেছিলেন, হলো না

অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ

বিবেকবার্তা ম্যাগাজিন একসময় ঢাকা থেকে প্রিন্ট করিয়ে আনা হতো জাপানে। সর্বশেষ প্রিন্ট করার দায়িত্বে ছিলেন বনানীতে অতীশ দীপংকর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক। তাঁর মাধ্যমে সব কাজ করিয়ে আনার পর যখন দেখি হাজারটা ভুল রয়ে গেছে, তাই আমি দেশে বিবেকবার্তা ম্যাগাজিনের প্রিন্ট করানোর সিদ্ধান্ত বাতিল করি। যেহেতু ঢাকায় আমার আরও বেশ কিছু কাজের দায়িত্ব তাঁকে দিয়ে পালন করাতাম, সুতরাং আমার লেখা তিনটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দিই।

দেশের বাইরে থাকি, সুতরাং অনেক কিছুই দেশ থেকে আমাকে যেভাবে বলা হতো, সেভাবেই বিশ্বাস করে সিদ্ধান্ত দিতাম। আর দেশে গিয়ে যেহেতু খুব বেশি দিন থাকা হয় না, সুতরাং অন্যদের ওপর নির্ভর করতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার সঙ্গে এই বই প্রকাশনী উৎসব নিয়ে ভেন্যু প্রসঙ্গে কথা বললে জাতীয় প্রেসক্লাব এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলাম। সুবিধামতো তারিখও বলে দিয়েছিলাম তাঁকে। এরপর তাঁরা আমার কথা অনুযায়ী ভেন্যু ঠিক করেন।

অনুষ্ঠানের দিন–তারিখ সবকিছু ফাইনাল হলে প্রধান অতিথির কথা জানতে চাইলাম, কাকে করা হচ্ছে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। বলা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ স্যারের কথা। বিশেষ অতিথির কথা জানতে চাইলে বলেছেন কবি আল মুজাহিদীর নাম। দেশে থাকার সময়ে আমি কবি আল মুজাহিদীকে ভালো চিনতাম, তাই অতিথি নিয়ে আর কোনো দ্বিমত পোষণ করিনি তখন।

এরপর দেশে গিয়ে নিজের কাজের পাশাপাশি আমার বইয়ের প্রকাশনা উৎসবের খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। সাংবাদিক বন্ধুদের কাউকে কাউকে বলতে অনেকটা সময় কেটে গেলে আমি আর প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। যে কারণে অনুষ্ঠানের দিন সময়মতো ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির কনফারেন্স হলে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম দর্শক-শ্রোতা দিয়ে হল ভরার জন্য। অনুষ্ঠানে যাঁদের আসার কথা, তাঁদের আসতে দেরি হতে দেখে মন খারাপ হচ্ছিল। প্রধান অতিথির আসতে দেরি মেনে নেওয়া গেলেও হলে যদি উপস্থিতির সংখ্যা কম থাকে, তবে লজ্জা পেতে হবে যে। তাই টেলিফোন করে জনে জনে যোগাযোগ করায় ব্যস্ত হয়ে উঠি সেই মুহূর্তে। কারণ, যাঁদের দ্বারা সেদিনের অনুষ্ঠান করিয়েছি, তাঁরা যে সব ব্যাপারে ততটা আন্তরিক নন, তা বুঝতে পারি তাঁদের কথা ও আচরণে।

noname
noname

প্রত্যাশিত প্রত্যেকের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ শেষ করে মঞ্চের একপাশে বসে অনুষ্ঠানের সঞ্চালককে আমার সম্পর্কে এবং আমার বই সম্পর্কে ব্রিফ করছিলাম। এমন সময় প্রধান অতিথি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ এসে আমার পেছন দিক থেকে ধরে বললেন, ‘সরি প্ল্যাসিড সাহেব। আমার একটু সময় দেরি হয়ে গেছে। প্রেসক্লাবে আমার একটা প্রোগ্রাম ছিল, সেটি শেষ করে বের হয়ে আসতে দেরি হয়ে গেল যে। আমি জানি আপনি জাপানে থাকেন। জাপানের মানুষেরা সময় খুব মেনটেইন করে। আমাকে ভুল বুঝবেন না।’ বলে পাশে খুব সহজভাবে আমাকে ধরে দাঁড়ালেন। স্যারের উপস্থিতি আমার হার্টবিট বাড়িয়ে দিচ্ছিল। তখন আমি কী রেখে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

অনুষ্ঠান চলাকালে মঞ্চে যাঁদের বসার কথা নয়, তাঁরাই দেখি আগে গিয়ে মঞ্চে উঠে বসে আছেন। আর যাঁদের বসাব ভেবে রেখেছিলাম, তাঁরা দূরে বসে তামাশা দেখার মতো দেখছিলেন। আসলে আমি বিষয়টিতে এভাবে অভ্যস্ত ছিলাম না বলে নিজেই মঞ্চে উঠতে লজ্জা পাচ্ছিলাম তখন। এরপর উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের সহায়তায় স্যারকে নিয়ে মঞ্চে উঠে চেয়ার টেনে বসলে তাঁর সামনে আমার বই তিনটি দিলাম। স্যার বললেন, ‘আমি আপনার বই পড়েছি।’ আমি স্যারের কথা শুনে অবাক হলাম। স্যার বললেন, ‘যেহেতু প্রকাশনা উৎসব সুতরাং আমার তো বই নিয়ে কিছু কথা বলতে হবেই আর বই যদি পড়া না থাকে বলব কী করে, তাই রাত জেগে পড়েছি কিছুটা।’ বলেই ‘নিশি গুচি পার্ক’ বইটির প্রথমে ব্যবহার করা একটি উক্তির নিচে লেখা ভুল নাম দেখিয়ে বললেন, এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়, এখানে শরৎচন্দ্র হবে।

ভুলটি আমার চোখে পড়লেও অনুষ্ঠানে যে এই ভুল ছাপার বই নিয়ে আসবে ভাবিনি। যে কটা বই অনুষ্ঠানে দেওয়া হবে, সে কটি বই ফ্লুইড দিয়ে কারেকশন করে আনার কথা ছিল, কিন্তু কেন তা করেনি বুঝলাম না। স্যারকে বললাম, ‘আসলে আমি ঠিক করে দিলেও এখানে যাঁরা প্রুফ কেটেছেন তাঁরা কেন এটা ঠিক করেননি, বুঝলাম না।’ অনুষ্ঠানে স্যার আমার জাপানে জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক সময় ধরে সেখানে বসে কথা বলেছেন। এরপর আমার ঢাকার টেলিফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে বলেছিলেন একদিন সময় করে তাঁর বাসায় চা খেতে যেতে।

সত্যি কথা বলতে, আমার সেই বইয়ের প্রকাশনী অনুষ্ঠানের পর বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছি। স্যারের সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছে। টেলিফোনে কথাও হয়েছে। প্রতিবারই বাসায় যেতে বলেছেন। কিন্তু একা যাওয়ার চেয়ে সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম। ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়ার জন্য যখনই আবদার করেছি, তখনই স্যারের রাজনীতির আদর্শ বিশ্বাস করার কারণে আমার যাওয়ায় বাধা দিয়েছেন। এতে প্রতিবারই বিষয়টির জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে।

আমি সব সময় নিজের রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলতে গিয়ে খুব স্পষ্ট বলি, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ভালোবাসা বা বিশ্বাস-আস্থা কিছু নেই। তবে বঙ্গবন্ধুর বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে। কথাটি স্পষ্ট করতে সাহস জুগিয়েছেন প্রয়াত নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী। 

বলছিলাম অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে। তিনি হতেই পারেন একটি দলের আদর্শে বিশ্বাসী। তাই বলে তিনি একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে কখনো দেশকে জ্বালাও–পোড়াওয়ের মাধ্যমে ধ্বংসের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। স্যারের চাওয়াতেও ছিল ভালো রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাচেতনা। যদিও স্যারের চিন্তাচেতনার প্রয়োগ বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলই মন থেকে গ্রহণ করেনি। শুধু তা–ই নয়, স্যার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন, তাঁর অধীন সব শিক্ষক-ছাত্র কিন্তু তাঁর বিশ্বাস করা আদর্শের দলের আদর্শ লালন করেননি। তাহলে স্যারের সঙ্গে দেখা করে কথা বললেই আমি বাংলাদেশে একটি আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে বঙ্গবন্ধুর দলের বিরোধী হয়ে যাব, এমন সিল আমার আদর্শে লাগিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানোর বিষয়টি তখন না বুঝলেও স্যার চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, আমরা আসলেই জ্ঞানী লোকের মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করি, তারই প্রমাণ আমি নিজে।

স্যারের সঙ্গে আমি যতবারই কথা বলেছি, ততবার একটা কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘তোমাদের তো রাজনীতি করার দরকার নেই। তোমাদের মতো প্রবাসীদের দেশে দরকার আছে। যা–ই পারো দেশের মানুষের জন্য কিছু করে রেখে যেয়ো।’ স্যার চলে গেলেন। দেশের মানুষের জন্য এখনো কিছু করতে পারিনি। জানি না শেষ পর্যন্ত কিছু করে রেখে যেতে পারব কি না। তবে স্যারের কথাটি মনে লালন করেই চেষ্টা করছি কিছু অন্তত করতে।

স্যার যদিও সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না, তারপরেও স্যার তো স্যারই। তিনি জ্ঞানপাপীদের কাছে স্যারই ছিলেন। স্যারের সেদিনের কথাগুলো আমি ভুলতে পারছি না। যেখানেই থাকুন স্যার ভালো থাকুন। আপনার আত্মার চিরশান্তি ও বেহেশত নসিব কামনা করছি।

*লেখক: জাপান প্রবাসী