দ্য কাউ

আবহাওয়া অধিদপ্তর ভয়াবহ আম্পান অথবা আইলার মতো ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার আগে যেমন আগাম সতর্কসংকেত দেয়, আমার স্ত্রীও তেমনি কোনো কারণে রাগ করলে তার প্রথম কাজ হলো, ফেসবুকে আমাকে ব্লক মারা। এটি হচ্ছে তার ১ নম্বর সতর্কসংকেত। আজও মনে হচ্ছে সে রকমই কিছু একটা ঘটেছে। আমি তার ফেসবুক আইডি সার্চ করে কিছুতেই তার আইডিতে প্রবেশ করতে পারছি না। তেমন কিছু করেছি বলেও তো মনেও পড়ছে না। শুধু গতকাল রাতে আরব দেশের এক বিশিষ্ট ভদ্রলোকের এক ফেসবুক পোস্টে দেখছিলাম, মরুভূমিতে তীব্র দাবদাহের মধ্য বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তাঁর চারপাশ ঘিরে চারজন স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কমেন্টে লিখলাম—মাশা আল্লাহ ‘যত স্ত্রী, তত ছায়া’, ব্যস এরপরেই ব্লক।

অবস্থা ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাওয়ার আগেই ব্লক ওঠাতে হবে। এরপরের পরিণতি হচ্ছে, রান্নাঘরে স্ত্রীর অবস্থান ধর্মঘট। অর্থাৎ, মিনার কাজ রাজু করবে, আর রাজুর কাজ মিনা। রাজুর তো এখন কোনো কাজই নেই ঘুমানো ছাড়া। মিনার কাজের কথা চিন্তা করতেই মাথাটা ঘোরাচ্ছে। শুধু কিচেনের বেসিনেই আট–দশটা এঁটো প্লেট, চামচ আর বড় বড় ঢাউস সাইজের পাতিলগুলো আমার দিকে তাকিয়ে বাংলা ছবির ভিলেন গাংগুয়ার মতো হাসি দিচ্ছে। কী যে ভয়ংকর অবস্থা। লকডাউনের কারণে এমনিতেই বাইরের হোটেলগুলো সব বন্ধ, বাইরে থেকে যে খাবার নিয়ে আসব, সেই উপায়ও নেই।
এদিকে কিছুদিন পরই ঈদুল আজহা। যেভাবেই হোক, এই ঈদের আগে অবশ্যই এ ব্লক ওঠাতে হবে। তা না হলে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় থেকেও ভয়াবহ ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। গত বছরগুলোতে হাটে গিয়ে দেখেশুনে গরু কিনে আনতে পারলেও এবার করোনার কারণে কীভাবে কিনব, কিছুই মাথায় আসছে না। মনে হয় এবার গুগল ক্লাসরুম টাইপের কোনো অ্যাপ অথবা জুম ব্যবহার হতে পারে গরু ক্রয়-বিক্রয়ে। ফেসবুক লাইভকেও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রাখা যায়। মাঝখানে উপস্থাপক এবং দুই পাশে দুই গরু ও ক্রেতাদের মাঝেমধ্যে লাইভে আমন্ত্রণ। হাম্বা হাম্বা ডটকম নামে গরু ক্রয়–বিক্রয়ের ওয়েবসাইট খুললেও মন্দ হতো না।

গরু ব্যবসায়ী আক্কাস মিয়াকে সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, এবার কীভাবে গরু বিক্রয় করবেন? অত্যন্ত লাজুক ভঙ্গিতে তাঁর পান খাওয়া লাল বর্ণের দাঁতগুলো বের করে হাসি দিয়ে বলেন, ‘ভাইজান, সামনের শুক্রবার বাদ জুমা ফেসবুক লাইভে আইসেন।’ আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আপনি ফেসবুকে কীভাবে লাইভ করবেন! ‘ভাইজান যে কী বলেন, আমি করব কেন, উপস্থাপকের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করছি। গরু বিক্রির ওপর তাঁর কমিশন ১০ শতাংশ। উপস্থাপিকা একসময়ের রুপালি চিত্রজগতের জনপ্রিয় ড্যাশিং নায়িকা। বর্তমানে পারিবারিক কারণে অবসরে আছেন। কেন ভাইজান আপনি উড়ু উড়ু মন ছবিটা দেখেন নাই?’ আমি শুধু হুম বলে মাথা দোলালাম।
গরু বিক্রির কাজে রুপালি চিত্রজগতের একসময়ের এই ড্যাশিং নায়িকা কী ভূমিকা পালন করতে পারেন, তা কিছুতেই আমার মাথায় আসছে না। আক্কাস চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘আমার ফেসবুক পেইজে একটা লাইক দিতে ভুইলেন না কিন্তু ভাইজান।’ আমি আক্কাস মিয়ার কথা যতই শুনছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। গর্বে বুকটা ফুলে উঠছে। ভাবছি, দেশ তো দেখি সত্যিকার অর্থেই এগিয়ে যাচ্ছে। আক্কাস মিয়া আরও জানালেন, এই লাইভের জন্য তিনি পীরইয়ামেনি মার্কেট থেকে নতুন পাঞ্জাবি এবং বাটা কোম্পানির এক জোড়া জুতাও কিনেছেন। তবে তাঁর রয়েছে বিস্তর সন্দেহ যে জুতাটি অরিজিনাল কি না। বাটার নাম ভাঙিয়ে অনেক ভেজাল কোম্পানি নাকি বের হয়েছে। তাঁর সন্দেহ আরও জোরালো আকার ধারণ করল যখন তিনি দেখলেন বাটা বানানে টি অক্ষর তিনটা। আমাকে বললেন, ‘ভাইজান জুতা কিনে আমি বেজায় ঠকে গিয়েছি। ফুটপাত থেকে কিনেছি, বাসায় এনে দেখি টি অক্ষর তিনটা। আমি ধরতে পারি নাই, আমার কন্যা ধরে ফেলছে। কন্যা বেজায় বুদ্ধিমতী। ইংরেজিতে অত্যন্ত ভালো, তবে গণিতে কিঞ্চিৎ কাঁচা। উস্তা ভাজি একদম খেতে চায় না।’ করল্লা ভাজি খাওয়ার সঙ্গে গণিতে পাকা হওয়ার যে কী সম্পর্ক, তা আমার মাথায় ঢুকল না। তবে এ বিষয়ে আক্কাস মিয়াকে আমি আর কোনো প্রশ্ন করিনি। যাহোক, বাসায় পৌঁছে ফেসবুকে প্রথমেই আক্কাসের পেজে লাইক এবং ফলো দিয়ে রাখলাম। মূলত গরুর লাইভ দেখাটি প্রধান উদ্দেশ্য না হলেও একসময়ের সেই বিখ্যাত ড্যাশিং নায়িকা কে, দেখার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারছিলাম না।
২০১৮ সালের ঘটনা। সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা হাতে নিতেই মনটা ভীষণ রকমের খারাপ হয়ে গিয়েছিল। পত্রিকার হেডিংয়ে বড় বড় করে লেখা—এবার কোরবানির হাট মাতাবে মেসি। এত প্লেয়ার থাকতে মেসিকে নিয়ে টানাটানি কেন রে ভাই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, ব্রাজিলের নেইমার অথবা বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্স ও রানারআপ ক্রোয়েশিয়ার কেউই স্থান পেল না তোদের এই গরুর হাটে। এত নামীদামি তারকা থাকতে শেষ পর্যন্ত আমার মেসিকেই তোদের পছন্দ হলো! ছোটবেলা রচনা পড়ে গরু সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল তা হলো, গরু গৃহপালিত অত্যন্ত নিরীহ প্রকৃতির একটি চতুষ্পদ প্রাণী। যদিও নিরীহ কি না, এ নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। কারণ, একবার কোরবানির ঈদে গরুর হাটে গিয়ে গরুর লেজ ধরে টান দিয়ে পশ্চাৎপদের লাথি খেয়ে কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল, ‘আমি জ্ঞান হারাব, মরেই যাব, বাঁচাতে পারবে না কেউ।’ যদিও সে যাত্রায় সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় বেঁচে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আমার গরুভীতি। আরেকবার স্কুলমাঠে ফুটবল খেলছিলাম, মেসির মতো সবাইকে কাটিয়ে বিপক্ষের গোলপোস্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি গোলকিপার উল্টো দিকে দৌড়। আমি তো হতবাক, পেছনে তাকাতেই দেখি বিশাল আকৃতির চোখা শিংওয়ালা গরু বাহুবলির মতো আমার দিকে ছুটে আসছে। এতগুলো আমজনতা থাকতে আমার মতো নিরীহ লোকের প্রতি কেন যে তার এত আক্রোশ, তা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না সে মুহূর্তে। আচমকা জ্ঞান ফিরতেই উসাইন বোল্টের চেয়েও অধিক গতিতে দৌড়ে ওয়াল টপকে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। বাসায় গিয়ে গরু রচনার রচয়িতার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলাম কী কারণে, এই ধরনের অসভ্য প্রাণীকে সে নিরীহ বলে অ্যাখ্যা দিল?
যত দূর মনে পড়ে, রচনায় গরুর নামকরণ নিয়ে কোথাও উল্লেখ নেই। জন্মের পরই প্রাণিকুলের বিভিন্ন নাম রাখা হলেও গরুর নাম রাখা হয় ঠিক কোরবানির ঈদের আগে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিচিত্র সব নামকরণ। কখনো সুলতান, টাইটানিক, বিগ বস, রোজো, কালা তুফান, রাজা, ক্যাপ্টেন, শাহেনশাহ, লালুকালু, টাইগার আবার কখনো খেলোয়াড়ের নামে এই যেমন বোল্ট, সোয়ার্জনেগার, দ্য রক। তবে এ ক্ষেত্রে ফুটবল তারকারা এগিয়ে থাকলেও ক্রিকেট তারকারা এখনো পিছিয়ে আছেন। কোহলি, ক্রিস গেইল, শোয়েব আখতার, মুরালিধরন এবং অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের তারকা ক্রিকেটাররা এই নামকরণের তালিকা থেকে বাদ পড়াটা সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ভদ্রলোকগুলো জানতে পারলে তারা অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হবেন বলে আশঙ্কা করছি। মালিঙ্গাকে একবার চান্স দেওয়া হলেও গরু হিসেবে নামকরণের যে সার্থকতা, সেটি অর্জনে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তবে মেসিকে জড়ানোটা সন্দেহজনক। নিশ্চয় কোথাও এ ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম কিংবা স্থূল কারচুপি হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করলে প্রকৃত কারণ উদ্‌ঘাটন করা যেত। তবে আমার ধারণা, ব্রাজিলের সমর্থকগোষ্ঠীর হাত রয়েছে এহেন অপকর্মের পেছনে।
আমাদের দেশে রাতারাতি সেলিব্রেটি হওয়ার যে কয়টা পথ, তার মধ্যে অন্যতম বাজারের সবচেয়ে বড় এবং দামি গরু কিনে ফেসবুকে সেলফি দেওয়া। মুহূর্তেই ভাইরাল। পত্রিকা ও মিডিয়াগুলোও হুমড়ি খেয়ে পড়বে। একপাশে গরু অন্যপাশে গুরু। গরু ও গুরু উভয়েই দাঁত কেলিয়ে হাসছে আর পরদিন পত্রিকায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়েছে—মেসিকে চড়া মূল্য দিয়ে কিনলেন আক্কাস। এই ধরনের সেলিব্রেটি হওয়ার ইচ্ছা মনে মনে থাকলেও স্বাদ ও সাধ্য কখনো মেলাতে পারিনি। বড়ই আফসোস!
আচ্ছা, এই বছর গরুর নামকরণ কী হবে? তবে এ বছর ভাইরাসের নামে নামকরণ হতে পারে। সবচেয়ে মোটাতাজা গরুর নাম হবে করোনা কিংবা ডেঙ্গু, এইডসসহ যত ধরনের ভাইরাস আছে এই পৃথিবীজুড়ে, তা–ও হতে পারে। তবে এবার গরুর সঙ্গে এন নাইনটি ফাইভ মাস্ক, পিপিই ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ফ্রি থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
গরু কেনার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা কিছুটা কম থাকায় প্রতিবছরের মতো এবার গ্রাম সম্পর্কের ফুফাকে তলব করা হলো। ফুফার নাম লাল মিয়া। স্বল্প মূল্যে সুস্থ সবল ও তরতাজা গরু কেনার মতো অসম্ভবকে সম্ভব করাই তাঁর কাজ। দেখতে অনেকটাই বলিউডের জনি লিভারের মতো। গলায় শীত গ্রীষ্ম বারো মাসই মাফলার পেঁচিয়ে রাখেন। শুনেছি, গরু সম্পর্কে তাঁর নাকি রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। একসময় তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপকের সঙ্গে সহকারী হিসেবে ছিলেন। গ্রামে টুকটাক পল্লি পশুচিকিৎসক হিসেবেও তিনি পশুদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও আড়ালে লোকজন তাঁকে গরুর ডাক্তার বলে ডাকে। তবে এতে তিনি বিরক্ত হন না। গর্ব অনুভব করেন। তাঁর বেশির ভাগ কাহিনিই পশুসংক্রান্ত। তাঁর সঙ্গে বেশি সময় কথা বলি না, নিজেকে কেমন জানি পশু পশু মনে হয়। বাসায় আসার পর তাঁকে সালাম দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ফুফা শরীর কেমন? ফুফা বললেন, ‘আর বইলো না প্রেশারটা একটু বাড়ছে, কী করমু কও, গরুগুলা আজকাল বেজায় বজ্জাত হইছে, কথা শুনে না। এর ওপর লালু আবার খুরা রোগে আক্রান্ত।’ লালুটা কে ফুফা? ‘আরে লাল গরুটা, ওরে আদর কইরা লালু ডাকি।’ ও, আচ্ছা। আমি আর কথা বাড়ালাম না। দেখি ফুফা অনবরত বলেই চলেছেন, ‘শোন মিয়া, হাটে বিক্রির জন্য আসা এত গরুর মধ্যে অনেকগুলোই থাকতে পারে রোগাক্রান্ত অথবা ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ওষুধযুক্ত।’
এসবের মধ্য থেকে কোরবানিযোগ্য সুস্থ গরু চেনার উপায় কী? আমি বললাম, কী উপায় ফুফা? আবেগে ফুফার চোখ চকচক করে উঠল। অনর্গল বলেই চললেন, স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গরু দেখতে আকর্ষণীয়, চকচকে ও হৃষ্টপুষ্ট দেখালেও আসলে সেগুলো মোটাতাজা হয় না। বরং এসব ক্ষতিকর উপাদান রান্নার পরও মাংসে থেকে যাওয়ায়, সেটা খেলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ভালো দাম পাওয়ার আশায় প্রতিবছর কোরবানির ঈদ সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা কয়েক সপ্তাহ আগেই গরু মোটা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও রাসায়নিক মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করেন। এতে গরুর শরীরে অতিরিক্ত পানি জমতে শুরু করে। এতে গরুটির কিডনি, ফুসফুস, পাকস্থলী ও যকৃত নষ্ট হতে থাকে এবং গরুটি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে যায়।
এ ছাড়া অনেক গরু খুরা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। সুস্থ গরুর দেহের তাপমাত্রা ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয়।
এ ছাড়া খুড়া রোগাক্রান্ত গরুর ক্ষুর ও মুখে ঘা থাকতে পারে, আক্রান্ত গরু খুঁড়িয়ে হাঁটবে এবং খাবার খেতে চাইবে না বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া অনেক গরু কৃমিতে আক্রান্ত হতে পারে। এ ধরনের গরু বেশ বিবর্ণ ও হাড় জিরজিরে হয়।
সুস্থ ও অসুস্থ গরু শনাক্তের উপায় কী ফুফা?
এ বিষয়ে কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
১. রাসায়নিক বা ওষুধ দেওয়া গরুর মাংসপেশি থেকে শুরু করে শরীরের অন্য অঙ্গগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলে থাকে।
২. শরীরে পানি জমায় বিভিন্ন অংশে চাপ দিলে সেখানে গর্ত হয়ে দেবে যাবে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেবে।
৩. অতিরিক্ত ওজনের কারণে এসব গরু চলাফেরা বা স্বাভাবিক নড়াচড়া করতে পারে না। শান্ত থাকে।
৪. রাসায়নিকযুক্ত গরু ভীষণ ক্লান্ত থাকবে এবং ঝিমাবে। সুস্থ গরুর গতিবিধি চটপটে থাকে। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বুঝে প্রতিক্রিয়া দেখায়। কান ও লেজ দিয়ে মশা মাছি তাড়ায়।
৫. রাসায়নিক বা ওষুধ খাওয়ানো গরুর শরীরের অঙ্গগুলো নষ্ট হতে শুরু করায় এগুলোর শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়। মনে হবে যেন হাঁপাচ্ছে।
৬. অতিরিক্ত স্টেরয়েড দেওয়া গরুর মুখ থেকে প্রতিনিয়ত লালা ঝরবে। কিছু খেতে চাইবে না। সুস্থ গরুর মুখের সামনে খাবার ধরলে সেটা টেনে খাবে। না হলে জাবর কাটবে।
৭. সুস্থ গরুর নাকের ওপরের অংশটা ভেজা বা বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা থাকবে। অন্যদিকে অসুস্থ গরুর নাক থাকবে শুকনা।
৮. সুস্থ গরুর শরীরের রং উজ্জ্বল থাকবে। গরুর পিঠের কুঁজ মোটা, টানটান ও দাগমুক্ত হবে।
৯. সুস্থ গরুর রানের মাংস শক্ত থাকবে। যেখানে রাসায়নিক দেওয়া গরুর পা হবে নরম থলথলে।
১০. গরুর শরীরে হাত দিয়ে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মনে হলে বুঝতে হবে গরুটি অসুস্থ।
১১. সুস্থ গরুর চামড়ার ওপর দিয়ে কয়েকটা পাঁজরের হাড় বোঝা যাবে।
শোন মিয়া, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করার গরুগুলো অনেক সময় কেনার পর কোরবানির অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে দেশি গরু কেনার পরামর্শ দেন তিনি। কেননা, চাইলেও দেশ গরু বেশি মোটাতাজা করা সম্ভব নয়।
কোরবানির জন্য কোন পশুটি উপযুক্ত, তা জেনে নেওয়া খুবই জরুরি।
১.
গরুর বয়স ন্যূনতম দুই বছর হলেই এটা কোরবানির জন্য উপযুক্ত হবে। এ ক্ষেত্রে গরুর দাঁত দেখে বয়স যাচাই করে নিতে হবে। গরুর নিচের পাটিতে যদি দুধদাঁতের পাশাপাশি সামনে অন্তত দুটি কোদালের মতো স্থায়ী দাঁত থাকে, তাহলে বুঝতে হবে গরুটি কোরবানির উপযুক্ত হয়েছে।
২.
গরুটিকে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে হবে। এ জন্য শিং ভাঙা, লেজ কাটা কিংবা মুখ, জিহ্বা, শরীর, পা, ক্ষুর, গোড়ালিতে কোনো ক্ষত আছে কি না, দেখে নিতে হবে।
৩.
গাভি কোরবানি দেওয়া গেলেও তার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হবে যে গাভিটি গর্ভবতী কি না। গর্ভবতী গাভি কোনো অবস্থাতেই কোরবানি দেওয়া যাবে না। সাধারণত গর্ভবতী গাভির পেট ও ওলান স্ফীত থাকে।
দক্ষ পশু ক্রেতারা দিনের আলো থাকতে থাকতেই গরু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, রাতের বেলা গরুর এতগুলো বিষয় ঠিকঠাক যাচাই করা সম্ভব না–ও হতে পারে। (সুস্থ ও অসুস্থ গরু চেনার পদ্ধতিসংক্রান্ত তথ্যগুলো সংগৃহীত)।
গরু বিষয়ে ফুফার সমুদ্রসম জ্ঞান দেখে একদিকে যেমনি বিস্মিত, অন্যদিকে অত্যন্ত গর্বিত। ফুফাকে এবার আমি কদমবুচি করতে বাধ্য হলাম। ফুফাকে ফেসবুক লাইভে গরু কেনার বিষয়ে বলতেই ফুফা ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, ‘কী কও মিয়া, গরুর পশ্চাৎদেশে দু–তিনটা থাপ্পড় না মারলে গরু সম্পর্কে তোমার ধারণা হইব কেমনে?’ ফুফাকে পেয়ে ইতিমধ্যে আমার স্ত্রীও ভীষণ খুশি। সে বলল, যাক গরু কেনার চিন্তাটা এবার মাথা থেকে গেল।
ইতিমধ্যে ব্লক উঠে যাওয়ায় আমিও যারপরনাই খুশি। অবশেষে ফুফাকে নিয়ে গরুর হাটে গিয়ে সবচেয়ে হৃষ্টপুষ্ট গরুটা কিনে আনলাম। গরুর হাট থেকে বের হওয়ার সময় দেখলাম অসংখ্য আবালবৃদ্ধবনিতা আমাদের ঘিরে ধরে সেলফি তুলছে। মাঝখানে গরু, ডানদিকে আমি, আর বাঁয়ে ফুফা। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ফুফা আবার তাঁর আঙুল দুটি ‘ভি’–এর মতো করে রেখেছে। যেন মিয়ানমারের কাছ থেকে দীর্ঘ বাগ্‌বিতণ্ডার পর আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্রসীমা জয় করে বাড়ি ফিরছেন। আমি ফুফার এই অদ্ভুত ছেলেমানুষি আচরণে বিস্মিত। ইচ্ছা করছে গরুর গলা থেকে মালা খুলে নিয়ে ফুফার গলায় পরিয়ে দিই।
গরু নিয়ে বাসায় ফেরার পর স্ত্রীর খুশি দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে মোশাররফ করিমের মতো আবেগে কাইন্দালচি। মনে হচ্ছে গরুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণের জন্য ইমরান হাশমি হয়ে যাই। যাহোক, ফ্রেশ হয়ে, চুলে জেল লাগিয়ে, ব্র্যান্ডের টি–শার্টখানা গায়ে গলিয়ে মুঠোফোনে ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা ওপেন করে গরুর সঙ্গে দিলাম একটি সেলফি মেরে। আপলোড করার সঙ্গে সঙ্গেই ৩০০ লাইক আর ৭৮টি লাভ রিঅ্যাক্ট। চাকরি পাওয়ার সময়ও আমি এত খুশি হই নাই। আমার এত্ত খুশি লাগে ক্যারে। অতিরিক্ত ক্লান্তি থাকায় দিনের বেলায় নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়ি এবং মুহূর্তে দিবাস্বপ্ন দেখতে থাকি। দেখি পলা (স্ত্রী) হালকা আঁচে চালের গুঁড়োর আটা দিয়ে পাতলা ধরনের রুটি বানাচ্ছে আর পাশের উনোনে রান্না হচ্ছে হালকা মসলা দিয়ে গরুর কালোভুনা। নেহারিটাও প্রায় হয়ে এল বলে। খেজুরগুড়ের পায়েশগুলো আমাকে ইশারায় শিষ দিয়ে ডাকছে। আমিও খাবারের চারপাশে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত আকারে ঘোরাফেরা করছি। জিব দিয়ে জল গড়িয়ে টি–শার্টে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমটা ভেঙে গেল। ফেসবুক ওপেন করতেই আমার তো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আবার ব্লক।
কে আমার এই সর্বনাশ করল? দেখি গরুর সঙ্গে যে সেলফি তুলে পোস্ট দিয়েছিলাম তাতে অসংখ্য নারী জাতির কমেন্টস। নীল পরি অনন্যা নামে একজন কমেন্ট করেছে, ভাইয়া, ইউ অ্যান্ড দ্য কাউ বোথ আর লুকিং সো কিউট, আরেক বজ্জাত নারী কমেন্ট করেছে, গরু এবং আপনাকে অনেক স্মার্ট লাগছে, দুজনের জন্যই ভালোবাসা অবিরাম। হায়! হায়! কী সর্বনাশ। একটু পরেই মুঠোফোনে মেসেজ এল, তুমি তোমার নীল পরি আর কিউট গরুর সঙ্গেই এবার এর ঈদটা পালন করো, আমি চল্লাম বাপের বাড়ি।
এদিকে পাশের রুম থেকে টিভিতে উচ্চস্বরে ভেসে আসছে সেই চিরচেনা বিজ্ঞাপন, ভাইসাব খবর একখান, খবর একখান, দেরি হইয়া যায়, আতর লাগায় ঈদের নামাজ পরিও হালায়, ভাইসাব খবর একখান, এক বছরে দুইখান খুশি, আমরা মুসলমান, একখান হইলো রমজানের ঈদ আরেকখান কোরবান, ভাইসাব...খান।
মনে মনে ভাবি, এইবারও বোধ হয় আমার গরুর কালোভুনা আর মিহি চালের আটার রুটি কপালে জুটল না। সেই মুহূর্তে মেসেঞ্জারে ইনবক্সে ট্রিং শব্দে মেসেজ আসে, কিছুটা আশান্বিত হয়ে ইনবক্স ওপেন করে দেখি, এক আইডি থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে, যার নাম হলো ‘ছিল্লা লবণ লাগাইয়া দিমু’, মেসেজ বার্তায় লিখেছে—ভাইজান বেলা দুইটার আগেই আপনার চামড়াটা রেডি রাইখেন, কালা কুদ্দুইচ্যা আইবো চামড়া কালেক্ট করতে। আমার কপালে ও নাকে তখন সুস্থ গরুর মতোই বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।