করোনা ডে-১

আজ আমার পেশেন্ট আসছে—সে তার সব ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, অ্যালার্জির ভয়ে। বললাম শুরু করতে! বলে তুমি যখন কথা বলো, আমি ভাবি গড সামনে। যেভাবে বলবা, শুরু করব।

মনে মনে ভাবি, কতগুলো ফ্লার্ট বয়সকালে একসময় দেবী বলত! সেটা পাত্তা দিইনি। তবে এর কথা পছন্দ হয়েছে।

পরের জন আসে কয়েক দিন পরপর! স্পেশালিস্টে বিশ্বাস নেই, আমাকে তার স্পেশালিস্টের ওষুধ বলে খাওয়াতে হয়! সেও যাওয়ার আগে বলে, বলে দাও কীভাবে খেতে হবে।
আবার কেউ আসে অন্যায় আবদার নিয়ে, তাদেরও ভদ্রভাবে না বলতে হয়।
তারপর আসে ১০ বছরের ছেলে। তাকে কোভিড টেস্ট করাতে হবে। ফ্লোরিডা গেছিল। মা গাড়িতে বসা। সে সুন্দর করে তার হিস্ট্রি দিল! বুঝিয়ে বললাম কী করতে হবে। কোভিড পজিটিভ! হি টুক রেজাল্ট ইজি। পরে মাকে ডেকে আবার বুঝিয়ে দিলাম কী করবে, কী না করবে।

ইদানীং সবাই স্ট্রেসড আউট! হসপিটালগুলো করোনা রোগী দিয়ে ভরে আছে!

কয়েক দিন আমার মাইল্ড ড্রাই কাশি, মাথাব্যথা, টায়ার্ড লাগছে। যেহেতু প্রায় রাতেই ঘুম হচ্ছে না, আমি স্বাভাবিক ভাবছি। তারপরও মনে কু ডাকে। দেখছি কোভিড, ননকোভিড সব!

কাজের জায়গায় এক মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট অনুপস্থিত! দুজন আমার সঙ্গে ক্লোজ হয়ে কাজ করে। একজন জানাল, সে পজিটিভ। আমি আর আমার এমএও একটু কনজেনস্টেড। আমি টেস্ট করলাম, নেগেটিভ, মাথাব্যথা যাচ্ছে না। কাজে গেলাম! আমার এমএ পজিটিভ। আজ আমাদের কারও জ্বর নেই। যেহেতু আমার শরীর ভালো লাগছে না! অফিস ম্যানেজার বলে, আরেকবার টেস্ট করো। করলাম, এবার আর নেগেটিভ নয়! কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকে এটি আমার কোভিডের চার নম্বর টেস্ট। ভাগ্যিস করেছিলাম। সিম্পটম খারাপ না, জ্বর নেই! জ্বর ভাব আছে, মাইল্ড শুকনা কাশি আর ক্ষণে ক্ষণে মাথাব্যথা।

টেনশন লাগছে বাচ্চাদের জন্য! আজও ওদের সঙ্গে লাঞ্চ করেছি। স্পেশালি ছেলের কাছাকাছি ছিলাম! হাতের কাজ শেষ করে বাসায় এলাম! আসার আগেই ছেলের বাপকে বললাম, রেজাল্ট পজিটিভ! এই লোক আমার কোনো পজিটিভ রেজাল্ট পছন্দ করে না, প্রেগনেন্সি টেস্ট হলেও!

এসেই স্ট্যাটাস মারলাম! ভুলে গেছি, আমার চৌদ্দগুষ্টি সেখানে। মা–বাবার সঙ্গে কথা বলার পর তারাও আবার ফোন দিয়ে স্ট্যাটাসের শানে নুজুল জানতে চায়। বললাম পজিটিভ। নাহ, এরাও পজিটিভে খুশি না!

ছেলের বাপকে বললাম, মানে অপশন দিলাম, ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি ভেকেশনে যেতে পারে! ওর মা, কোভিড এক্সপোজার জানলে ঘরে তুলবে না, সেই লজ্জাই হয়তো শ্বশুরবাড়িও যাবে না! আসলে সেটা না! বাসায় থেকে আমাকে না খাইয়ে, অযত্নে শুকিয়ে মারার চান্স হাতছাড়া করতে রাজি না। মুখে বলে, তোমার সেবা কে করবে গেলে?

আমিও কম না! খুব পাট নিলাম যে কত খুশি হইছি! বলিনি, বাপের বাড়ি যাওয়ার নিমন্ত্রণ আমার আছে, খালি তেড়িবেড়ি করলেই চলে যাব!
মেয়ে দেখি লেবু হানির চা বানায়ে আনছে! এই মেয়েটা অসুস্থ হলে আমি উঁকি দিয়ে দেখারও সময় পাই না। মেয়ের বাপ বলে, স্যুপ খাবে?
আমিও বলি, বানাবে?

বলে, না, অর্ডার দেব, আর কী অর্ডার দেব? বললাম যা মনে চায়, নাহ, সে ঠিক করতে পারে না। বলে দিলাম কী কী আনবে। সেই খাবার দিয়ে যাওয়ার পর থেকে লাপাত্তা!

লেখক
লেখক

আমার যে একলা ঘুম আসে না, সে সেটা জানে! সমস্যা তো আরও আছে! সে এটাও জানে যে সে পাশে ঘুমালেও আমি ঘুমাই না, তাই বলে আমার ইমোশনের কোনো পাত্তা দেবে না? আমি যে বলি, তার কিছু হলে, আমার জন্য যেন একজন খুঁজে রেখে যায়, আমি কি এমনি এমনি বলি? হয়তো ভাবে ঠাট্টা করি! দেখি যদি ঘুমাতে না পারি, বিড়ালের মতো আমিও তাকে অতিষ্ঠ করে তুলব মাঝরাতে। কিন্তু সে কি আমার পিছু পিছু ঘুরবে, না আমাকে উল্টা করে ঘুরিয়ে ফেরত পাঠাবে? না থাক দূরেই থাকুক, আপাতত ভালো থাকুক!

এর মাঝে বান্ধবী বলে, সিম্পটমেটিক ট্রিটমেন্ট নিতে আর দোয়া–দরুদ পড়তে! জানায়ে দিলাম, গেলে তো গেলামই, আর কত!

নাহ, চান্স নেওয়া যাবে না। একটা বেনাড্রিল খেয়ে নিই! সিম্পটম খারাপ হওয়ার আগেই তার চিকিৎসা করি। আবার হাই রিস্ক অ্যাজমা থাকায়। এর মাঝেই দু–একজন, যাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, তাদের নিজেদের মনিটর করতে বলে দিলাম আর বলে দিলাম বাসায় না আসতে পরবর্তী দুই সপ্তাহ! চলবে...।

*লেখক: চিকিৎসক