আয়নায় নিজের মুখ-৩

কথা হচ্ছিল ৭৮ বছর বয়সী তরুণ নারী মরনা এ্যাদামের সঙ্গে। মরনার জন্ম কানাডার শীতপ্রধান জায়গা নোভাস্কশিয়াতে। ভীষণ শীত নাকি ওই সব অঞ্চলে, মরনা গল্প করে কখনো কখনো ওর জন্মের শহরের। কিন্তু অন্টারিও প্রভিন্সের টরন্টোতে মরনা মুভ করে চলে আসে, ওর বয়স যখন ২৭। এক জীবনে শুধু কাজই করে যাচ্ছে মরনা। দীর্ঘ জীবন স্কুলশিক্ষক ছিলেন, অবসরে যাওয়ার পরে থেকে কমিউনিটির হাজারো কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন, তাই ৭৮ বছর বয়সেও মরনাকে তরুণী লিখতে আমার কোনো কষ্ট হয় না।

বর্তমানে টরন্টোর ব্রাম্পটন এলাকায় সিনিয়র সিটিজেন অ্যান্ড হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট মরনা। সারা দিন লাগাতার মিটিং থাকে ওর, এসব নানা কাজের সূত্র ধরেই মরনার সঙ্গে আমার অফিস কষ্টির পরিচয়, আর সেই সূত্রে গত চার বছরে আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা।

মরনাকে আমি খুব কাছে থেকে দেখি বা বলা চলে নিরিখ করি। সংসারে কত বিচিত্র মানুষ থাকে আর প্রতিটি মানুষের থাকে আলাদা জীবনযাপন। আরও একটা কথা বলা যায় এ প্রসঙ্গে যত বড় পৃথিবীই হোক আর যত বিচিত্র মানুষ-ই হোক—প্রতিটা মানুষ খুঁজে পায় তার সমমনা মানুষকে। এই এক জীবনেই তা পেয়ে যায় সে, মানুষের ব্যাপারে কি কথাটা খাটে, যেমন খাটে পাখির ক্ষেত্রে? পাখি ঝাঁকে মেশে। তেমনি মানুষ কি ঝাঁকে মেশে? এই শহরেরই আরও একজন নারী, যিনি নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন। তিনি বলেছিলেন আমাকে—বুঝলি লুনা, পাখি ঝাঁকে মেশে, মানুষও কিন্তু অনেকটা তাই, তুই যা যা খুঁজে ফিরিস, যা যা শুনতে চাস, যা যা শুনলে বা জানলে তোর নিজের জীবনের এই বহমান বোঝা তোর কাছে একটু হালকা লাগবে, দেখবি মনের অজান্তে সেসব ইস্যু আসবে তোর সামনে ঘুরে ঘুরে। কত কথা বলেছি আপার সঙ্গে, কিন্তু এই কথাটা কেমন করে গেঁথে আছে মনের গহিনে। মরনাও আমার মতো নিঃসঙ্গ মানুষ—দীর্ঘ জীবন একা পথ চলেছে মরনা।

সেই মরনার সঙ্গে বসে গতকাল দুপুরে লাঞ্চ করছিলাম। মরনা যেহেতু আমাদের অফিসের কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাই সহজেই অফিস আওয়ারে ওর সঙ্গে মিটিংয়ের কথা বলে দেখা করা যায়। হয়তো দশ মিনিটের কাজ কিন্তু আমরা পার করি ১ ঘণ্টা। গতকাল মরনা আলাপ করছিল কানাডার নতুন সরকার নিয়ে, লিবারেল পার্টি নিয়ে। ও নিজে লিবারেল পার্টির হয়ে কাজ করছে অনেক বছর। নিজের সঞ্চিত ডলার ঢালছে এই কাজে, মরনাকে একটু কাহিল মনে হচ্ছিল বা বয়সের ভারে একটু ন্যুব্জ? ও বলে, দেখো মাহমুদা, নতুন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর বাবা পিয়েরে ট্রুডো বহু বহু বছর আগে কানাডায় অভিবাসীদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছিলেন, তিনি মনে করতেন, যেহেতু কানাডিয়ানরা বাচ্চা নেয় না বা এই দেশে মানুষ কম, তাই তিনি সারা পৃথিবীর মানুষকে আহ্বান করেছিলেন কানাডায় এসে বসতি গড়ার জন্য। আজকের আধুনিক কানাডা বা এই মাল্টিকালচারাল কানাডা গড়ে ওঠার পেছনে কিন্তু পিয়েরে ট্রুডোর ভূমিকা অনেক। আর আজ সেই পিয়েরের ছেলে জাস্টিন ট্রুডো নতুন প্রধানমন্ত্রী। তার কাছে আমাদের অনেক আশা। আমি বলি, মরনা, তোমার কি মনে হয় এখনো কানাডা সরকারের উচিত নতুন অভিবাসীদের আহ্বান করা? নিশ্চয় করা উচিত, এখনো এই দেশের ৩ ভাগ রিসোর্স আবিষ্কার করা হয়নি, কত বেশি মানুষ দরকার এ দেশে কাজ করার জন্য, কীভাবে মানুষ ছাড়া এসব কাজ হবে বলো।

আমার মন পড়ে থাকে আমার দেশে, আহা আমার দেশের কত কত মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করে, বিদেশে আসার জন্য বা শুধু কানাডার মতো দেশে আসার জন্য হেন কোনো কাজ নেই যা দেশের মানুষ করতে পারে না, আমি খুব কাছে থেকে, একদম নিজের জীবন দিয়ে এই ঘটনার সাক্ষী বলে এমন সব কথা শুনলে নিজের চোখের পানি রাখতে পারি না। শুধু মনে হয়, কবে এই কানাডা/বাংলাদেশের পথ একটু সহজ হবে? কবে আমার দেশের মানুষ চাইলেই কানাডায় এসে নিজের রুটি–রুজি করতে পারবে? নিজের পরিবারের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারবে? মরনা জানে, নেই নেই করেও এখনো কানাডায় যেসব সুবিধা একজন নাগরিককে দেওয়া হয়, তা পৃথিবীর কোনো দেশ-ই দেয় না। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা, কতখানি বড়লোক একটা দেশ হতে পারে, সে সম্পর্কে সামান্য আইডিয়া করাও এক অসাধ্য সাধন করা। মরনার কথা শুনতে শুনতে আমি যে কখন মনের পথ দিয়ে ১৭ হাজার মাইল পার করেছি মনে নেই, কিন্তু আবার ওর কথাতেই ফিরে আসি, বুঝতে পারি এটা ব্রাম্পটন, এটা কানাডা, আমি অফিসের কাজের আওয়ারের ভেতরে আছি, কানাডিয়ান সিটিজেন, আমাকে কানাডার সুখ–দুঃখের সঙ্গী হতে হবে। ১৫ বছর ধরে কেবলই দেশে ফিরে যাই আমি, সেটা কমাতে হবে। মরনা বলে ওঠে আবার, কিন্তু জানো তো মাহমুদা, এই দেশে যারা অভিবাসী হয়ে আসে, বিশেষ করে সাউথ এশিয়ান, তারা অনেকেই এ দেশে উপার্জন করে থাকে খায়। কিন্তু ডলার জমায় নিজের দেশে, তারা সারা জীবন এ দেশে থেকেও এ দেশের মানুষ হয়ে ওঠে না—এই জায়গায় আমাদের নতুন সরকারকে কিছু একটা করতে হবে। এটা কেমন কথা বলো? তুমি কানাডায় থাকবে কিন্তু তোমার মন পড়ে থাকবে দেশে, তাহলে কি করে সার্ভ করবে এই দেশে তুমি? আমি ভাবি, মরনা কি আয়নায় নিজেকে না দেখে আমাকে দেখে ফেলল?