লকডাউন জীবনে দু'টি ঈদ

করোনা নামের একটা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে চীনে নাকি মানুষ মরছে। খবরটা শুনে কিছুটা বিস্মিত হলাম। আমরা যেখানে থাকি সেখানে চীনের মানুষ জনই বেশি। তাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হয়। দিন যাচ্ছে আর করোনা বিষয়ে আলোচনা বাড়ছে। আরও কয়েকটা দিন পর জানতে পারি সিঙ্গাপুরেও করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হলো। যারা আক্রান্ত হলেন, সবাই চীনের মানুষ। আমরা চায়নাদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি। শোনলাম সিঙ্গাপুর টু চীনের আকাশ পথ বন্ধ করা হয়েছে। সে সময় ৩০/৪০ জন রোগী শনাক্ত ছিল।

আমাদের সঙ্গে কয়েকজন বাঙালি কোম্পানির মালিকের কাছে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। মালিক অনুমতি দিলেন না। শেষ পর্যন্ত মালিকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করে তারা বাংলাদেশে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার পর নিজেই কিছুটা ভাবনায় পড়ি। না জানি আমাদের কি হয়? একটা সংশয়ের মধ্যে ছিলাম। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরে করোনা রোগী সংখ্যা বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাঙালিও আক্রান্ত হচ্ছে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ৭ এপ্রিল ‘সার্কিট ব্রেকার’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। আমাদের (অভিবাসী) জায়গা হয় ডরমিটরিতে। বাইরে যাওয়া যাবে না। সে সময় প্রতিনিয়ত আক্রান্ত রোগী ছিল প্রায় এক শ জনের মতো। মোট আক্রান্তকারী ছিল হাজারের মতো। তবে অভিবাসীদের আটকা পরার পর থেকে করোনা রোগী সংখ্যা বাড়তে থাকে।

৯ এপ্রিল ২০২০
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানতে পারি, আমাদের বিনা মূল্যে খাবার ও চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হবে। যথারীতি খাবারও আসতে থাকে। এমনকি কয়েক দিন পর জানা যায়, আমরা যারা ঘরবন্দী আছি, তাদের সকলকে বেসিক বেতন দেওয়া হবে। এই খবরটা পেয়ে আমরা সিঙ্গাপুর প্রবাসী ঘরবন্দী মানুষ গুলো বেশ খুশি হয়েছিলাম।

৩ মে ২০২০
বিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিঙ্গাপুরে প্রথম বাংলাদেশি এক ভাই মারা গেলেন। এতে আমরা প্রবাসী বাঙালি শঙ্কিত হয়ে পড়ি। সিঙ্গাপুরে করোনা আক্রান্তকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৪৪৭ জনে। এর কয়েক দিন পর আমার পাশের রুমে এক সঙ্গে চারজন আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে দু'জন বাঙালিও ছিল।

৪ মে ২০২০
সিঙ্গাপুরে করোনা আক্রান্তকারীর মাঝে ৯০ ভাগই অভিবাসী শ্রমিক। অভিবাসীদের মাঝে করোনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায়, এ দেশের সরকার ও বিভিন্ন এনজিও তাদের পাশে দাঁড়ায়। এবং পূর্ব ঘোষিত 'সার্কিট ব্রেকার' অব্যাহত রাখে।

২৪ মে ২০২০
আমরা ১২ বাংলাদেশি এক সঙ্গে, রুমের মধ্যে ঈদুল ফিতরের নামাজ জামায়াতে আদায় করি। ঈদের আনন্দ বলতে প্রিয় জনদের সঙ্গে কথোপকথনে নিজেকে জড়িয়ে রাখা। বন্দী জীবনের ঈদ, কখনো নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আনন্দের দিন হলেও কেন জানি, বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট অনুভব করি।

২০ মে ২০২০
'সার্কিট ব্রেকার' আনুষ্ঠানিক ভাবে ১ জুন শেষ হবে। মঙ্গলবার (১৯ মে) কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের মাল্টি-মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের মাধ্যমে জানা যায়, সিঙ্গাপুরে তিন ধাপে অর্থনীতি আবার চালু হবে।

৮ জুন ২০২০
সিঙ্গাপুরে গত ১ জুন 'সার্কিট ব্রেকার' শেষ হলেও আমাদের মুক্তি মেলেনি। কেননা করোনা রোগীর সংখ্যা কমলেও আজ ৩৮৬ জন আক্রান্ত হয়। মোট আক্রান্তকারী ৩৮ হাজার ২৯৬ জন। মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। সুস্থ হয়েছেন ২৫ হাজার ৩৬৮ জন।

২৩ জুলাই ২০২০
দেখতে দেখতে ঈদুল আজহার চাঁদ আকাশে উঁকি দিল। আগামী ৩১ জুলাই সিঙ্গাপুরে কোরবানি ঈদ উদ্‌যাপিত হবে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস গৃহবন্দী অবস্থাতে দুইটি ঈদ কেটে যাবে। করোনার কাছে বিশ্ব আজ অসহায়। আমাদের আনন্দগুলো করোনা ছিনিয়ে নিল। প্রায় চার মাস হতে চলল, মুক্ত আকাশের নিচে হাঁটি না। পাখা মেলে পাখির উড়ে যাওয়া দেখি না। মুক্ত বাতাসের ছোঁয়া কত দিন অনুভব করি না। জানি না আর কত দিন এভাবে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হবে। আজও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩৪৫ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্ত ৪৯ হাজার ৯৮ জন, মৃত্যু ২৭ জন এবং সুস্থ ৪৪ হাজার ৭৯৫ জন।

আমরা ১২ বাংলাদেশি এক সঙ্গে, একই ঘরে রাত দিন যাপন করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত প্রকৃতির অশেষ মেহেরবানীতে আমাদের কারও কোনো সমস্যা হয়নি। আর যেন না হয় এই প্রত্যাশা।