উপসংহার

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

হে বন্ধু,

আজ সূচনা নয়, শুধু উপসংহারের কথা বলছি। তোমার অদম্য ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় চাইছি যেন আমার কথাগুলো তুমি অনুধাবন করতে পার। তাহলে বুঝব তোমাকে একটু হলেও ভাবাতে পেরেছি। মনে পড়ে একদিন তুমি আমায় বলেছিলে, তোমরা যারা গবেষণা কর তাদের কাছে উপসংহার বলে কিছু নেই। তোমাদের গবেষণার একটা বিশেষ লক্ষ্য থাকে আর তা বাস্তবায়নের জন্য তোমরা সদা উদ্‌গ্রীব। তাই সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যতটুকু জ্ঞান আর ক্ষমতা দিয়েছেন তা দিয়ে মানুষ বিজ্ঞানকে উন্মোচন করে চলেছে বিরামহীনভাবে আর অগ্রগামী হচ্ছে প্রগতির পথে। জানি যে দিন থেকে তুমি এই বিষয়কে উপলব্ধি করতে পেরেছিলে সেদিন থেকেই তোমার কাজের স্পৃহা অনেক বেড়ে গেছে। তুমি বলেছিলে কাজের আর জীবনের কোনো উপসংহার হয় না। মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তাঁর কাজ রয়ে যায়, অন্য আরেকজন সেখান থেকে শুরু করে নতুন যাত্রা। তোমার সেসব দিনের কথা আজও ভুলিনি। তবে কি জানো, আজ আমি তোমার মতো করে ভাবতে পারছি না। আমি খুব অনুতপ্ত, ক্ষতবিক্ষত আর শঙ্কিত। আমি সময়ের সঙ্গে অবিরাম লড়াই করা এক যোদ্ধা। যেখান থেকেই শুরু হোক না কেন এই বিজ্ঞান আর মানব ইতিহাস, মানুষের অপকর্মের জন্য যে সভ্যতা কলঙ্কিত আর পঙ্কিল হয়ে যায় আমি তার উপসংহারের জন্য বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছি। অন্যায়ের পরিমণ্ডলে আমাদের জীবন আজ এমনই জর্জরিত যে-তা থেকে আমদের মুক্তির পথ আর খোলা নাই। তাই অন্যায়ের উপসংহারের স্লোগানে আজ আমি পথে নেমেছি।

আমার বেঁচে থাকাটাই একটি বিস্ময়! আমি জীবনে ঘটে যাওয়া যেসব অন্যায় প্রত্যক্ষ করেছি তা আর কিছু নয়, পুরোনো গল্প শুধু নতুন করে বলা মাত্র। আমার মায়ের রোগের ভুল রেজাল্ট দিয়েছিল এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তাঁর ওপর ভিত্তি করে ভুল চিকিৎসা হলো বহুদিন। দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে অকালে নীরবে চিরতরে চলে গেলেন তিনি। আমার সত্যবাদী বাবাকে জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেন তিনি কারণ দুর্নীতির সঙ্গে আপশ করে অন্যায় কাজে যুক্ত হয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করতে রাজি হননি বলে। কেউ কি জানে এই অপমান সহ্য করতে না পেরে তিনি এখন কেমন আছেন? আমার ভাই একজন মেধাবী ছাত্র ছিল। দুর্নীতি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার মসী ছিল বরাবরই সোচ্চার, তাই তাকে একদিন জীবনের মূল্য দিয়ে তা পরিশোধ করতে হয়েছে। আমার বোন উচ্ছল প্রাণের এক সম্ভাবনাময় নক্ষত্র! তার জীবনকেও কেড়ে নেয় হায়েনারা ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে, রাতের অন্ধকারে। নিজের সম্মানটুকু নিয়ে বাঁচার জন্য চিৎকার করেছিল, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি বাঁচাতে। আমার জীবনও পদে পদে হুমকির সম্মুখীন, কারণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি শুধু বিচারের দাবি জানিয়েছি বলে। শুধু আমি একা না, আমার মতো আরও অনেকেই আছে যারা অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার। তুমি কি তাদের একজনেরও আর্তনাদ শুনতে পাওনি? আমাদের দাবি আজ অসহায় হয়ে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। কার কাছে বিচারের প্রত্যাশা করব?

শিক্ষাব্যবস্থা আছে কিন্তু তা সুশিক্ষিত মানুষ গড়তে সহায়ক না। যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাতি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবে, সেই মেরুদণ্ডকেই তো ভঙ্গুর করে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিবিদের কথা আর কাজের না আছে কোনো স্বচ্ছতা না আছে কোনো প্রতিফলন। অযোগ্য ব্যক্তিরা নেতৃত্বের ভারে ভারাক্রান্ত। কত সহজেই জনগণের দায়ভারের ও তাদের কাছে জবাবদিহিকে এড়িয়ে চলেন তারা! যোগ্য লোক কাজের মূল্য পায় না। নাম, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত অর্জন করে রাতারাতি কিছু করে ফেলার অসম প্রতিযোগিতা চলছে। দুর্নীতি, মিথ্যাচার, হঠকারিতা আর সাধারণ মানুষকে শোষণ করে অর্থ উপার্জনের পথ এখানে খুব সহজ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতা, নৈতিকতা হারিয়ে এমন একপর্যায়ে নেমে গেছে যে মানুষ এখন করোনা পরিস্থিতিকে নিয়েও ব্যবসা করতে দ্বিধা বোধ করে না। হায়! ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করার বাণিজ্য চলে এ দেশে! কোথায় যাবে এই দেশের সাধারণ মানুষ? বলতে পারো কোথায় তাদের মুক্তির পথ?

বন্ধু, তুমি আমায় বলেছিলে যে, তোমরা গবেষণায় ক্যানসার সেল -এর মধ্যে অনেক জিনের এক্সপ্রেশন পর্যবেক্ষণ করো; আরএনএ (RNA) এবং প্রোটিন (Protein) লেভেলে তাদের অস্তিত্ব নির্ণয় করো। এরপর নির্দিষ্ট প্রোটিনের কার্যকারিতা খুঁজে বের করো; উন্মোচন করো কীভাবে তা ক্যানসারের বৃদ্ধি আর বিস্তারের সঙ্গে জড়িত। তোমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্যই প্রোটিনের কার্যকারিতা ভালোভাবে বোঝা, যাতে এই গবেষণা দারা একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী বায়োমার্কার (Biomarker) উদ্ভাবন করা যায় যা দিয়ে অতি দ্রুততার সঙ্গে ক্যানসারকে শুরুর পর্যায়ে শনাক্ত করা যায় অথবা ক্যানসার চিকিৎসায় টারগেটেড থেরাপি (Targeted Therapy) উদ্ভাবনের পথ উন্মুক্ত হয়। তোমার কাজের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তোমাকেই প্রশ্ন করি- তোমরা এমন কোনো বায়োমার্কার আবিষ্কার করতে পারো না যা দিয়ে সহজেই সমাজের সর্বস্তরের দুর্নীতিপরায়ণ, মিথ্যাচারী, অসৎ, আর শোষক মানুষগুলোকে অনেক আগে থেকেই শনাক্ত করা যায়? তাদের যথাযোগ্য নিরাময়ের ব্যবস্থা নেওয়া যায়? তোমরা জিনের এক্সপ্রেশন অ্যানালাইসিস করে বলতে পারবে কি, কোনো কোনো জিনের এক্সপ্রেশন মানুষের ভেতরের অন্যায় চিন্তার স্প্রিহার সঙ্গে সরাসরি জড়িত? আমি নিশ্চিত, তুমি হয়তোবা একই জিনের এক্সপ্রেশন দেখতে পাবে সকল দুর্নীতিপরায়ণ, মিথ্যাচারী, আর অসৎ মানুষদের মাঝে। আমাদের আজ নতুন বায়োমার্কার আর টারগেটেড থেরাপির বড়ই প্রয়োজন শুধু অসৎ মানুষগুলোকে শনাক্ত করে যথাযোগ্য চিকিৎসা দিয়ে তাদের শুদ্ধ করে তোলার জন্য।

জানো আমি একটি আবিষ্কারের স্বপ্ন দেখি! বিজ্ঞানের প্রয়োগে অসৎ মানুষকে পরিশুদ্ধ করা হবে। তোমরা ক্যানসারের মতো রোগের কারণ খুঁজে বের করো, তাকে শনাক্ত করো, প্রতিরোধ আর প্রতিষেধক বের কর। কিন্তু আমরাতো আজ ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ সমস্যার মধ্যে আছি। আমাদের সমাজের মানুষেরা ক্রমে ক্রমে অন্যায়ে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আজ প্রয়োজন মানুষের মধ্যে ওই সব জিনকে- যা অন্যায় করতে প্রণোদিত করে তা পর্যবেক্ষণ করা; তারপর থেরাপির ব্যবহার করে তাদের জিনোমকে এডিট করা আর তাদের চিকিৎসা প্রদান করা। তোমাদের CRISPR/Cas9 সিস্টেম কি পারে না অন্যায়কারীর জিনোমকে এডিট করে তার যথার্থ সুচিকিৎসা দিতে? যদি অন্যায়কারীর সুচিকিৎসা আর শুদ্ধতা আনয়ন না করা যায় তাহলে চক্রাকারে অন্যায় আবর্তিত হতেই থাকবে যার কোনোও উপসংহার থাকবে না। আজ একজনের রেখে যাওয়া অন্যায় কাজ- আরেক জনকে সম্পন্ন করতে ইন্ধন জাগাবে। ঠিক যেমন করে তুমি বলেছিলে কাজের কোনোও উপসংহার হয় না তাই অন্যায় কাজেরও পরিসমাপ্তি হবে না কোনো দিন। বিজ্ঞান কি এসব দূষিত মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে না?

ইতি,
তোমারই কমরেড

*লেখক: রিসার্চ সায়েন্টিস্ট, ক্যানসার রিসার্চ, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]