টফু: চীনের ঐতিহ্যবাহী দুর্গন্ধযুক্ত খাবারের স্বাদকথা

টফু। ছবি: সংগৃহীত
টফু। ছবি: সংগৃহীত

সময়টা ২০১৭, চীনে তখন সদ্য পা ফেলেছি। নতুন এক পরিবেশে লালন করা স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আনন্দ যেমন ছিল, তেমনি এতটা বছর পিতা–মাতার সান্নিধ্যে কাটানো আর মাতৃভূমি ছাড়ার কষ্টে বিষণ্নতায় কাটছিল প্রথম প্রথম বেশ কয়েকটি দিন। এদিকে পেটপুজো দিতে হলে আশপাশটা ঘুরে বাজারসদাই করতে হবে নিঃসন্দেহে। এরই লক্ষ্যে শুরু হয় দুজন বন্ধু মিলে প্রায়ই চারপাশটা ঘোরা শুরু করি।

হাঁটার পথে অসংখ্য ছোটখাটো দোকান থেকে উদ্ভট একটা গন্ধ নাকে এসে বিঁধত। প্রথমে শুয়োর ফ্রাই থেকে ছড়ানো গন্ধ মনে করে ভুল করলেও পরে ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল শুয়োর রান্নার প্রসেসিংয়ে ও রকম বিদঘুটে গন্ধ বেরোনোর অবকাশ নেই।

যা হোক, গন্ধ নিয়ে চলতে থাকে আরও বিস্তর বিশ্লেষণ। এদিকে বেশ কিছুদিন পর হঠাৎই একদিন জানতে পারি, ফার্মেন্টেড সয়াবিন কার্ড (চীনা ভাষায় chòu dòufu); সহজভাবে বলতে গেলে গন্ধযুক্ত টফু নামক চীনা জনপ্রিয় স্ন্যাকস, যা কিনা ভাজার সময় মূলত তীব্র এক গন্ধ ছড়ায়; কিন্তু খাবার হিসেবে জিনিসটি নাকি বেশ মুখরোচক।

টফু: ছবি: সংগৃহীত
টফু: ছবি: সংগৃহীত

তা ছাড়া খাবারটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পুরোনো এক ইতিহাসের সন্ধান মেলে। ঝু-ইউয়ানঝাং নামে একজন চীনা দরিদ্র ব্যক্তি, যিনি কিনা পরে সেনাপতি হন, তিনি এ খাবারের উদ্ভাবক। একদিন ঝু-ইউয়ানঝাং বেশ ক্ষুধার্তাবস্থায় এক বাড়িতে থাকা বেশ কয়েক দিনের পুরোনো ভাজা সয়াবিন কার্ড মুখে পুরে দেন, যার সুস্বাদু স্বাদে বিমোহিত হয়েছিলেন। পরে তিনি সামরিক সেনাপতি হয়ে যুদ্ধে সফলভাবে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে আনহুই প্রদেশে এক যুদ্ধে জয় লাভ করেন। বিজয় উদ্‌যাপনের প্রাক্কালে তিনি পুরো সেনাবাহিনীকে ‘ছউ দফু’ খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে শিগগিরই খাবারটি পুরো চায়নাতে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।

আবারও নিজ প্রসঙ্গে আসা যাক, মুসলিম বলে খাবারটির আদ্যোপান্ত সম্পর্কে স্টাডি করতে হলো, পুরো প্রসেসে অ্যানিমেল ফ্যাট বা অ্যালকোহলের কোনোরূপ ব্যবহার হয় কি না। কারণ, চীনাদের ক্ষেত্রে এমনকি শাক-সবজি রান্নার প্রসেসে বিয়ার কিংবা কুকিং-ওয়াইনের ব্যবহার খুব সাধারণ ব্যাপার। অবশেষে সব সন্দেহকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ফলাফল আমার অনুকূলে এল।

জানা যায়, মূল প্রসেসে সয়া দুধের সঙ্গে লবণ সহযোগে সয়াবিন কার্ড তৈরি করা হয়। এরপর সাইজমতো কেটে, এক দিন ব্রাইনে চুবিয়ে রেখে তৈরি হয় ফার্মান্টেড কার্ড। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ঠিক রেখে সয়াবিন কার্ড তৈরি বেশ ঝামেলাসাপেক্ষ বটে। ব্রাইনে চুবানোর ফলে সয়ার প্রোটিনগুলো প্রোটিজ এনজাইমের ক্রিয়ায় পচে যায়; এবং টফুতে থাকা সালফার অ্যামিনো অ্যাসিড পুরোপুরি হাইড্রোলাইজড হওয়ার ফলে একধরনের হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরি হয়, যা টফুর তীব্র গন্ধ সৃষ্টির পেছনে দায়ী। এরপর ভাজা হয় ডুবো তেলে, যার ফলে প্রোটিন ভেঙে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরি হয়ে অন্য রকম এক স্বাদ তৈরি করে।

স্টিংকি টফু শুকনো অথবা স্যুপ সহযোগে খাওয়া হয়। শুকনোটি খাওয়া হয় ভাজার পরে অল্প মসলা সহযোগে। অন্যদিকে, সবচেয়ে মজাদার আইটেমটি বেশ ঝালযুক্ত সুস্বাদু স্যুপের সঙ্গে তিলের তেল, বাদাম, রসুন পেস্ট ও ধনেপাতা সহযোগে খাওয়া হয়।

টফু। ছবি: সংগৃহীত
টফু। ছবি: সংগৃহীত

যা হোক, সবকিছু জেনে খাবারটির স্বাদ নেওয়ার ব্যাকুলতা চেপে বসল ঘাড়ে। কিন্তু মুশকিল এসে হাজির। আশপাশে অহরহ মুসলিম রেস্তোরাঁ থাকা সত্ত্বেও এমন কোনো মুসলিম খাবারের দোকানের খোঁজ পাওয়া গেল না, যেটাতে টফু বিক্রি হয়। মূলত, অমুসলিম দোকানে শুয়োর খুবই কমন; যে পাত্রে শুয়োর রান্না হয়, ঠিক ওই পাত্রেই চলে অন্যান্য রান্না। তা ছাড়া পূর্ববর্তী ডিস অ্যালকোহল সহযোগে রান্না হতেই পারে।

কিন্তু আমি বেশ নাছোড়বান্দা; খাবারের স্বাদ নেওয়া চাই–ই চাই। হঠাৎ মাথায় এল, যদি এমন কোনো খাবারের দোকানের সন্ধান পাওয়া যায়, যেখানে শুধু টফুই বিক্রি করে, এতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পেয়েও গেলাম শেষমেশ।

লেখক।
লেখক।

স্বামী-স্ত্রী মিলে ছোট্ট একটি দোকান চালান এবং সেখানে শুধু টফু আর পরোটা বিক্রি হয়। তবু দোকানির কাছ থেকে অ্যালকোহল ও শুয়োরের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি আর আমাকে আশাহত করলেন না। অর্ডার দিলাম সবচেয়ে ছোট এবং কমদামি প্যাকটি। প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও শেষমেশ মুখে পুরে দিই এক পিস; সঙ্গে সুস্বাদু স্যুপের এক চুমুক। সত্যিই স্বাদটা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছিল বৈকি।

এ কথা মনে করা হয় যে শিশুদের মুখ্য ইন্দ্রিয় জিব; পৃথিবীকে সে পরখ করতে চায় সম্ভবত জিব দিয়ে, তাই হাতের কাছে কিছু পেলে তা মুখে পুরে স্বাদ নেয়। আপনি-আমি শিশু নই, তবে যাচাই-বাছাই করে স্বাদ নিতে বিপত্তি কোথায়!

আমি হলফ করে বলতে পারি, টফুর স্বাদ একবার গ্রহণ করলে এর প্রেমে পড়তে হবেই। আমি নিজে প্রায়ই টফু খাই; যে খাবারের গন্ধ একসময় আমাকে রাস্তার সাইড পাল্টাতে করতে বাধ্য করত।

*লেখক: শিক্ষার্থী, চীন মেকানিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশল